বাংলায় যুগে যুগে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন

Abdul-Hafiz-Khasru-Low-Pixelsপ্রকৌশলী আবদুল হাফিজ খসরু: সংস্কৃতি হলো মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে টিকে থাকার কৌশল যা ভৌগলিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও জৈবিকসহ নানা বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে। সংস্কৃতির মূল উৎস ধর্ম। সে অর্থে ধর্মের সবটুকুই সংস্কৃতি, কিন্তু সংস্কৃতির সবটুকুই ধর্ম নয়। সেখানে নৃতাত্ত্বিক কিংবা ভৌগলিক আচার-প্রথাও অন্তর্ভুক্ত থাকে। যেমন বর্তমানে আমাদের ভৌগলিক জাতীয়তা হচ্ছে বাংলাদেশী, ভাষা ও নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তা হচ্ছে বাঙালী এবং নব্বই ভাগ মানুষের ধর্মীয় জাতীয়তা হচ্ছে মুসলিম। ব্রিটিশ ভারত থেকে ১৯৪৭ সালে মূলত ধর্মের ভিত্তিতেই পূর্ব পাকিস্তান, পরবর্তিতে বাংলাদেশ হিসেবে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। সেই হিসেবে এই ভূখ-ের সংস্কৃতির মূল ভিত্তি হচ্ছে ইসলাম। এখানে ভাষা ও নৃতাত্ত্বিক উৎস গৌণ। বরং ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক নয় এমন নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতিও আবহমানকাল ধরে এখানকার সুস্থ ও গ্রহণযোগ্য সংস্কৃতি হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে।

বাংলার মাটির সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক হাজার বছরেরও বেশি কালের। পুরো সাড়ে ছয়শ বছর আমরা শুধু এই দেশের শাসক ছিলাম। তার মধ্যে প্রায় তিনশ বছর পশ্চিম বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা শাসন করেছি। এই সময়ের মধ্যে মুসলমানরা এই বাংলাকে নিজস্ব জাতি, নাম, ভাষা ও সাহিত্য দিয়েছিল। সে ভাষা ও সাহিত্যের মধ্য দিয়ে আমরা বাঙ্গালিত্বকে নতুন মর্যাদা, ভাষায় নতুন সুর, গলায় নতুন জোর দিয়েছিলাম। কৃষ্টি, সভ্যতা, শিল্প-বাণিজ্য ও শিক্ষা-সাহিত্যে সভ্য জগতের দরবারে বাংলাদেশকে করেছিলাম সুপ্রতিষ্ঠিত।

পাল আমলে বাংলার সংস্কৃতি :
কি নৃতত্ত্বের দিক হতে, কি ভাষা-কৃষ্টির দিক হতে পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশ ও আসাম আর্য ভারত হতে বরাবরই পৃথক ছিল। আর্যরা ছিল বর্ণবাদী এবং শ্রেণি প্রথায় বিশ্বাসী, তাই তারা কোনদিনই পারে নাই বাংলা বিজয় করতে। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এদেশ দ্রাবিড়দেরই দখলে ছিল। দ্রাবিড়রা বৌদ্ধ ধর্মের দিকেই বেশি আকৃষ্ট হয়, কারণ বৌদ্ধরা বর্ণবিরোধী ও সাম্যবাদী ছিল। সে সময়ে বাংলার শাসক ছিলো বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী পাল বংশ। পাল বংশের রাজারা ৭৫০ খৃস্টাব্দ থেকে ১১৭৪ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত মোট সোয়া চারশত বছর বাংলা শাসন করে। সে সময়ে এদেশের জনসাধারণের মাঝে বৌদ্ধ ধর্ম, দ্রাবিড়ী কৃষ্টি ও বৌদ্ধসংস্কৃত ভাষার প্রচলন ছিল। তারা শুধু আর্য কৃষ্টি ও সংস্কৃত ভাষা হতে বাংলাকে বাঁচায়নি, বরং মগধ পর্যন্ত দখল করে আর্য ধর্ম ও সংস্কৃত ভাষাকে বাংলার সীমানার বাইরে বহুদূরে ঠেলে দিয়েছিলেন।

সেন আমলে বাংলার সংস্কৃতি :
পাল বংশের চূড়ান্ত পতনের আরো বহু পূর্বে ১০৯৭ খৃস্টাব্দ থেকেই বাংলার কিছু অঞ্চলে সেন বংশের রাজত্ব শুরু হয়। ১১৭৪ খৃস্টাব্দে পাল রাজবংশের সর্বশেষ রাজা মদনপালের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলায় সেনদের রাজত্ব পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১২৫০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত টিকে থাকে। সেন বংশ যখন দ্রাবিড় বাংলার শাসক হিসেবে আবির্ভূত হয় তখনই শুরু হয় বাংলার সংস্কৃতির আকাশে কালো মেঘের ঘনঘাটা। সেন বংশের রাজারা ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং ব্রাহ্মণ। সেই সময়ে তারা যেমন নি¤œবর্ণের হিন্দুদের উপর নিপীড়ন চালাতো তেমনি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদেরও গণহারে হত্যা-নির্যাতন করতো। শুধু তাই নয় দ্রাবিড় বাংলার কৃষ্টি-সংস্কৃতির উপরও তারা বর্ণবাদী আর্য ব্রাহ্মণ কৃষ্টি-সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়া শুরু করলো। আর্য হিন্দুদের আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হয়ে বাংলা হারাতে বসেছিল তার প্রাগৈতিহাসিক কালের দ্রাবিড়ীয় সংস্কৃতি।

