বাংলা ভাগ : মুসলমানদের দায় ও অর্জন

Abdul-Hafiz-Khasru-Low-Pixelsপ্রকৌশলী আবদুল হাফিজ খসরু :
১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশী যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। সেই সাথে ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের সূত্রপাত ঘটে যার পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে ভারত ও পাকিস্তান নামক দু’টি স্বাধীন দেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে। বৃটিশ শাসিত ভারতে বহু ভাষাভাষি ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতির জাতিগোষ্ঠী বিদ্যমান ছিল। তার মধ্যে বাঙালী জাতিগোষ্ঠী অন্যতম যার রয়েছে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধতা। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অধিকাংশ অধিবাসীই মূলত বাঙালী। ধর্মীয় সম্প্রদায়গতভাবে বাঙালী জনগোষ্ঠী প্রধানত মুসলিম ও হিন্দুতে বিভক্ত। ধর্মীয় বিভাজন থাকলেও বাঙালীদের রয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার যথেষ্ট দৃষ্টান্ত। বিশেষ করে এই বাংলা প্রায় ছয়শ’ বছর মুসলিম শাসনাধীন ছিল। এতদসত্ত্বেও সেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হওয়া কিংবা দাঙ্গার কোন ঘটনা কেউ ইতিহাসে খুঁজে পাবে না।

কিন্তু বাংলার আবহমানকালের সে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বুকে কুঠারাঘাত করেছে বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী। ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে ‘ডিভাইড এ- রুল’ এই নীতিতে নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে ইংরেজ শাসকরা উচ্চ বর্ণের সুবিধাবাদ হিন্দু কবি-সাহিত্যিক দিয়ে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়িয়েছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদার প্রথা সৃষ্টি করে হিন্দুদের দ্বারা মুসলমানদের অর্থনৈতিক শোষণ করিয়েছে। অথচ বাংলার সমৃদ্ধ ইতিহাস বিনির্মাণে মুসলমানদের অবদান কখনোই কম ছিল না। বিশেষ করে এই বাংলার রাজনৈতিক অস্তিত্ত্বের আবির্ভাব ঘটে ১৩ শতকে মুসলিম শাসনের সময়। বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ওপর বিশেষজ্ঞ দুর্গাচন্দ্র সান্যাল সঠিকভাবেই চিহ্নিত করেছেন যে, সমস্ত বাংলা ভূখ- মুসলিমদের আগে হিন্দু শাসনের সময় কখনো এক দেশ হিসেবে রাজনৈতিকভাবে আবির্ভূত হয়নি।

তিনি লিখেছেন, ‘গৌড়ের হিন্দু রাজারা ক্রমান্বয়ে এ অঞ্চলের পাঁচটি রাজ্য দখল করে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। সেগুলো হচ্ছে বরেন্দ্রভূমি, বঙ্গ, মিথিলা, রাঢ় এবং বকদ্বিপ বা বগদি। এগুলোকে তখনকার গৌঢ়ের অধীনরাজ্য বলা হতো। পরবর্তীতে মুসলিম শাসকরা এই অধীন রাজ্যগুলো অধিকার করেন। তারা মিথিলাকে মগদের সাথে একিভূত করে সুবে-বিহার নাম দেন। অন্যদিকে বাকি চারটিকে একত্র করে নাম দেন সুবে-বাঙালা। ‘বাঙালা দেশ’ নামটি এই ‘বাঙালা’ থেকেই আগত। এরপর উত্তর এবং পূর্ব সীমান্ত মুসলিম শাসকদের নিয়ন্ত্রণে আসার পর আশপাশের এলাকাগুলো বাঙালা দেশের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে। এভাবে বাঙালা দেশ একটি বিশাল দেশে পরিণত হয়’ [দুর্গাচন্দ্র সান্যাল, বাঙালার সামাজিক ইতিহাস (সোশ্যাল হিস্টোরি অব বাংলা), মডেল পাবলিশিং হাউজ, কলকাতা, পৃষ্ঠা ১৮]।

