পশ্চিমা সহায়তা বন্ধ হলে এক মাসের মধ্যে সিরিয়ায় জঙ্গি নির্মূলঃ আসাদ

Asadনিইজ ডেস্কঃ সিরিয়ায় জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) বিরোধী অভিযান পরিচালনায় গত ২ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্য সরকারকে অনুমোদন দেয় দেশটির পার্লামেন্ট। একইদিন সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সাক্ষাৎকার নেয় যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সানডে টাইমস।
এতে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও রাশিয়ার আইএসবিরোধী অভিযানের মূল্যায়নসহ তার দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, সন্ত্রাস দমনে সরকারের অবস্থান ও আইএসসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন।

গত ৬ ডিসেম্বর সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করে সানডে টাইমস। বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্ব মঙ্গলবার (০৮ ডিসেম্বর) প্রকাশ হলো। সাক্ষাৎকারের পরবর্তী পর্বগুলোও পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করবে বাংলানিউজ। অনুবাদ করেছেন বাংলানিউজের নিউজরুম এডিটর রাজিউল হাসান।

প্রশ্ন: সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বলেছেন, সিরীয় সরকার চাইলে আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিদ্রোহীদের সহায়তা করতে পারে। তবে সিরীয় প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও লড়াইরত এই বিদ্রোহীদের যদি বাশারের ওপর আস্থা না থাকে এবং তারা যদি মনে করে সংকট নিরসনের পরও বাশার ক্ষমতা ছাড়বেন না, তাহলে এ প্রক্রিয়া কঠিন হয়ে যাবে।

কেরি আরও বলেছেন, বাশারের ক্ষমতা ছাড়াটাও আলোচনার বিষয়। তিনি যদি ক্ষমতা ছাড়তে নাও চান, তাহলেও তাকে তা ছাড়তে হবে।
প্রশ্নটা হলো, আপনি কি ২০২১ সাল পর্যন্ত আপনার মেয়াদ পূর্ণ করবেন, নাকি এই সময়ের আগেই আপনি কোনো গণভোট বা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কথা ভাবছেন? আর যদি, তাই হয়, তাহলে কবে নাগাদ আপনি নির্বাচনের কথা ভাবছেন? কোন বিষয়টা নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাড়িত করতে পারে এবং যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ই, তাহলে কি আপনি সে নির্বাচনেও প্রার্থী হবেন?

বাশার আল-আসাদ: প্রশ্নের ধরনের ওপর উত্তর নির্ভর করে। যদি সিরীয় সংকট নিরসনের কথা আপনি বলতে চান, তাহলে আগাম নির্বাচন এতে কোনো ভূমিকাই রাখবে না। এটা শুধুমাত্র সম্ভব হতে পারে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং তাদের প্রতি পশ্চিমা ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সহায়তা বন্ধ হলে। আগাম নির্বাচনের বিষয়টা চূড়ান্ত হতে পারে শুধুমাত্র সিরিয়ার রাজনৈতিক শক্তি ও সুশিল সমাজের চাওয়ার ও তাদের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে।

কাজেই এটা প্রেসিডেন্টের ইচ্ছাধীন কোনো বিষয় নয়। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সিরিয়ার জনগণের ইচ্ছায়। এটা সম্পূর্ণই একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। যদি প্রক্রিয়াটির ব্যাপারে সবাই একমত হয়, তাহলেই শুধুমাত্র আমি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারি। যাই হোক, এ বিষয়ে কথা বলার সময় এখনও আসেনি, কারণ আপনি জানেন, নির্বাচনের বিষয়ে এখনও কেউ সম্মত হননি।

প্রশ্ন: আপনার কি মনে হয়, আইএসের বিরুদ্ধে যৌথবাহিনীর এই অভিযান সফল হবে?

বাশার আল-আসাদ: এক বছর ধরে যৌথবাহিনী বিমান হামলা চালাচ্ছে, তাতে কি এখনও সফলতা এসেছে? আসেনি। আমেরিকানরা আফগানিস্তানে বিমান হামলা চালিয়ে কোনো সফলতা অর্জন করতে পেরেছে? পারেনি। ২০০৩ সাল থেকে যে তারা ইরাকে অভিযান পরিচালনা করছে, তাতে কি কোনো সফলতা এসেছে? আসেনি। শুধুমাত্র বিমান হামলা পরিচালনা করে আপনি আইএসকে নির্মূল করতে পারবেন না। আপনাকে স্থল বাহিনীর সহায়তাও লাগবে। সেই সঙ্গে জনগণ ও সরকারকে অভিযানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কাজেই পশ্চিমাদের এই বিমান হামলা কোনো কাজেই আসবে না। তারা আবারও বিফল হতে চলেছে। বাস্তবতাই এর প্রমাণ দেবে।