মুসলিম আমলে বাংলার সংস্কৃতি :
সেন বংশের রাজারা যখন দ্রাবিড় বাংলার নিজস্ব ভাষা ও কৃষ্টি-সংস্কৃতি দমন করে এর উপর বর্ণবাদী আর্য কৃষ্টি-সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা শুরু করেন, ঠিক সেই সময়ে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১২০৩ খৃস্টাব্দে দিল্লীর সুলতান কুতুব উদ্দিন আইবেকের নির্দেশে তুর্কী বংশোদ্ভুত মুসলিম বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী বাংলা বিজয় করেন। তিনি সেন বংশের রাজা লক্ষণ সেনের রাজধানী নদীয়া আক্রমন করে বাংলায় মুসলিম শাসনের ভিত্তি স্থাপন করেন। এরপর থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত বাংলায় মুসলিম শাসন জারি ছিল। সেন বংশের রাজত্বকালে বৌদ্ধ ধর্ম নির্মূল শুরু হয়, অনেক বৌদ্ধধর্মানুসারীকে হত্যা করা হয়। ঠিক সে সময়ে সাম্যবাদী ধর্ম ইসলামের সাহায্য-সহযোগীতায় বৌদ্ধধর্ম চূড়ান্ত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। কৃতজ্ঞতায় মানুষ দলে দলে বৌদ্ধ ধর্ম ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে। ইসলামী ছাপ নিয়েই বাংলায় নয়া কৃষ্টি জীবন গড়ে উঠে। মুসলিম আমলে টানা সাড়ে ছয়শ বছর ধরে চলে এই কৃষ্টি-জীবন সৃষ্টির কাজ। তা এমন দানা বাঁধে যে মুসলিম শাসনাবসানের পরও উনিশ শতকের শেষ অবধি পর্যন্ত একশত বছর ধরে সে কৃষ্টি-সাহিত্যের প্রভাব অক্ষুণœ থাকে। সে সংস্কৃতি শুধু মুসলমানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নাই। অমুসলিম বাঙালীর মধ্যেও পরিব্যপ্ত হয়েছিল। ফলে তা পেয়েছিল একটি জাতীয় সত্তা ও সার্বজনীন রূপ।

ইংরেজ আমলে বাংলার সংস্কৃতি :
১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজ উদ্দৌলার পলাশী যুদ্ধে পরাজয়বরণের মধ্য দিয়ে বাংলায় তথা ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের সূত্রপাত ঘটে। দখলদার ইংরেজ শাসকরা তাদের সা¤্রাজ্যবাদী কূটনৈতিক তাগিদে ও দেশ শাসনের সুবিধার খাতিরে হিন্দু-মুসলিম বিরোধ সৃষ্টির প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে প্রচলিত ভাষা-কৃষ্টি-সাহিত্যের বিরুদ্ধে হিন্দুদের উস্কানি দেয়। বাংলা কৃষ্টি-সাহিত্য ইসলামী ছাপমুক্ত এবং বাংলা ভাষাকে আরবী-ফার্সী শব্দ বর্জিত বিশুদ্ধ আর্য ভাষা করার পরামর্শ দেয়। বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত ভাষার কণ্যা সাজানোর অলঙ্কারাদির নির্মাণ কাজ শুরু হয় এই সময়ে হতে। এ কাজ শুরু করে ইংরেজ সরকার এবং খৃস্টান মিশনারীদের সমবেত শক্তি। বিদেশী শাসকরা তাদের রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনেই আর্য জাতির পুনর্জাগরণের উস্কানী দিয়ে আমাদের হাজার বছরের প্রতিবেশীকে শত্রুভাবাপন্ন করে তুলেছিল। ইংরেজ রাজশক্তির দালাল উচ্চবর্ণের (ব্রাহ্মণ) এসব হিন্দু কবি-সাহিত্যিক ও জমিদারের নিষ্পেষণের মাধ্যমে বাংলা সংস্কৃতি হতে ইসলামী আদর্শের ছাপ ধুয়ে মুছে ফেলতে শুরু হয়েছিল। এমনিভাবে রাজরোষে আমাদের সংস্কৃতির অপমৃত্যু ঘটে। প্রচলিত রাষ্ট্রভাষাকে পরিবর্তন, শিক্ষানীতি পাল্টানো, পুনগ্রহণ পলিসির নামে সম্পদশালী অভিজাত মুসলিমদের দীনহীন পথের কাঙ্গালে রূপান্তরিত করা হয় এভাবেই।