ব্রিটিশরা এই ‘বাঙালা’ দেশকে ‘বেঙ্গল’ বলতো। সমস্ত বাংলা ভূখ-ে বাংলাভাষী মুসলমানরা বাংলাভাষী হিন্দুদের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তবে ব্রিটিশ ভারতের শিল্পনগরী কলকাতার সিংহভাগ জনগোষ্ঠী ছিল বিভিন্ন ভাষাভাষী হিন্দু সম্প্রদায়ের। হিন্দু নেতারা ১৯০৫ সালে যেমন বঙ্গভঙ্গ মানেন নাই নিজেদের স্বার্থে, তেমনি ১৯৪৭ সালে বাংলাকে বিভাজন করে ছেড়েছেন সেই নিজেদের স্বার্থেই। যদিও বাংলা মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ এই বিভাজন রোধের অনেক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। প্রকৃত ইতিহাস আড়াল করে এখনও একশ্রেণির লেখক-বুদ্ধিজীবি বাংলা বিভাজনের জন্য মুসলমানদের একচেটিয়া দায় করে চলেছেন। তারা বলছেন জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের কারণে নাকি বাংলা বিভাজন হয়েছিল। ১৯৪৬ সালে ক্যবিনেট মিশন প্লান অনুযায়ী অবিভক্ত বাংলা নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের বাইরে তৃতীয় আলাদা রাষ্ট্র গঠনের যে প্রস্তাব বৃটিশ সরকার দিয়েছিল তা গ্রাহ্যই করেননি কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহেরু ও বল্লবভাই প্যাটেল। অথচ মুসলিমলীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং অবিভক্ত বাংলার শেষ মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তা গ্রহণে সম্মত হয়েছিলেন। হিন্দু নেতারা যদি সে সময়ে এ প্রস্তাব গ্রহণ করতেন তাহলে বাংলা হতো পাকিস্তানের চেয়েও বৃহত্তম ও সমৃদ্ধ একটি দেশ। সেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকলেও হিন্দুদের প্রভাব-প্রতিপত্তিতে কোন অংশেই ঘাটতি হতো না। প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোর প্রতি বর্তমান ভারতের মোড়লীপনা ও একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব হয়ে ঠিক থাকতো দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য।

প্রথম বাংলা বিভক্তি বা বঙ্গভঙ্গ: প্রথম বাংলা বিভক্তি ঘটে ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর। ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জনের আদেশে ১ম বঙ্গভঙ্গ সম্পন্ন হয়। বাংলা বিভক্ত করে ফেলার ধারণাটি অবশ্য কার্জন থেকে শুরু হয়নি। ১৭৬৫ সালের পর থেকেই বিহার ও উড়িষ্যা বাংলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে সরকারি প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে বাংলা অতিরিক্ত বড় হয়ে যায় এবং বৃটিশ সরকারের পক্ষে এটির সুষ্ঠু শাসন প্রক্রিয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। যার কারণে পূর্ববঙ্গ শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক উন্নয়নেও অনেক পিছিয়ে পড়ে। বঙ্গভঙ্গের সূত্রপাত এখান থেকেই। প্রথম বাংলা বিভক্তির পর একটি নতুন প্রদেশ গঠিত হল আসাম ও পূর্ববঙ্গ নিয়ে যার রাজধানী ছিল ঢাকা। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার এবং উড়িষ্যার রাজধানী হিসেবে কলকাতা-ই রয়ে গেল। ব্রিটিশ শাসকদের প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বঙ্গভঙ্গ হলেও তাতে পূর্ববঙ্গের জনগণই সবচেয়ে লাভবান হত। তবে ১৯০২ সালে প্রথম যখন “বঙ্গভঙ্গ” প্রস্তাব উথাপন করা হয় তা কলকাতা কেন্দ্রিক অভিজাত হিন্দু ‘ভদ্রলোক’দের প্রচ ভাবে নাড়া দেয়।

পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুনেতাদের ধারণা ছিল যে এটা পূর্ববাংলার হিন্দুদের ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পশ্চিম বাংলায় হিন্দুদের ভাষাগত সংখ্যালঘুতে পরিণত করবে, তাই তারা এর বিরোধিতা শুরু করে। এমতাবস্থায়, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের পক্ষে মুসলমানদের সমর্থন আদায়ের জন্য ১৯০৪ সালে ফেব্রুয়ারির ৩য় সপ্তাহে ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম সফর করেন। ১৮ই ফেব্রুয়ারি লর্ড কার্জন নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর ঢাকাস্থ বাসভবন “আহসান মনজিলে” উপস্থিত শ্রোতাদের সামনে এক বক্তৃতায় বলেন, “ঢাকা এতদিন তার ছায়া হয়ে পড়েছিল, সরকার ঢাকাকে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিণত করবে, এমনভাবে এখানে বিনিয়োগ করা হবে যাতে করে মুসলমানরা উপকৃত হবেন ও প্রভূত সুযোগ সুবিধা উপভোগ করবেন, যা এই অঞ্চলের পূর্বেকার মুসলমান শাসক ও রাজা-বাদশাদের সময়েও সম্ভব হয়নি। এই নতুন প্রদেশের রাজধানী হবে আত্মনির্ভরশীল প্রশাসনিক রীতিনীতির উপর যার মূল ভিত্তি হবে এই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সংস্কৃতি ও মতামত। ”

আমেরিকান প্রফেসর জন আর ম্যাকলেইন যিনি ‘বাংলা ভাগ’ নিয়ে গবেষণা করেছেন, পূর্ববঙ্গের শিক্ষিত মুসলমানদের মনোভাব সঠিকভাবেই নিরূপণ করেছেন এইভাবে, “১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গকে শিক্ষিত মুসলমানদের দ্বারা সাদরে গৃহীত হয়েছিল, কারণ এর মাধ্যমে তাদের শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছিল। ” [সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত জন আর ম্যাকলেইনের ‘পার্টিশন অব বেঙ্গল ১৯০৫, অ্যা পলিটিক্যাল এনালিসিস’, হিস্টোরি অব বাংলাদেশ: ১৭০৪-১৯৭১, ভলিউম ১, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, ঢাকা, ১৯৯২, পৃষ্ঠা ৩১১]
সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে হিন্দু সম্প্রদায়ের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট শিক্ষিত মুসলমানরা এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন যে, ১৯০১ সালে তৎকালীন বাংলার সরকারের অধীনে উচ্চ পর্যায়ের নিয়োগের ক্ষেত্রে মুসলিমরা মাত্র ৪১টি পদ পেয়েছিল। অন্যদিকে মুসলিম জনসংখ্যার তিনভাগের একভাগ হয়েও হিন্দুরা নিয়োগ পেয়েছিল ১২৩৫টি উচ্চপদে [সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত জন আর ম্যাকলেইনের ‘পার্টিশন অব বেঙ্গল ১৯০৫, অ্যা পলিটিক্যাল এনালিসিস’, হিস্টোরি অব বাংলাদেশ: ১৭০৪-১৯৭১, ভলিউম ১, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, ঢাকা, ১৯৯২, পৃষ্ঠা ৩১৭]।

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ কার্যকরের পর পূর্ববাংলা সরকার দেখলো মন্ত্রণালয়, বিভাগ, জেলা এবং সাবডিভিশনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর মাত্র ছয় ভাগের এক ভাগের মতো বঙ্গভঙ্গের পূর্বে মুসলমানদের অধীনে ছিল, যদিও এখানে মুসলমানদের সংখ্যা হিন্দুদের চেয়ে দ্বিগুণ। আর পুলিশ বিভাগে মুসলমানদের উপস্থিতি ছিল আরো খারাপ। শতকরা ৫৯ ভাগ মুসলমান জনসংখ্যা থাকার পরও তখন ‘ইস্টার্ন বেঙ্গল রেঞ্জ’ নামে পরিচিত পুলিশ বিভাগে মোট ৫৪ জন ইনস্পেক্টরের মধ্যে চারজন, ৪৮৪ জন সাব ইনস্পেক্টরের মধ্যে ৬০ জন, ৪৫০ জন হেড-কনস্টেবলের মধ্যে ৪৫ জন এবং ৪৫৯৪ জন কনস্টেবলের মধ্যে মাত্র ১০২৭ জন কনস্টেবল ছিলেন মুসলমান [সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত জন আর ম্যাকলেইনের ‘পার্টিশন অব বেঙ্গল ১৯০৫, অ্যা পলিটিক্যাল এনালিসিস’, হিস্টোরি অব বাংলাদেশ: ১৭০৪-১৯৭১, ভলিউম ১, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, ঢাকা, ১৯৯২]