প্রশ্ন: যদি যৌথবাহিনী সিরীয় সেনা বা স্থানীয় বাহিনীর সঙ্গে স্থলে কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করে, তাহলে আপনার পরবর্তী পরিকল্পনা কি? আমি বোঝাতে চাইছি, যা কিছু ঘটছে, তা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে নিশ্চয়ই আপনার কোনো বিকল্প পরিকল্পনা রয়েছে? এই সংঘাত নিরসনে আপনার পরিকল্পনা কি?

বাশার আল-আসাদ: যৌথবাহিনী অলীক একটা বিষয়। এটা সম্পূর্ণই ভার্চুয়াল, কারণ সিরিয়ার ভূখণ্ডে এই বাহিনী সন্ত্রাস নির্মূলের লড়াইয়ে কোনো সাফল্যই অর্জন করতে পারেনি। যেহেতু কোনো অলীক বস্তুরই অস্তিত্ব নেই, কাজেই এর ‘আগে-পরে’ নিয়ে আলোচনা না করাই উত্তম। শুরু থেকে আমরাই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়ছি।

যদি কেউ এ লড়াইয়ে সামিল হতে চায়, তাকে স্বাগত জানাবো আমরা। কেউ আমাদের সঙ্গে যোগ না দিলেও এ লড়াই চালিয়ে যাবো। এটাই আমাদের একমাত্র পরিকল্পনা এবং এতে কোনো পরিবর্তন আনা হবে না।

প্রশ্ন: তাহলে কি আপনি পশ্চিমারাসহ বিশ্বশক্তিগুলোকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সিরীয় সরকার ও তার সেনাবাহিনীর পাশে এসে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছেন?
বাশার আল-আসাদ: আমরা খুবই বাস্তববাদী। আমরা জানি, তারা এ ধরনের কোনো কাজ করবে না এবং তাদের এ ধরনের কোনো ইচ্ছেও নেই। আমি যেভাবে বলছি, সেটাই হলো আন্তর্জাতিক আইনানুসারে বৈধ উপায়। আপনি কি বলতে চান, পশ্চিমারা আন্তর্জাতিক আইন পড়েনি? সার্বভৌম দেশ সম্পর্কে জাতিসংঘ সনদে কি লেখা আছে, তা তাদের অজানা? আসলে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি তাদের কোনো সম্মানই নেই এবং আমরা তাদের সহায়তাও কামনা করছি না।

প্রশ্ন: কিন্তু বিষয়টা যদি বৈধপন্থায় হয়, তাহলে কি আপনি তাদের আহ্বান জানাবেন?

বাশার আল-আসাদ: যদি তারা প্রস্তুত থাকে, সন্ত্রাস দমনে কারোর ঐকান্তিক ও অকৃত্রিম ইচ্ছে থাকে, তাহলে আমরা যেকোনো দেশের যেকোনো সরকারকেই স্বাগত জানাবো। এই ক্ষেত্রে আমরা কট্টর নই, আমরা বাস্তববাদী। দিন শেষে আমরা সিরিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে দেখতে চাই। আমরা চাই না, এখানে আর কোনো রক্তপাত হোক। এটাই আমাদের লক্ষ্য। কাজেই এক্ষেত্রে ভালোবাসা বা ঘৃণার কিংবা নেওয়া, না নেওয়ার প্রশ্ন নেই। পশ্চিমারা কি সন্ত্রাস মোকাবেলায় প্রস্তুত? তাহলে তারা সর্বপ্রথম তাদের প্রতিনিধি সরকারের দেশগুলো থেকে সিরীয় ভূখণ্ডে সন্ত্রাসের অনুপ্রবেশ বন্ধ করুক। তারা যদি এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত থাকে, আমরা তাদের স্বাগত জানাবো। এটা ব্যক্তিগত কোনো সংঘাত নয়।

প্রশ্ন: সিরিয়ায় আপনি ও আপনার মিত্ররা (রাশিয়া, ইরান, হিজবুল্লা ও অন্যান্য মিত্র) আইএসকে পরাজিত করতে পারবেন? যদি তাই হয়, তাহলে তা কতোদিনের মধ্যে সম্ভব?