পুরো একশো বছরের অবিশ্রান্ত চেষ্টায় বিশ শতকের গোড়ার দিকে এই সা¤্রাজ্যবাদী চক্রান্তের বিষময় ফল ফলতে শুরু করে। প্রচলিত বাংলা ভাষা এবং হাজার বছরের কৃষ্টি-সাহিত্যের বিরুদ্ধে ইংরেজ-হিন্দু অভিযান সফল হয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পিতা, বাঙালী জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এই অভিযানের মোকাবেলায় রুখে দাঁড়ায়। ক্রমান্বয়ে মুসলিম কৃষ্টির সাথে হিন্দু কৃষ্টি, প্রচলিত বাংলা ভাষার সাথে নবাগত সংস্কৃতকৃত ভাষার সংঘাত বাঁধে। এই সংঘাতের শেষ পরিণাম ১৯৪৭ খৃস্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টি।

পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার সংস্কৃতি :
যে বিশাল স্বপ্ন নিয়ে মুসলমানরা পাকিস্তান গঠন করলো, নিজেদের পৃথক আবাসভূমি তৈরি করলো কতিপয় মুনাফিক ও সেক্যুলার নেতৃত্বের কারণে সে স্বপ্ন ধুলিষ্যাত হতে শুরু হলো। পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের উপর শুরু হলো ভাষাগত, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য। প্রথমেই বাংলা ভাষার উপর আক্রমন। বাংলাকে হিন্দুদের ভাষা আখ্যা দিয়ে ঊর্দুকেই গোটা পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতা জীবন দিয়ে এ সিদ্ধান্ত রুখে দেয়। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীকার আন্দোলনে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান ও ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। যদিও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠালাভের পর তমদ্দুন মজলিসের মত বাঙালী মুসলিমদের আরো অনেক স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক সংগঠন ও কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল, কিন্তু ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত ঘটনাটি তা ম্লান করে দিল। এরপর বাম ও কমিউনিজম আন্দোলনের প্রভাবে উদীচি ও ছায়ানটের মত কিছু সেক্যুলার সাংস্কৃতিক সংগঠন অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসী শক্তির বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করে। এদের হাত ধরেই পরবর্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশে অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পথ প্রশস্ত হতে শুরু করে।

স্বাধীন বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন: ব্রিটিশ-ভারতের আগ্রাসনের পর পাকিস্তান আমলের তেইশ বছর আমাদের সংস্কৃতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর সময় ছিল। শিক্ষাব্যবস্থা, সাহিত্য, বিনোদন, মিডিয়া, সঙ্গীত, বিভিন্ন উৎসবে মুসলিম সংস্কৃতির বিকাশ শুরু হতে থাকে। ব্রিটিশ-ভারতে পূর্ব বাংলার মুসলিম সংস্কৃতির যে অপমৃত্যু ঘটেছিল, পাকিস্তান আমলের তেইশ বছর তা আস্তে আস্তে প্রাণ ফিরে পেতে শুরু করে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত পশ্চিম পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে পাকিস্তান ভাগের অপরিহার্য্যতা প্রকাশ পেতে থাকে। অবশেষে ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করলাম। ভারত যে লক্ষ্যে আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধকালীন সহযোগীতা করেছিল পরবর্তিতে একের পর এক আগ্রাসনের মাধ্যমে তার জানান দেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ আগ্রাসন চালায় আমাদের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। মানুষের হৃদস্পন্দন বন্ধ হলে সে মানুষ মারা যায়, ঠিক একটি জাতির নিজস্ব শিক্ষা-সংস্কৃতির অপমৃত্যু ঘটাতে পারলে ঐ জাতিকে মেরুদ-হীন করে দেয়া যায়। ফলে বিনা যুদ্ধে সে দেশ দখল করা যায়। ভারত ও তার পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী পৃষ্ঠপোষক চক্র সে পথেই এখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এই আগ্রাসী শক্তি মূলত দু’ভাবে আমাদেরকে ঘায়েল করছে :
১। কৌশলে তাদের পছন্দ আমাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক আমরা তাদের মিডিয়া, স্যাটেলাইট চ্যানেল, সাহিত্য, সঙ্গীত, ভাষা, পোষাক-পরিচ্ছদ, প্রযুক্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছি।
২। দালাল সরকারের শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষাবিদদের দিয়ে আমাদের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা কিংবা শিক্ষা কারিকুলাম এমনভাবে ঢেলে সাজানো হচ্ছে যে একটি সময় পর তরুণ প্রজন্মের চিন্তাধারা ও মানসিকতায় ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। অর্থ্যাৎ ইসলাম বিমুখতা, আবহমানকালের ইসলামী ঐতিহ্য ও ব্যক্তিত্বের প্রতি ঘৃণাবোধ জাগ্রত, বস্তু নির্ভরশীলতা এবং নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধহীনতা প্রভৃতি।

