• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

গার্মেন্টে ১৬ ধাপে দুর্নীতিঃ টিআইবি

TIBনিজস্ব প্রতিবেদকঃ দেশের পোশাক খাতে তিনটি পর্যায়ে ১৬টি ধাপে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয় বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সংস্থাটি বলছে এই অনিয়ম-দুর্নীতিতে
বিদেশি ক্রেতারাও জড়িত। প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানিয়েছেন, অতি মুনাফার জন্য অনেক ক্রেতাই দেশের গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের অনিয়ম করতে উৎসাহিত করছে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, কার্যাদেশ পাওয়া থেকে শুরু করে উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায় পর্যন্ত এ দুর্নীতি হয়। এর সঙ্গে জড়িত থাকেন কারখানার মালিক, মার্চেন্ডাইজার ও বিদেশি ক্রেতারা।
২০১৪ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে এই গবেষণা করা হয়েছে বলে জানায় টিআইবি। গতকাল সংস্থার কার্যালয়ে ‘তৈরী পোশাক খাতের সাপ্লাই চেইনের অনিয়ম ও দুর্নীতি মোকাবিলায় অংশীজনের করণীয়’ শীর্ষক প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন শাহজাদা এম আকরাম, নাজমুল হুদা মিনা ও নীনা শামসুন্নাহার। এ সময় উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপ-নির্বাহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। টিআইবি বলছে, তৈরী পোশাক খাতের সরবরাহ ব্যবস্থার বিভিন্ন ধাপে অনিয়ম ও দুর্নীতি কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছে। উৎপাদন কারখানা, ক্রেতা, নিরীক্ষকসহ অংশীজনের মাঝে দুর্নীতির চর্চা বিদ্যমান। এসব দুর্নীতি কখনও জোরপূর্বক আবার কখনও বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সমঝোতামূলক। এ ছাড়া শ্রম ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত আইন লঙ্ঘন পরিবীক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের উপরি দিলেই নিয়ম ভঙ্গের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়। পণ্যের মান, পরিমাণ ও কমপ্লায়েন্সের ঘাটতি ধামাচাপা দেয়া হয় ঘুষের মাধ্যমে। সুশাসন ও জবাবদিহিতাহীন এই ধরনের পরিবেশে সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য চাঁদাবাজি কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয় বলে টিআইবি গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।
টিআইবির গবেষণায় যে ১৬ ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে কার্যাদেশ পর্যায়ে চার ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়। এগুলো হলো- ক্রেতার নির্ধারিত কমপ্লায়েন্স চাহিদা সম্পর্কে সন্তোষজনক প্রতিবেদন পাওয়ার অভিপ্রায়ে কমপ্লায়েন্স নিরীক্ষককে ঘুষ দেয়া; কার্যাদেশ পাওয়ার জন্য ছোট আকারের কারখানা কর্তৃপক্ষের মার্চেন্ডাইজারকে ঘুষ দেয়া; কারখানার পক্ষ থেকে নকল কাগজপত্র তৈরি করা অথবা বিভিন্ন কাগজপত্র প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন করা এবং কারখানার মালিক বা সরবরাহকারী কর্তৃক ঘুষের বিনিময়ে ক্রেতা বা এর এজেন্টের ক্রয়ের সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করা, যাতে ওই কারখানার পছন্দ অনুযায়ী কার্যাদেশ পাওয়া যায়।
টিআইবি বলছে, উৎপাদন পর্যায়ে ৯ ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়। এগুলো হলো- নির্দিষ্ট এক্সেসরিজ কারখানা থেকে তৈরী পোশাক কারখানার উপকরণ কেনার জন্য মার্চেন্ডাইজারের পক্ষ থেকে বাধ্য করা; প্রয়োজনের তুলনায় কারখানার বেশি উপকরণ আমদানি এবং বাড়তি উপকরণ খোলা বাজারে বিক্রি করা; কারখানার পক্ষ থেকে অবৈধভাবে ব্যাক টু ব্যাক এলসি ভাঙানো; ন্যূনতম মজুরি, কর্মঘণ্টা এবং শ্রমিক অধিকার-সংক্রান্ত আইন লঙ্ঘন; ক্রেতাদের পক্ষ থেকে চুক্তিবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন চাহিদা পূরণে কারখানাকে বাধ্য করা; আবার কারখানাগুলো চুক্তিবহির্ভূতভাবে সাব-কন্ট্রাক্ট দেয়া; নিরীক্ষককে তাদের প্রাপ্ত তথ্য গোপন করার জন্য কারখানা মালিকদের ঘুষ দেয়া; ক্রেতাদের ইচ্ছেমতো কার্যাদেশ বাতিল করা এবং ক্রেতাদের পরিদর্শন কিংবা কমপ্লায়েন্স প্রতিবেদন পরিবর্তন করা।