নতুন এই প্রদেশ গঠনের বিরুদ্ধে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতারা সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে দেন। হিন্দু জাতীয়তাবাদী জমিদার শ্রেণীর অধিকাংশই তখন কলকাতায় বসবাস করতেন। বঙ্গভঙ্গ হলে তাদের অনেক অসুবিধা হওয়ার ভয় হয়। কলকাতার ব্যবসায়ীরা দেখলেন, আলাদা প্রদেশ হলে পূর্ব বাংলা ও আসামের লোকেরা কলকাতা বন্দর ব্যবহার না করে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে থাকলে তাদের ব্যবসায়িক ক্ষতি হবে, কলকাতা হাইকোর্টের উকিল বাবুরা ভাবলেন ঢাকায় হাইকোর্ট হলে পূর্ববঙ্গের মক্কেলরা তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। খবরের কাগজের মালিকরা দেখলেন ঢাকা থেকে নতুন পত্র-পত্রিকা প্রকাশ হতে শুরু করলে তাদের পত্র-পত্রিকার প্রচার সংখ্যা কমে যাবে। বাবুদের আরো ভয় ছিল যে, বঙ্গভঙ্গ হলে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি অনেক কমে যাবে। কারণ দুই প্রদেশেই তারা হবে সংখ্যালঘু। পূর্ববঙ্গ ও আসামে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং অন্য প্রদেশের ভাষাগত সংখ্যালঘু। জাতীয় আন্দোলন বলতে যারা হিন্দু পুনর্জাগরণ এবং জাতীয়তা বলতে ‘হিন্দুত্ব’ বুঝতেন, সেসব নেতার পক্ষে বঙ্গভঙ্গ ছিল অসহনীয়। ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতা টাউন হলের হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের সভায় বঙ্গভঙ্গ করা হলে ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের প্রস্তাব করা হয়। সভায় সভাপতির ভাষণে কাশিমবাজারের মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী বলেছিলেন, ‘নতুন প্রদেশ মুসলমানদের প্রাধান্য স্থাপিত হইবে, বাঙ্গালী হিন্দুগণ সংখ্যালঘুতে পরিণত হইবে। আমাদেরকে নিজেদের দেশে আগন্তুকের মত থাকিতে হইবে। আমাদের জাতির ভাগ্যে ভবিষ্যতে যে কি হইবে, তাহা চিন্তা করিয়া আতংকিত হইয়া পড়িতেছি। ’

বঙ্গভঙ্গ রদ করার আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কারণ তার বাপ দাদাদের জমিদারির অধিকাংশই ছিল পূর্ববঙ্গে। তিনি ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবকদের জন্য এক মর্মস্পর্শী গান ‘আমার সোনার বাংলা’ লেখেন যা অনেক পরে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতে পরিণত হয়। বাংলার মুসলিম এবং হিন্দুদের মধ্যে কথিত ভ্রাতৃত্বের চেতনা জাগিয়ে তুলতে কয়েকদিনের মধ্যে ঠাকুর নিজে সক্রিয় হয়ে ‘রাখিবন্ধন’র আয়োজন করেন। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আয়োজিত একটি প্রতিবাদী মিছিলে রবীন্দ্রনাথ নিজে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের হাতে রাখিবন্ধন পরিয়ে দিয়েছেন

অবশেষে উচ্চবর্গীয় ও অভিজাত হিন্দুদের প্রতিবাদ এবং চরমপন্থী স্বদেশী আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ১৯১১ সালের ২০ আগস্ট বঙ্গ আবার একত্রিত হয় অর্থ্যাৎ বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। ভাষাতাত্ত্বিক এক নতুন বিভক্তির মাধ্যমে হিন্দি, উড়িষ্যা এবং আসাম (বর্তমানে ভারতের আসামসহ উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহ) বঙ্গ হতে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় আনা হয়। এরই সাথে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে নয়া দিল্লীতে স্থানান্তর করা হয়।