বাশার আল-আসাদ: এই প্রশ্নের উত্তর দু’টি বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে- এক, আমাদের সামর্থ; দুই, সন্ত্রাসীরা যে সহায়তা পাচ্ছে, সেটি। আমাদের দিক থেকে বলতে গেলে, আঞ্চলিক ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর পক্ষ থেকে জঙ্গিদের কাছে যদি সহায়তা আসা বন্ধ হয়, তাহলে এক মাসের মধ্যে তাদের নির্মূল করতে পারবো আমরা। এটা কোনো জটিল হিসাবের বিষয় নয়। একদম সহজ ও সরল। কিন্তু এই শক্তিগুলোর কাছ থেকে প্রতিনিয়ত সহায়তা পাচ্ছে জঙ্গিরা। ফলে প্রতিমুহূর্তে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে। কাজেই বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই লক্ষ্য অর্জনে আমাদের অনেক সময় ও মূল্য দিতে হবে, বিশেষ করে সিরিয়ার জনগণকে।

প্রশ্ন: কিন্তু এরই মধ্যে তো চরম মূল্য দিতে হয়েছে। চলমান সংঘাতে এ পর্যন্ত দুই লাখেরও বেশি মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে।

বাশার আল-আসাদ: আপনি ঠিক বলেছেন। আমি পশ্চিমাদের যে সহায়তার কথা বলছিলাম, এটা তারই ফল।

প্রশ্ন: কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, এই বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানীর পেছনে সিরীয় সরকার ও তার বাহিনীর দায়টাই সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে বেশ কিছু এলাকায় সিরীয় সেনাদের হাতে অনেক মানুষের প্রাণ গেছে। আপনি কিভাবে এ বিষয়টি মূল্যায়ন করবেন?

বাশার আল-আসাদ: প্রথমত, সব যুদ্ধই খারাপ। যুদ্ধে এমন কোনো কিছু থাকে না, যাকে আপনি ভালো বলতে পারেন। প্রতিটা যুদ্ধেই বিপুল সংখ্যক নিরপরাধ মানুষকে হতাহত হতে হয়। এটা এড়ানোর একটাই পথ, যুদ্ধের অবসান। পশ্চিমারা অনেক দিন থেকেই আমাদের নামে অভিযোগ করে আসছে, আমাদের হাতে সিরিয়ার সাধারণ জনগণের প্রাণ যাচ্ছে। কিন্তু তারা সত্যটা বলছে না। তারা বলছে না, সন্ত্রাসীরা সিরিয়ার মানুষকে মারছে। আর আমরা সেই সন্ত্রাস নির্মূলের লড়াইয়ে আছি। সিরিয়ার সরকার সন্ত্রাস দমনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এর কোনো বিকল্প নেই। যে জঙ্গিরা সাধারণ মানুষকে হত্যা করছে, আমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই থামিয়ে দিতে পারি না।

প্রশ্ন: এবার আমরা রাশিয়ার ভূমিকা নিয়ে কথা বলি। সিরিয়ায় জঙ্গি দমনে পুতিন যে অভিযান শুরু করেছেন, তার ভূমিকা কতোটুকু? রাশিয়া যদি হস্তক্ষেপ না করতো, তাহলে কি এতোদিনে সিরিয়ার পতন হয়ে যেতো?

বাশার আল-আসাদ: রাশিয়ার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সিরিয়ার রাজনৈতিক ও সামরিক অঙ্গনে রুশ অভিযান অত্যন্ত প্রভাব ফেলেছে। তবে মস্কো এই অভিযান শুরু না করলে সিরিয়ার পতন হয়ে যেতো, এমন মন্তব্য করা সত্যিকার অর্থেই কল্পনার জগতে বাস করার সামিল। সিরিয়া সংকটের সূচনা লগ্ন থেকেই সরকার পতন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রথমে বলা হলো, কয়েক দিনের মধ্যেই সরকার পতন ঘটবে। তারপর মাস গেল, বছর গেল। তারপরও সবাই কামনা করতে থাকলো, সিরীয় সরকারের পতন ঘটুক। তবে হ্যা, জঙ্গি মোকাবেলায় শুরু থেকে রাশিয়া ও ইরানের সহায়তা বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে।

প্রশ্ন: আপনি ঠিক কোনটা বোঝাতে চাইছেন? রাশিয়া পূর্বে যে সমর্থন দিয়েছে সেটা, নাকি বর্তমান অভিযান?
বাশার আল-আসাদ: আমি পুরোটার কথা বলছি। এটা শুধুমাত্র অংশগ্রহণের বিষয় নয়। শুরু থেকে রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক, সব বিষয়ে তাদের সমর্থন ছিল।

Print Friendly, PDF & Email