আবাসিক চরিত্র হারাচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

downloadসাভার, দেশনিউজ.নেট: ১৯৭৩ সালের প্রণীত অধ্যাদেশ অনুযায়ী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) একটি স্বায়ত্বশাসিত উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একমাত্র আবাসিক ক্যাম্পাস। জাবি অধ্যাদেশের ৪০ ধারায় বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থী আবাসিক হলে অবস্থান করবে। বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের বিশেষ অনুমোদন ছাড়া কোনো শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের বাইরে থাকতে পারবে না।

জাবির হলগুলোয় সিট বণ্টনের ক্ষেত্রে এ অধ্যাদেশের নিয়ম লঙ্ঘন করাই যেন বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। এর দায় প্রশাসনের বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। হলের সিটের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করা, হলগুলোয় হল প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ না থাকা ও আসন বণ্টনে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ— এ সমস্যার মূল কারণ বলে মনে করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ হলের ৫টিতে ৪৪৯ শিক্ষার্থীর আসন খালি ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মোট ১ হাজার ৯৯০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করে। এ হিসাবে হলের খালি আসন সংখ্যার পাঁচ গুণ শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে।

বেগম খালেদা জিয়া হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক শামীমা সুলতানা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রথম বর্ষের ১৩৫ জনের মধ্যে ৬৩ জনকে বেগম সুফিয়া কামাল হলে নিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। এর পরও হলের সিট সংকট কমবে না। তবে সেশনজট, ছাত্রদের হলগুলোয় সিট বণ্টনে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও পুরনো শিক্ষার্থীদের হলে থাকার কারণে মূলত এ সমস্যা সৃষ্টি হয়। তবে এসব সমস্যার দিকে নজর দেয়া এবং আগামীতে শিক্ষার্থী কম ভর্তি করানো হলে সংকট কিছুটা দূর হবে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে আল বেরুনী হলে ১৫০ জন, মওলানা ভাসানীতে ১৬৫, আ ফ ম কামাল উদ্দিনে ২০০, শহীদ রফিক জব্বারে ১৪০, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে ১৫০, নওয়াব ফয়জুন্নেসায় ১২৬, বেগম খালেদা জিয়ায় ১৩৫ ও শেখ হাসিনায় ১৬১ জনকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অথচ বরাদ্দ দেয়ার আগে এসব হলে নতুন শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো সিট খালি নেই বলে প্রাধ্যক্ষরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অবগত করেছিলেন। কিন্তু এসব সমস্যা বিবেচনায় না নিয়ে হলগুলোয় নতুন শিক্ষার্থীদের সিট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

এদিকে জাহানারা ইমাম হলে ৯৩ জনের আসন ফাঁকা থাকার কথা জানানো হয়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাদ্দ দিয়েছেন ১৩৬ জনকে। একইভাবে শহীদ সালাম বরকতে ১৩৯ জনের বিপরীতে ১৪৯, ফজিলাতুন্নেসায় ৫৩ জনের বিপরীতে ৩০, মীর মশাররফ হোসেনে ১০৪ জনের বিপরীতে ১৯০ জন এবং প্রীতিলতায় ৬০ জনের বিপরীতে ১৫৫ জন শিক্ষার্থীকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্মিত সুফিয়া কামাল হলে ১৩০ জনকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অথচ ওই হলের নির্মাণকাজ ও আসবাবপত্র তৈরি না করে বরাদ্দ দেয়ায় বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক জানান, বিশ্ববিদ্যালয়টি যেহেতু আবাসিক, তাই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হলে থাকা বাধ্যতামূলক। হলের আসন সংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই শিক্ষার্থী ভর্তি করতে হবে। অথচ আবাসনের ব্যবস্থা না করে অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন বিভাগ খোলা, হলগুলোয় সিটের অনুপাতে শিক্ষার্থী ভর্তি না করা, পোষ্যদের হলে অবস্থান, সিট বণ্টনে হল কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ না থাকা, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য, শিক্ষা কার্যক্রমে গতিশীলতা না থাকা, যথাসময়ে বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষ সমাপ্ত না হওয়াসহ সেশন জটের কারণে এ সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় ও হলের বাইরে কী পরিমাণ শিক্ষার্থী অবস্থান করছেন এবং বৈধ ও অবৈধ শিক্ষার্থী আছেন, সে বিষয়ে হল প্রশাসনের কাছে সঠিক পরিসংখ্যান নেই বলেও জানা গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের একজনের কক্ষে দুজন, দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের দুজনের কক্ষে ছয় ও চারজনের কক্ষে সাত থেকে আটজনকে থাকতে হচ্ছে। তবে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের অবস্থা আরো ভয়াবহ। বরাদ্দ অনুযায়ী একটি কক্ষের মেঝেতে বিশেষ করে কমন রুম, টিভি রুম ও হলের ছাত্রসংসদে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে তাদের। সেখানে নেই শিক্ষার পরিবেশ। এছাড়া ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের অনুগত কর্মীদের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের অভিযোগও আছে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. আবুল হোসেনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

শেখ হাসিনা হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ বলেন, সেশনজটসহ বিভিন্ন কারণে সিট সংকট আছে। তবে আমার হলে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে নবনির্মিত সুফিয়া কামাল হলে ১০৩ জনকে নিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। তার পরও ৪১ ব্যাচ তার শিক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন না করা পর্যন্ত এ সংকট কমবে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ভর্তি পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ও ডেপুটি (শিক্ষা) রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ আলী বলেন, হলগুলোর আসনের সঙ্গে নয়, বরং বিভাগের শ্রেণীকক্ষের আসনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়ে থাকে। এ কারণেই হলের সিট সংকট কমছে না।

Print Friendly, PDF & Email