১৯৪৭ এ বাংলা বিভাজন :
১৯৪৭ সালের বাংলা ভাগ প্রকৃতপক্ষে এ ধরণের দ্বিতীয় ঘটনা। প্রথমটি ঘটেছিল ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর যা একটু আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। যেটি পরবর্তীতে ১৯১১ সালের ২০ আগস্ট রদ করা হয়। প্রথম বিভাজনটি রদ করা হয় কলকাতাভিত্তিক হিন্দু এলিট শ্রেণীর বড় ধরনের রাজনৈতিক প্রতিরোধের মুখে। এর ঠিক বিপরীত ভূমিকা নিয়ে দ্বিতীয় ঘটনায় কলকাতার হিন্দু এলিটরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বাংলা বিভাজন নিশ্চিত করেন। উভয় সময়ে তাদের উদ্দেশ্য একই ছিল। পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের ওপর সাম্প্রদায়িক বিচারে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্য বজায় রাখা। বিভাজনের রাজনীতির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত বিভাগের অনিবার্য ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগ হয়। এটা হয়েছে উপনিবেশী ব্রিটিশ শাসক এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীদের দ্বারা। বিশেষ করে ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশের আরোপিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা জমিদারি প্রথার মাধ্যমে সৃষ্ট কলকাতা ভিত্তিক হিন্দু জমিদার শ্রেণী যারা ভদ্রলোকশ্রেণী হিসেবেই পরিচিত ছিল, তারাই এই বিভাজনে মূল ইন্ধন যুগিয়েছে।

বেশ ক’জন খ্যাতিমান মুসলিম রাজনীতিবিদ ও বেঙ্গল মুসলিম লীগ নেতা, যেমন পশ্চিমবঙ্গের আবুল হাশিম এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বেঙ্গল কংগ্রেসের শরৎচন্দ্র বসু (নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসুর বড়ভাই) এবং কিরণ শংকর রায়ের মতো নেতাদের সাথে মিলে চেষ্টা করেছিলেন বাংলা প্রদেশটিকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন রাখতে। কিন্তু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের হাইকমান্ড, বিশেষ করে জওহরলাল নেহেরু ও বল্লভভাই প্যাটেল এবং হিন্দু মহাসভা বিভাজনে বদ্ধপরিকর থাকায় ঐক্য প্রচেষ্টাটি নস্যাৎ হয়ে গেল। বেঙ্গল কংগ্রেস স্বাধীন হিসেবে হোক অথবা ভারত বা পাকিস্তানের অধীনে যেকোনো পরিস্থিতিতে বাংলাকে অবিভাজিত রাখার চেষ্টার সক্রিয় বিরোধিতায় ছিল।

তবে বঙ্গ ভাগ ঠেকাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া বেঙ্গল মুসলিম লীগের সাবেক সেক্রেটারি আবুল হাশিম তার স্মৃতিচারণে লিখেছেন, ‘বাংলাকে ভাগ করতে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার যৌথ আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায় এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকাগুলোর ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছিল’ [আবুল হাশিম, ইন রেট্রোস্পেক্ট, বাংলাদেশ বুক কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, চট্টগ্রাম, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ১৫৬]।
পশ্চিমবঙ্গের একজন ইতিহাসবিদ জয়া চ্যাটার্জিও লিখেছেন, ‘কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার প্রাদেশিক শাখাগুলোর মদদে পশ্চিমবঙ্গের বিরাট সংখ্যক হিন্দু ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগ করে ভারতের অধীনে আলাদা একটি হিন্দু প্রদেশ সৃষ্টির জন্য ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালায় [জয়া চ্যাটার্জি, ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড: হিন্দু কম্যুনালিজম এ- পার্টিশন: ১৯৩২-১৯৪৫’, ক্যামব্রিজ ইউনিভাসির্টি প্রেস, নিউ দিল্লি, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ২২৭]।