কৌশলে যেসব মাধ্যমে আমাদের উপর অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানো হচ্ছে তার কয়েকটি মাধ্যম এখানে আলোচনা করা হলো :
১। কর্পোরেট মিডিয়া : দেশে বর্তমানে টিভি চ্যানেল ৩০ টি, দৈনিক পত্রিকা সংখ্যা সাড়ে পাঁচ শতাধিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক পত্রিকা ম্যাগাজিনের সংখ্যা কয়েক হাজার। হাতে গোনা কয়েকটি বাদে বাকী সব মিডিয়ার পরিবেশনা, সম্পাদকীয় নীতিমালা, উপস্থাপনা, রিপোর্টিং ইসলামী তাহজীব-তামাদ্দুন ও আবহমানকালের দেশীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধ। এছাড়া ভারত তার ৩২ টি স্যাটেলাইট চ্যানেল আমাদেরকে সম্প্রচারে বাধ্য করলেও আমাদের কোন চ্যানেল তাদের দেশে ঢুকতে দিচ্ছে না। ফলে ভারতীয় স্যাটেলাইট সংস্কৃতির একচেটিয়া আগ্রাসনের শিকার হচ্ছি আমরা। এসব মিডিয়া ভিনদেশী উলঙ্গ সংস্কৃতিকে এমনভাবে রাখঢাক করে প্রচার করছে যেন এ জাতি অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে এসব নষ্টামিকে গ্রহণ করতে! নিত্য-নতুন অশ্লীল মডেল, নায়ক-নায়িকা এরাই তৈরি করছে। এরাই অখ্যাতকে খ্যাতমান, খ্যাত-সম্মানীয়দের অসম্মান করে প্রচার করছে। আসলে অপ্রয়োজনীয় বিষয়ও মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে হলে ব্যাপক প্রচার-প্রপাগান্ডা চালাতে হয়, সেই কাজটাই এসব মিডিয়া করছে।

এখানে যেসব মিডিয়া রয়েছে তার নব্বইভাগই কোন না কোন কর্পোরেট বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত যেখানে প্রধানত উদ্দেশ্য থাকে প্রতিপক্ষ ব্যবসায়ী গ্রুপকে ঘায়েল ও নিজের অবৈধ ব্যবসায়ের পথ সুরক্ষা করা। এর সাথে যুক্ত হয় রাজনৈতিক হীন স্বার্থ ও সরকারি বাধ্যবাধকতায় প্রপাগান্ডা ছড়ানোর কাজ। সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হচ্ছে এখানকার সম্পাদকম-লী থেকে শুরু করে রিপোর্টার পর্যন্ত অধিকাংশ জনবলের আদর্শিক ব্যাকগ্রাউন্ড হচ্ছে চরম ধর্মহীনতা কিংবা ইসলাম বিদ্বেষিতা। চিহ্নিত এসব মিডিয়ার সম্পাদকীয় নীতিমালা এমন হলুদময় যে এদেরকে তথ্যসন্ত্রাসী মিডিয়া বললেও অত্যুক্তি হবে না। বিরোধী পক্ষকে ঘায়েলে অপবাদ, কুৎসা রটনা, জঙ্গি কানেকশন খোঁজাসহ এমন কোন অপতৎপরতা নেই যা এরা করছে না।

২। নাটক-সিনেমা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান : বর্তমান নাটক-সিনেমার জন্য এমনসব স্ক্রিপ্ট, সংলাপ লেখা হচ্ছে যা আমাদের সংস্কৃতির সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্য নয়। অবাস্তব ও অবান্তর কাহিনী, শুধুমাত্র অভিজাত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব, স্বল্প বসনা ও প্রায় নগ্ন নারীদেহের প্রদর্শণী, নৃত্য, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, বেলাল্লাপনার কাহিনীই এখনকার নাটক-সিনেমার মূল উপজীব্য। মা-বাবাকে বিকৃতভাবে পাপা, মাম্মী, ডেড, মম প্রভৃতি পশ্চিমা বুলিতে ডাকানো শিখাচ্ছে এসব সিনেমা। স্বল্পশিক্ষিত, দুশ্চরিত্র এবং লম্পট-বেশ্যা প্রকৃতির লোকজনের নিয়ন্ত্রণে আজকের নাটক-সিনেমা পাড়ার বিশাল অংশ। চরমভাবে ইসলামবিদ্বেষী একটি সেক্যুলার গোষ্ঠী নাট্যাঙ্গনে কিছু সৃজনশীল কাজ করলেও তাদের মূল উপজীব্য থাকে নারী ও তরুণ প্রজন্মের মাঝে ইসলাম ভীতি ছড়িয়ে দেয়া এবং ইসলামবিমুখ করে তোলা। এখানকার ফটোগ্রাফার ও ভিডিওএডিটররাও অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অন্যতম বাহক। স্বল্পবসনা হয়ে ফটোশুট করতে কিংবা পুরুষদের কাছে আরো কিভাবে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপিত হবে নারী মডেল-নায়িকাদেরকে তারা প্রলুব্ধ করে। তাছাড়া এডিটিং করা ছবি ও ভিডিও দিয়ে নায়ক-নায়িকাদের শারীরিক ত্রুটি, সৌন্দর্য প্রভৃতি আড়াল করে কৃত্রিমভাবে আকর্ষণীয় ও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে দর্শকদের প্রতারিত করছে ভিডিও এডিটর ও ফটোএডিটররা।