সরবরাহ পর্যায়ে তিন ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়। এগুলো হলো- মানের ঘাটতি ও নিম্নমানের পণ্যের বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার জন্য কারখানার পক্ষ থেকে মান নিয়ন্ত্রককে ঘুষ দেয়া; কারখানার কাছে মান পরিদর্শকের নিয়মবহির্ভূত অর্থ দাবি এবং গন্তব্য দেশের বন্দর পরিদর্শনের সময় ন্যূনতম মূল্য প্রদানের উদ্দেশ্যে ক্রেতার মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সাপ্লাই চেইনের পুরো প্রক্রিয়ায় প্রায় সব অংশীজনই সুশাসনের ঘাটতি থেকে উত্তরণে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে শৈথিল্য প্রদর্শন করছেন। এ খাতে ৬০ শতাংশ অগ্রগতি হলেও তা বাড়াতে সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে। অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে কিছু পদক্ষেপ নিলে তৈরী পোশাক খাতের অগ্রগতি আরও বাড়বে। ৬০ শতাংশ অগ্রগতির ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ২০১৩ সালে এক গবেষণায় এ খাতের ৬৩টি বিষয়ে সুশাসনের ঘাটতি চিহ্নিত করা হয়েছিল। সেসব বিষয়ে সরকার, মালিক ও ক্রেতাদের নেয়া ১০২টি উদ্যোগের ফলে সার্বিক এই অগ্রগতি হয়েছে। গবেষণায় গুণগত তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি ব্যবহার করায় পরিসংখ্যানগত কোনো অনিয়মের তথ্য দেয়া যাচ্ছে না বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, অনিয়মের সঙ্গে কমবেশি সবাই জড়িত। এককভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের দায়ী করা ঠিক হবে না। বায়ার, এজেন্ট, যারা এ খাতে সংশ্লিষ্ট, তাদের দায় এড়ানো যাবে না। বিদেশি ক্রেতা, বায়িং হাউজ, কারখানার মালিক, শ্রমিক, কমপ্লায়েন্স নিরীক্ষকসহ ৭০টি অংশীজন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে গবেষণার তথ্য উপাত্ত নেয়া হয়।
তৈরী পোশাক খাতের সাপ্লাই চেইনে দুর্নীতি মোকাবিলায় বায়ার, বিজিএমইএ, সরকার, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের উদ্দেশ্যে টিআইবি ১৩ দফা তাৎক্ষণিক করণীয় ও ১৪ দফা কাঠামোগত সুপারিশ উত্থাপন করে। তাৎক্ষণিক সুপারিশগুলো হলো- দুর্নীতি হলে বিষয়টি বিজিএমইএ’কে অবগত করে ‘সালিশ সেল’ কর্তৃক বিষয়টি সুরাহা করার পাশাপাশি তদারকি ক্ষমতাসম্পন্ন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্তির জন্য জানানো, বায়ার কর্তৃক পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই আকস্মিক কারখানা নিরীক্ষণ/পরিদর্শন করা, প্রয়োজনে বায়ার কার্যাদেশ বাতিল এবং কারখানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইত্যাদি।
কাঠামোগত সুপারিশগুলো হলো- বায়ারদের সঙ্গে সমন্বিতভাবে একটি অনুসরণযোগ্য ‘মডেল চুক্তিপত্র’ তৈরি করা যেখানে পুরো প্রক্রিয়া দেয়া থাকবে; চুক্তি করার সময় কারখানার সকল নিয়ম ও শর্ত পরিষ্কারভাবে নির্দেশিত চুক্তিপত্রে প্রদর্শন করা, বিজিএমই ও বায়ার-এর যৌথ উদ্যোগে বায়ারদের কমপ্লায়েন্স চাহিদা মেনে চলে এমন কারখানার একটি সমন্বিত তালিকা তৈরি করা ও তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা, বিজিএমইএ কর্তৃক সংশোধিত শ্রম আইন ও এর প্রয়োগ সম্পর্কে সদস্যদের তথ্য ও প্রশিক্ষণ দেয়া, সনদপ্রাপ্ত তৃতীয় পক্ষ নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি ও প্রকাশ করা।
এ ছাড়া অপরাপর সুপারিশসমূহের মধ্যে বায়ার/ভোক্তা কর্তৃক অনৈতিক, অসাধু ও অন্যায্য আচরণ সংক্রান্ত অভিযোগ দেয়ার জন্য সহজে ও বিনামূল্যে প্রবেশযোগ্য সতর্কীকরণ হটলাইন স্থাপন করা, সরকারিভাবে সকল কারখানার জন্য এমন একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যেখানে প্রত্যেক কারখানার জন্য আলাদা শনাক্তকারী নম্বর থাকবে যেন তথ্যের কোনো ধরনের কারসাজি, নকল করা অথবা সংশোধন করা না যায়, কারখানার ন্যূনতম মজুরি সময়মতো পরিশোধ নিশ্চিত করার জন্য সরকারি উদ্যোগে তদারকি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

Print Friendly, PDF & Email