চল্লিশের দশকে কলকাতায় সক্রিয় তরুণ মুসলিম লীগ কর্মী শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন, তিনিও বিশ্বাস করতেন মুসলিম লীগ নেতা জিন্নাহর সাথে সর্বশেষ ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব এবং কংগ্রেস নেতা নেহরুর প্রতি ক্রমাগত পক্ষপাতিত্ব বিশেষ করে পূর্ব বাংলা এবং সামগ্রিকভাবে পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থ মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন হয়েছিল। মাউন্টব্যাটেনের পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হওয়ার উচ্চাশাকে জিন্নাহ প্রত্যাখ্যান করায় শেখ মুজিব লিখেছেন, “পাকিস্তানের ক্ষতি করার প্রচেষ্টায় মাউন্টব্যাটেন এক পায়ে খাড়া ছিলেন।” তিনি লিখেছেন, “গোপনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের স্বার্থ রক্ষার জন্য মাউন্টব্যাটেন সর্বোতভাবে চেষ্টা চালিয়েছেন। যদিও সীমানা নির্ধারণের দায়িত্ব রেডক্লিফ এর ছিল; অনেকেই এটা বিশ্বাস করেন যে, মাউন্টব্যাটেন গোপনে কংগ্রেসের সাথে কাজ করে তাদের নিজস্ব একটা ম্যাপ তৈরিতে ভূমিকা রাখেন। আমার দ্বিধা হয়, লর্ড মাউন্টব্যাটেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হলে হয়ত তিনি পাকিস্তানের এত বেশি ক্ষতি করতেন না” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী – শেখ মুজিবুর রহমান)।

অবশেষে ১৯৪৭ এর ১৪ ও ১৫ আগস্টে কম্যুনাল লাইন অনুযায়ী ভারত বিভাগের সাথে বঙ্গ প্রদেশটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গ এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গ রাজধানী কলকাতা সহ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বাস করতেন, জিন্নাহর উপর অসন্তুষ্টি থেকে মাউন্টব্যাটেন শুধু ভারতকে কলকাতার অধিকার দিয়ে ক্ষান্ত হননি বরং পূর্ববঙ্গকে কয়েকটি নিশ্চিত মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল থেকেও বঞ্চিত করেছেন। “নদীয়া মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হওয়া স্বত্বেও তিনি কৃষ্ণনগর এবং রানাঘাট জংশন পশ্চিমবঙ্গের (ভারতের) অধিভুক্ত করেন। একইভাবে হিন্দুদের চেয়ে মুসলমানের সংখ্যা বেশি হওয়া স^ত্বেও পুরো মুর্শিদাবাদ জেলা তিনি ভারতকে দিয়ে দেন। মালদহে হিন্দু ও মুসলমানের সংখ্যা সমান সমান হওয়ায় তিনি এই জেলাকে আধাআধি ভাগ করেন। কিন্তু দিনাজপুর মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তিনি বালুরঘাটকে দুই ভাগে ভাগ করেন যাতে, জলপাইগুড়ি এবং দার্জিলিং ভারতের সাথে যেতে পারে এবং দেশের বাকি অংশের সাথে আসামের (উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহ) একটা সরাসরি লিংক হয়। এই সবকয়টা জেলা পাকিস্তানের অধিকারে আসা উচিত ছিল। পূর্ববঙ্গে রেফারেন্ডাম পাকিস্তানের পক্ষে গেলেও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ করিমগঞ্জের উপ-বিভাগ ভারতে চলে গেল [অসমাপ্ত আত্মজীবনী – শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ৮৩]।