৩। সেক্যুলার লেখক-প্রকাশক: বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের যে বিশাল অবদান রয়েছে কিংবা বাংলা সংস্কৃতির উষালগ্ন থেকেই যে ইসলামী ছাপ রয়েছে এ প্রজন্মকে তা জানতেই দেয়া হচ্ছে না। ইংরেজ প্রভাবিত পশ্চিমবঙ্গের ব্রাহ্মণ্যবাদি হিন্দু সাহিত্যিকের গল্প-উপন্যাসের ভক্ত এদেশে এখনো কমেনি। বাংলাদেশে কয়েকজন সেক্যুলার-নাস্তিক লেখক রয়েছেন যাদের গল্প-উপন্যাস শিশুকিশোরদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। এরা গল্প-উপন্যাসে মুসলিম নামের এমন সব চরিত্র ও কাহিনী আকর্ষণীয়ভাবে অবতারণা করে যা মূলত ইসলামী তাহজীব-তামদ্দুন পরিপন্থী এবং শিশু-কিশোরদের কোমল হৃদয়ে ভয়ানক ছাপ ফেলছে। এসব সাহিত্যিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্য থেকে আরবী, ফার্সী শব্দগুলোকে সুকৌশলে বাদ দিয়ে সেখানে আর্যদের সংস্কৃত শব্দ অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে এবং কৌশলে ইসলামী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে যা ব্রিটিশ-ভারতের হিন্দু সাহিত্যিকরা করতো। যেমন: ইন্তেকাল শব্দকে প্রয়াত, লাশকে মরদেহ, জানাযাকে শেষ কৃত্য, শহীদ মিনারকে শহীদ বেদি, মূর্তি শব্দকে ভাষ্কর্য, আমন্ত্রণকে নিমন্ত্রণ, নামাযকে প্রার্থনা, জান্নাতকে স্বর্গ, কবরকে সমাধী, পানিকে জল, দোয়াকে আশীর্বাদ, আস্সালামু আলাইকুমকে সুপ্রভাত, শুভ অপরাহ্ন, গুড মর্নিং, গুড ইভিনিং প্রভৃতি।

৪। খৃস্টান মিশনারী ও এনজিও প্রতিষ্ঠান : গ্রামীণ জনপদে দারিদ্র্যতা নির্মূল, নারীর ক্ষমতায়ন এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার আড়ালে চলছে অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসন। মূলত খৃস্টান মিশনারী চক্র এ সমস্ত এনজিও ও স্বেচ্ছাসেবি প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক। নারীর ক্ষমতায়নের নামে স্বামীর উপর কর্তৃত্বপরায়ণতা, সন্তানকে মক্তবে পাঠানোর পরিবর্তে মিশনারী অথবা এনজিও কর্তৃক পরিচালিত স্কুলে পাঠানো, নারীদের সাইকেল ও মটরসাইকেল চালিয়ে বাড়ী বাড়ী ঘুরানো, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার পরিবেশ সৃষ্টি প্রভৃতি অপসাংস্কৃতিক কার্যক্রম গ্রামে-গঞ্জে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। খাদ্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সেবার বিনিময়ে দারিদ্র্যপীড়িত ও পার্বত্যাঞ্চলে খৃস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার অভিযোগও রয়েছে খৃস্টান মিশনারী সংগঠনগুলোর প্রতি।

৫। ডিজুস জেনারেশন : হলিউড মুভি, স্যাটেলাইট চ্যানেল, ভিডিও গেইমস, ব্যান্ড সঙ্গীত, রেডিও জকি ও ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কুপ্রভাবে বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে একধরণের মিশ্র কালচারের জন্ম হয়েছে, এরা ডিজুস জেনারেশন। এই জেনারেশনের কথাবার্তায় সুবচন এবং ব্যবহারে পরিশীলিত ও মার্জিত আচরণের যথেষ্ট ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। কথায় কথায় বাংলা-ইংরেজির (বাংলিশ) মিশ্রণ, নিজস্ব ঢঙে বাংলার বিকৃত উচ্চারণ, অশ্লীল ও ব্যঙ্গাত্বক শব্দ প্রয়োগ, কথার খৈ ফুটানো প্রভৃতি মুদ্রাদোষে এরা দুষ্ট। যেমন: ‘জিজ্ঞেস করা’কে ‘আবার জিগায়’ কিংবা ‘আবার কয়’, অপ্রয়োজনীয় কথা-কাজকে ‘আজাইরা প্যাঁচাল’, কারো বাড়ি পটুয়াখালি কিন্তু বিকৃত করে ওরা বলছে ‘অমুকের বাড়ী পইট্যা’, পরীক্ষার প্রস্তুতি সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে বলছে, ‘পরীক্ষায় ভালো হবে তার সম্ভাবিলিটি (সম্ভাবনা ও প্রবাবিলিটির সন্ধি) শুন্য’। এদের চুলের স্টাইল, কাটিং, পোষাক-পরিচ্ছদ ও চলাফেরায় নেই কোন মাধুর্যতা, নেই ভদ্রতা কিংবা মার্জিতবোধ। এরা ডিজিটাল যুগের অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হয়ে আজ নিজেরাই আগ্রাসনের বাহকে পরিণত হয়েছে।