অখ- বাংলা কি আর সম্ভব ?
বাংলাকে নিজেদের স্বার্থে ভাগ করে দেওয়া পশ্চিমবঙ্গ হিন্দু নেতাদের উত্তরসূরী অনেকেই এখন আবার অখ- বাংলার স্বপ্ন দেখেন। আমাদের দেশের কিছু বুদ্ধিজীবি ও সাংস্কৃতিক কর্মীও এদের সাথে সুর মিলিয়ে মাঝে মাঝে দুই বাংলার সীমানা প্রাচীর তুলে দেয়ার দাবী জানান। এদের দাবী অনুযায়ী অখ- বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামকে ভারত থেকে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশের কাছে আসতে হবে। ঐতিহাসিক নানা ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এটা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তি ১৯৭২ সালে ২১ শে ফেব্রুয়ারি উদযাপনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে শেখ মুজিবের সাথে দেখা করতে অন্নদা শংকর রায়ের নেতৃত্বে বুদ্ধিজীবিদের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসেন। তাদের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা সতেরো কোটি বাঙালি একজোট হলে কিনা করতে পারি, ভারত জয় করতে পারি’। শেখ মুজিবের জনৈক সহযোগী আরও খোলাখুলিভাবে বলেন, আপনারা ভারতের অধীন রয়েছেন কেন? আমাদের সাথে মিশে গেলে স্বাধীন হবেন। ’ জবাবে কলকাতার বুদ্ধিজীবী দলের নেতা (এক সময়ের ঢাকার বিক্রমপুরের সন্তান অন্নদা শংকর রায়) বলেন, ‘আমরা আপনাদের মত শুধুমাত্র বাঙালি নই, আমরা সেই সাথে ভারতীয়’ (অন্নদা শংকর রায়, ‘একুশে ফেব্রুয়ারী, ওদের আমাদেরও’ আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪)। মোদ্দা কথা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা হিন্দু আইডেন্টিটি বাদ দিয়ে বাংলাদেশের কাছে ফিরে আসতে রাজি নয়। তাছাড়া অখ- বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার অর্থ দুই বাংলা মিলে হিন্দুদের সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়া, আর দুনিয়ার কেউ মাইনরিটি হতে চায় না।

এখন সময় এগিয়ে যাওয়ার:
ভারতীয় উপমহাদেশের তিনটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের মধ্যে আয়তন, ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও সম্পদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ হওয়া সত্বেও বাংলাদেশ অনেক সামাজিক সূচকে ভারত এবং পাকিস্তান থেকে বেশ এগিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের সব অঞ্চলের মধ্যেই উন্নয়নের দিক থেকে একটা সমতা রয়েছে। আমাদের রয়েছে নিজস্ব সমুদ্র বন্দর, একক ভাষা, ধর্মীয় দিক থেকে রয়েছে সম-মানসিকতা, আছে উন্নয়নের দিক থেকে অঞ্চলভিত্তিক সমতা। সমস্যার জায়গাটা হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতার কারণে নিজের ভাইকে, দেশের মানুষকে শত্রু মনে করছি আর শত্রুকে বন্ধুর আসনে বসাচ্ছি। ক্ষমতার স্বার্থে সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির দেশবিরোধী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছি। আমাদের এখান থেকে বের হতে হবে।

একটা রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সমুদ্র বন্দর থাকা, আমাদের দুটি সমুদ্র বন্দর রয়েছে- আরো একটি নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে। আমরা দেখেছি সাম্প্রতিককালে নেপাল কিভাবে সমুদ্র বন্দর না থাকার কারণে সমস্যায় নিপতিত হয়েছে, তারপরও নেপালীরা অখ- ভারতের পক্ষে স্লোগান দিচ্ছে না, বরং সাময়িক কষ্টকে স্বীকার করে নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে চাচ্ছে। একটা রাষ্ট্রের একক ভাষা থাকাটা রাষ্ট্রের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের প্রতেবেশী ভারত কিংবা পাকিস্তানের একক কোনো ভাষা নেই, ফলে তাদেরকে লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা বা সার্বজনিন ভাষার আশ্রয় নিতে হয়। ভারতের বড় ভাষাগুলোর মধ্যে রয়েছে মারাঠি, গুজরাটি, বাংলা, হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবি, তেলেগু, তামিল, মালায়লাম, উদিয়া, কান্নাডা সহ আরো বেশ কিছু ভাষা। ফলে হিন্দিকে কমন ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। হিন্দিকে উত্তর ভারতীয়রা মেনে নিলেও দক্ষিণ ভারতীয়রা গ্রহণ করতে নারাজ। ভারতের মোট জনসংখ্যা ১৩০ কোটি যার মধ্যে প্রায় ৩০ কোটি লোকেরা মাতৃভাষা হিন্দি, বাকিদের আলাদা মাতৃভাষা রয়েছে।