৬। মার্কেটিং ও বিজ্ঞাপন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান : মার্কেটিং ও বিজ্ঞাপন শিল্পে নারীদের পণ্য হিসেবে ব্যবহার পশ্চিমে অর্ধ শতাব্দী পূর্ব থেকেই। কিন্তু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে বাংলাদেশে তার শুরু নব্বইর দশকে। এখন খুব কম সংখ্যক বিজ্ঞাপনই খুঁজে পাওয়া যাবে যেখানে নারীদেহের অশ্লীল প্রদর্শণী নেই। রাস্তাঘাটে প্রকা- বিলবোর্ড, ব্যানার, পোস্টারে নারীদেহের রগরগে প্রদর্শণীর সাথে পণ্যের বিজ্ঞাপন জুড়ে দেয়া হচ্ছে। বিনোদন ম্যাগাজিন, তারকা সংবাদ, দৈনিক পত্রিকার বিনোদন পাতায় উঠতি নারী মডেলদের রগরগে প্রদর্শণী ছাপা হচ্ছে হর-হামেশাই। নতুন তারকা-মডেলদের সন্ধানে আয়োজন করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা। রিসিপশনিস্ট এবং প্রাইভেট সেক্রেটারি সুন্দরী-সুশ্রী নারী না হলে অনেক বড় প্রতিষ্ঠানের টপ ম্যানেজমেন্টই যেন অচল হয়ে পড়ে!

৭। সঙ্গীত শিল্পী ও প্রযোজক প্রতিষ্ঠান : বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত অনেক কথাশিল্পী, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী, আয়োজক ও প্রযোজক প্রতিষ্ঠান অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অন্যতম বহক। হিন্দী ও তামিল গানের সুর নকল করে হার-হামেশাই বাংলা গান হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গানের কথায় দেশাত্মবোধ, ধর্মীয় উদ্দীপনা, শ্লীলতা ও মার্জিতবোধ, তারুণ্যের কর্মমুখী উদ্দীপনা আজ খুঁজে পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় যৌন সুড়সুড়ি, অবৈধ প্রেম-প্রণয়ের প্রতি উৎসাহবোধ এবং অর্থহীন কথা ও সুরলহর। ভিডিও গানের সাথে এখন উঠতি মডেলদের যৌন সুড়সুড়িমূলক নাচ ও অঙ্গভঙ্গির অভিনয় দেখানো হচ্ছে যা আমাদের সংস্কৃতি বিরুদ্ধ।

৮। ফ্যাশন ডিজাইনার ও চারু শিল্পী : ছেলেদের ঢিলেঢালা ও মার্জিত পোষাকের পরিবর্তে এখন বেশি পাওয়া যায় টাইট জিন্স, টিশার্ট, গেঞ্জি, স্কিন প্যান্ট, শার্ট। মেয়েদের লম্বা, ঢিলেঢালা ও শালীন পোষাকের চেয়ে মার্কেটে এখন বেশি পাওয়া যায় শর্ট কামিজ, ফ্রগ, স্কাট, স্কিন প্যান্ট, টাইট জিন্স, হাই হিল প্রভৃতি। বিদেশী ফ্যাশনাবল পোষাকের চেয়েও আমাদের ফ্যাশন ডিজাইনারদের তৈরি টাইটফিট, শর্ট ও অশালীন পোষাকের প্রতি অধিকাংশ তরুণ-তরুণীর রয়েছে বেশ আকর্ষণ। বিভিন্ন ফ্যাশন শোর নামে তরুণ-তরুণীর অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করছে ফ্যাশন ডিজাইনিং প্রতিষ্ঠানগুলো যা আমাদের আবহমানকালের সংস্কৃতির বিরুদ্ধ।
চারুকলা ইনস্টিটিউট কিংবা চিত্রশিল্পী যারা রয়েছে এদের সৃজনশীলতায় এমনসব কিছু থাকে যা ইসলাম ও এদেশের আবহমানকালের ঐতিহ্যপরিপন্থি। যেমন: পয়লা বৈশাখে হিন্দু দেবদেবির রঙ-বেরঙের প্রতিকৃতি অঙ্কন, ভাষ্কর্যের নামে মূর্তি-বেদি নির্মাণ, বইয়ের কভার ও পোস্টারে নারীদেহের অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন প্রভৃতি। এসব চারু শিল্পীদের পোষাক ও বডিফিগারের মধ্যেও রয়েছে অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ছাপ। ছেলেদের লম্বা চুল, হাতে চুড়ি, তামাকময় কালো ঠোট, নেশাগ্রস্থ চোখ, গায়ে চে-গুয়েভারার ছবিসহ টিশার্ট, মেয়েদের ওড়না ছাড়া শার্ট-প্যান্ট, টাইট জিন্স, ববকার্টিং চুল, রূক্ষ চেহারা প্রভৃতি। এদেরকে সৃজনশীল, তারুণ্যের প্রতিক ও প্রগতিশীল হিসেবে আগ্রাসী মিডিয়াগুলো জাতির সামনে পরিচিতি করছে।

৯। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার : মোবাইল, কম্পিউটার, ইন্টারনেট নি:সন্দেহে বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির সেরা উদ্ভাবনা। এসব ছাড়া বর্তমান দুনিয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থাই অকার্যকর থাকে। কিন্তু এসবের অপব্যবহারের কারণে আজকে তরুণ প্রজন্মের বিশাল অংশ অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসনের সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রীদের রাত জেগে মোবাইলে কথা, পড়াশোনার সময় নষ্ট করে সোশাল নেটওয়ার্কিং, ভিডিও গেমিং, ইন্টারনেট ও মোবাইল পর্ণগ্রাফির সহজলভ্যতা, কম্পিউটারে হলিউড-বলিউড মুভি কালেকশন আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির উপর বড় ধরণের আঘাত।

১০। বিভিন্ন উৎসব-দিবসে অপসংস্কৃতি চর্চা : ঈদ হচ্ছে মুসলমানদের আনন্দের দিন যা নির্মল ও ইবাদততুল্য। কিন্তু ঈদকে কেন্দ্র করে রেডিও-টিভি চ্যানেল, পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিনগুলো এমনসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করে যাতে ঈদ উৎসব একদিকে বাণিজ্যে অন্যদিকে অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হয়েছে। যেমন: ঈদের দিন থেকে দশম দিন পর্যন্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা, অশ্লীল নাটক-সিনেমার মুক্তি, সঙ্গীত এলবাম বাজারে ছাড়া, ফ্যাশন ডিজাইনারদের নিত্য নতুন অশালীন পোষাক প্রদর্শণী প্রভৃতি। শবে বরাতে আতশবাজি-ফোটকা ফুটানো, হালুয়া-রুটি বিতরণ, শবে কদরের রাতে পাড়া-মহল্লায় দলবেঁধে ঘোরাঘুরি, ঈদে মিলাদুন্নবীর নামে জশনে জুলুছ, মহররমের তাজিয়া মিছিল ও শরীর রক্তাক্তকরণ, রমজান মাসে তারাবীহ নামাজ বাদ দিয়ে রাতভর মার্কেটে ঘোরাঘুরি, কুরবানি ঈদে লোক দেখানোর জন্য বেশী দামে পশু ক্রয় প্রভৃতি হচ্ছে শিরকী ও অপসংস্কৃতিক আগ্রাসন। এছাড়াও হিন্দুদের পূজা উৎসবকে সার্বজনিন মনে করা, সৌজন্যতার খাতিরে পূজা ম-পে যাওয়া, পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়া, মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা, ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে খালি পায়ে প্রভাতফেরি, শহীদ মিনার, সৌধ কিংবা বেদীতে ফুল দেয়া, ম্যারেজ ডে, ফাদার’স ডে, মাদার’স ডে, জন্মদিন, থার্টি ফাস্ট নাইট প্রভৃতি পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেয়া অনর্থক দিবসগুলো উদযাপন আমাদের বাঙালী সংস্কৃতির অংশ কখনো ছিল না।

অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসনের উপরে বর্ণিত বাহকসমূহ কোনটা স্বতপ্রণোদিত হয়ে, কোনটা আগ্রাসী শক্তির আর্থিক, মানসিক ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশে অপসংস্কৃতি ছড়িয়ে দিচ্ছে। আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার মধ্যে রয়েছে এনজিও প্রতিষ্ঠা, সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরি, মিডিয়ায় তারকা সংগ্রহ প্রতিযোগিতা এবং খ্যাতি ছড়িয়ে দেয়া প্রভৃতি। মানসিক পৃষ্ঠপোষকতার মধ্যে রয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা তথা শিক্ষাকারিকুলাম নিজস্ব মতাদর্শে ঢেলে সাজানো, নিজস্ব বুদ্ধিজীবি ও সুশীল সমাজ দিয়ে বিভিন্ন সভা-সেমিনার, পত্রিকার কলাম, সাহিত্য-সাময়িকীর মাধ্যমে অপসংস্কৃতির প্রতি তরুণ প্রজন্মকে মানসিক গোলামে পরিণত করা এবং আসক্ত করা। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার মধ্যে রয়েছে নিজস্ব চিন্তাধারার লোকজনকে প্রশাসন, আইন ও বিচার বিভাগে অনুপ্রবেশ ঘটানো, মিডিয়া প্রতিষ্ঠা ও তথ্য সন্ত্রাসের মাধ্যমে ইসলামী রাজনীতি ও সংস্কৃতির প্রসারকে কোনঠাসা করে রাখা।

পরিত্রাণের উপায় কি : ভয়াবহ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে হলে আমার মতে নি¤েœাক্ত পাঁচটি বিষয়ে ইসলামপন্থীদের জরুরিভিত্তিতে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন :

১। মিডিয়ার জবাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে বিকল্প মিডিয়া : অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসী শক্তির এদেশীয় দালাল মিডিয়া মালিকদের মোকাবেলায় বিকল্প শক্তিশালী ও টেকসই মিডিয়া প্রতিষ্ঠা করা। টিভি চ্যানেল, দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক পত্রিকা-ম্যাগাজিন প্রকাশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা। ইসলামপন্থীদের স্ব-স্ব সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিম-লে সৎ ও সাহসী সংবাদকর্মী গড়ে তোলা। নির্মল বিনোদন, দ্বীনি উদ্দীপনা ও সমাজ সচেতনতামূলক সুস্থ নাটক-সিনেমা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। সুস্থ ও শালীন বিজ্ঞাপন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। সঙ্গীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান নিজস্ব আঙ্গিকে ঢেলে সাজানো ছাড়া প্রচলিত মিডিয়া আগ্রাসন প্রতিরোধ অসম্ভব।