পাকিস্তানের ক্ষেত্রে উর্দুকে লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা বা সার্বজনিন ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পাকিস্তানে মাত্র ৮% লোকের মাতৃভাষা উর্দু। পাকিস্তানের জনসংখ্যার মেজরিটি হচ্ছে নৃতাত্ত্বিক পাঞ্জাবি এবং তাদের মাতৃভাষা পাঞ্জাবি। এছাড়া পাঠানদের ভাষা হচ্ছে পশতু, বেলুচদের ভাষা বেলুচি, সিন্ধির ভাষা সিন্ধ এবং আজাদ কাশ্মীরের ভাষা কাশ্মিরি। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলি এবং বিহারীদের বাদ দিলে সবার মাতৃভাষাই বাংলা। ফলে অন্য কোনো ভাষাকে লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা হিসেবে ব্যবহার করার দরকার নাই। একই ভাষা থাকার কারণে সরকারের নানা বার্তা, স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরী সহ নানা উন্নয়ন কর্মকা-ে মানুষের কাছে খুব সহজেই পৌঁছা যায়।

ধর্মীয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষ ভারত-পাকিস্তানের তুলনায় অনেক সহনশীল। এখানে ভারতের মত হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয় না কিংবা পাকিস্তানের মত শিয়া-সুন্নি বিরোধ নাই। বাংলাদেশের ৯০% মানুষই একই ধর্মের অনুসারী অর্থাৎ মুসলিম, অধিকাংশই সুন্নি এবং হানাফি মাজহাবের অনুসারী। এখানে বিরোধের জায়গা নেই বললেই চলে। ভাষা এবং বিশ্বাস দুই জায়গাতেই বাংলাদেশের মানুষগুলো সম-মানসিকতার। এমনকি নৃ-তাত্ত্বিক দিক থেকেও বাংলাদেশীরা একই নৃ-তাত্ত্বিক ধারা, প্রায় সবাই অনার্য জনগোষ্ঠির লোক। বাংলাদেশে আর্যরা প্রবেশ করতে পারেনি। অন্যদিকে ভারতে নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে উত্তর ভারত এবং দক্ষিণ ভারতের মধ্যে আর্য এবং দ্রাবিড়ীয় দ্বন্দ্ব রয়েছে।

বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক বিরোধ বাদ দিলে এখানে আর কোনো বিরোধের অস্তিত্ব নাই। ভারতে যেমন কিছু অঞ্চল অনেক সমৃদ্ধ আবার অধিকাংশ জায়গায় মানুষ চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে, নিজেদের স্বাস্থ্যসম্মত পয়োনিষ্কাশণ (টয়লেট) ব্যবস্থা পর্যন্ত নেই। বাংলাদেশের সব অঞ্চলের মধ্যেই উন্নয়নের দিক থেকে একটা সমতা রয়েছে। ভূ-প্রাকৃতিক দিক থেকেও সমগ্র দেশ একই, সমগ্র দেশই চাষাবাদের উপযোগী, উর্বর পলিমাটির দেশ বাংলাদেশ।

আঞ্চলিক সম্প্রসারণবাদ এবং আন্তর্জাতিক সা¤্রাজ্যবাদ মোকাবেলায় যে বুদ্ধিমত্তা প্রয়োজন- সেটা বুদ্ধিজীবি এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে গড়ে উঠলেই বাংলাদেশীরা দুনিয়ার বুকে মুসলিম বিশ্বের একটা শক্তিশালী সদস্য হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। ৪৭’র মুসলিম আইডেন্টিটি, ৭১’র বাঙালি আইডেন্টিটিকে ধারণ করে দুয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমে জাতীয় আইডেন্টিটি তৈরি এবং সা¤্রাজ্যবাদ মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ থাকলে বাংলাদেশের উন্নয়ন কেউ ঠেকাতে পারবে না, ইনশাআল্লাহ।

Print Friendly, PDF & Email