বর্তমানে সবচেয়ে বড় ও পাওয়ারফুল মিডিয়া হচ্ছে ইন্টারনেট সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো। যেমন, ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউব, লিংকডইন প্রভৃতি। এখানে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও মিডিয়া কর্মী হিসেবে সুস্থ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মীদের সাহসিকতার সাথে ভূমিকা পালন করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো এত শক্তিশালী বিকল্প মিডিয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে ট্র্যাডিশনাল মিডিয়ায় সহজে কাভার করে না এমন সংবাদও এখানে আসছে এবং বেশী সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। এখন এমন হয়েছে যে ট্র্যাডিশনাল মিডিয়াগুলোর সংবাদের অন্যতম উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া সাইটগুলো। শ্বৈরশাসক, আধিপত্যবাদী ও সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে অত্যন্ত কম খরচে সত্য ও ন্যায়সঙ্গত সংবাদ প্রচারে সোশ্যাল সাইটগুলোই এখন একমাত্র শক্তিশালী মাধ্যম। যাদের সত্য অনুসন্ধানের মানসিকতা, প্রচারে সৎসাহস এবং লেখায় মাধুর্যতা রয়েছে তারা এখানে ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসা উচিৎ।

২। নিজ পরিবারকে দ্বীন ও সুস্থ সাংস্কৃতিক সচেতন করে গড়ে তোলা : আমাদের স্মরণ রাখা দরকার যে, একমাত্র ইসলামই পরিবার ব্যবস্থাকে শান্তিময় করেছে। পিতা-মাতা, বয়োবৃদ্ধ, শিক্ষক ও অভিভাবককে সম্মান করতে শিখিয়েছে, মেহমানদারী করতে শিখিয়েছে, বিপন্নকে বুকে তুলে নিতে বলেছে, গরীবকে দান করতে শিখিয়েছে। ইসলামী সংস্কৃতি ধর্মীয় অনুশাসনকে সুদৃঢ় অবস্থানে নিয়ে যায় এবং প্রত্যেক মানুষকে স্বশাসিত করে তোলে বা একটি কর্তৃপক্ষীয় ভূমিকা পালন করে। আর এসব অর্জনের জন্য শিশুকাল থেকেই সন্তানদেরকে প্রয়োজনীয় দ্বীনি জ্ঞান ও আমলে উৎসাহী করা। মা, বাবা, ভাই, বোন ও স্ত্রীকে দ্বীনি তালিম তরবিয়ত দেয়া ও সুস্থ সংস্কৃতির আহ্বান পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে পরিবারকে আগ্রাসনে হাত থেকে অনেকাংশে রক্ষা করা সম্ভব।

৩। অপসংস্কৃতির আগ্রাসী মাধ্যমসমূহ এবং মিডিয়া ব্যক্তিদের দ্বীনি দাওয়াত প্রদান : মুসলমানের সমাজে থেকে ইসলামী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থনগ্রহণকারী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে ব্যক্তিগত কিংবা দলগতভাবে ইসলামের সুমহান দাওয়াত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা। তাদের হেদায়াতের জন্য মহান আল্লাহর কাছে তৌফিক চাওয়া। অপসংস্কৃতির ক্ষতিকর প্রভাবগুলো এবং ভয়াবহ পরিণতি উপলব্ধি করানো। পরকালীন জবাবদিহীতার ভয় এবং জাহান্নামের শাস্তি চাক্ষুষ তুলে ধরা প্রভৃতি দাওয়াতি তৎপরতার মাধ্যমে মিডিয়া ব্যক্তিদের রক্ষার উদ্যোগ নেয়া।

৪। শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠন আন্দোলন : ইসলামী আদর্শের আলোকে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা একমুখী করে গড়ে না তুললে তরুণ প্রজন্মের উপর অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রভাব স্থায়ীভাবে প্রতিরোধ করা যাবে না। ইসলামপন্থীদেরকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাকারিকুলাম প্রতিষ্ঠার কাজ ত্বরান্বিত করা।

৫। চিহ্নিত মিডিয়া ও মালিকপ্রতিষ্ঠানের পণ্য বয়কট এবং জনসচেতনতা : যেসব মিডিয়া একের পর এক তথ্য সন্ত্রাস ও অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালাচ্ছে সেগুলোকে চিহ্নিত করা। এসকল মিডিয়া ও তাদের হৃষ্টপুষ্টতাদানকারী মালিকপক্ষের আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পণ্য বর্জনের ডাক দেয়া এবং মানুষকে সচেতন করা। সামাজিকভাবে বয়কটের শিকার হলে মিডিয়াগুলোর তথ্যসন্ত্রাস ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পথ রুদ্ধ হয়ে আসবে ইনশাআল্লাহ।

Print Friendly, PDF & Email