ইইউ বিচ্ছেদে অভিবাসী বাংলাদেশীরা চাপে পড়বে : প্রভাব পড়বে বাংলাদেশেও

1466790112_p-15কূটনৈতিক সংবাদদাতা : ইউরোপীয় জোটের ৪৩ বছরের বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল ব্রিটেন। ইইউতে থাকা না থাকা নিয়ে দীর্ঘ ২ বছরের টানাপোড়েনের সমাপ্তি ঘটে ২৩ জুন অনুষ্ঠিত গণভোটের ফলাফলের মাধ্যমে। ইউরোপের দুঃখ এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর শঙ্কা আর পদত্যাগের ঘোষণার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় ইংল্যান্ডের বর্তমান ভাগ্য।

তবে এ ভোটের ফলাফল নিয়ে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতরাও নানা হিসেব-নিকেশের মধ্যে রয়েছে। বিশ্ববাজার তো বটেই, ব্রিটেনের ইইউ ত্যাগে বাংলাদেশে প্রভাব কেমন পড়বে তা নিয়েও বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন রয়েছে। রয়েছে শঙ্কাও। বাংলাদেশ বরাবরই ব্রিটেনের ইউরোপীয় জোটে থাকার পক্ষে ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কিছুদিন আগে জি-৭ আউটরিচ সম্মেলনে জাপানের ইসে-সিমায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে বৈঠকে ব্রিটেনের ইইউতে থাকার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। গণভোটের আগে জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রবাসী বাংলাদেশীদের জোটের পক্ষে থাকার আহ্বান জানাতে ইংল্যান্ড ছুটে যান।

একই অবস্থানে ছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তিন এমপি টিউলিপ সিদ্দিক, রুশনারা আলী ও রূপা হকও। এমনকি লন্ডনের মেয়র সাদিক খানও ছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে। এ বিষয়ে তাদের অভিমত ছিল, আলাদা হলে ব্রিটেনের অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ আসবে। কর্মসংস্থান কমে যাবে, ফলে বাড়বে বেকারত্ব, যার প্রভাব প্রবাসীদের ওপরই পড়বে বেশি। অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যর মতে, সামগ্রিকভাবে ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য উপকারী নয়। বাণিজ্যিক দিক থেকে ইতোপূর্বে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেসব সুযোগ-সুবিধা দিত তা ব্রিটেন আলাদাভাবে দেবে কি না সেটি ব্রিটেনকে স্পষ্ট করতে হবে। আমার ধারণা, ব্রিটেন সেটা দেবে।

দ্বিতীয়ত, ব্রিটেনের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের যেসব পণ্য ইউরোপের অন্যান্য দেশের বাজারে যেত সেগুলোর ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। কারণ পরিবহন ও বীমাসংক্রান্ত নানাবিধ ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। তৃতীয়ত, পাউন্ডের দর পতন হয়েছে। ইউরোর দামও কিছুটা নেমে যাবে। এটা আমাদের বাণিজ্য সক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলবে। তিনি বলেন, আগে আমরা ইউরো বা পাউন্ড থেকে যে পরিমাণ টাকা পেতাম এখন তার চেয়ে কম টাকা পাব। এতে সব দেশেরই অর্থনীতি প্রভাবিত হবে। ড. দেবপ্রিয় বলেন, আরেকটি বিষয় নিয়ে আমি নিশ্চিত না যে ব্রিটেনের আলাদা হয়ে যাওয়ার ফলে ওই দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বৃদ্ধি হবে কি না। অনেকে বলছেন, যেহেতু ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে অভিবাসন কমে যাবে, সেহেতু স্বল্পোন্নত দেশের শ্রমিকদের ব্রিটেনে যাওয়ার সুযোগ বাড়বে। কিন্তু এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই, কারণ যে মনোভাবের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তটি ব্রিটিশ জনগণ নিল তা সেই সম্ভাবনার কথা বলে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইইউ থেকে ব্রিটেন বেরিয়ে গেলে বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ (ইবিএ) সুবিধার মাধ্যমে বাংলাদেশ এতদিন ইইউ’র বাজারে শুল্ক ও কোটামুক্ত পণ্য রফতানি করলেও এখন ব্রিটেনের বাজারে তা পারবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও খরচ বৃদ্ধি এবং সুবিধা হ্রাসের ফলে বাংলাদেশ থেকে ব্রিটেনে উচ্চশিক্ষায় অনাগ্রহ দেখা দেবে। আশঙ্কা আছে, ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে ব্রিটেনকে অর্থনৈতিকভাবে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে, যার আঘাত ব্রিটেনে থাকা বাংলাদেশিদের ওপরও লাগবে। এছাড়া নিরাপত্তার প্রশ্নটিও বড় হয়ে দেখা দেবে। দেশটিতে সম্প্রতি সন্ত্রাসীর হামলায় এক মহিলা এমপি নিহত হওয়ার পর অভিবাসীবিরোধী মন্তব্যও জোরালো হয়েছে। ব্রিটেনে অভিবাসী প্রবেশের বিরোধিতায় উগ্রপন্থীদের অবস্থান আরও শক্ত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশিদের যুক্তরাজ্যে যাওয়া যেমন কঠিন হতে পারে, ব্রিটেনে প্রবাসী বাঙালিদেরও থাকতে হতে পারে চাপের মুখে। এছাড়া, অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে যেসব বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ হবে, তাতে অবৈধ অভিবাসীদের ভাগ্য আরও জটিল রূপ নিতে পারে।

এছাড়া ব্রিটেনের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের পদত্যাগের ঘোষণায় দেশটির রাজনৈতিক সমীকরণেও পরিবর্তন আসছে। তিন মাস পর নতুন যে ক্ষমতায় আসবেন, তার মনোভাব ও আদর্শের উপরও বৈধ কিংবা অবৈধ প্রবাসী বাঙালিদের নির্ভর করতে হবে। আবার কূটনৈতিক দিক থেকে, মানবাধিকারসহ অন্যান্য রাজনৈতিক ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে মিল রেখে ব্রিটেনও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণ করে আসছিল। এখন পৃথক হওয়ায় ব্রিটেনকে এ বিষয়ে নতুন করে দিক নির্দেশনা ঠিক করতে হবে।

সাহায্যকারী দেশ হিসেবে ব্রিটেন বাংলাদেশের পুরোনো বন্ধু। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কী ধরনের মনোভাব দেখাবে সেটিও স্পষ্ট নয়। যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজেটে এতদিন ব্রিটেন অবদান রাখলেও এখন এই অবদান আর রাখবে না। ফলে বাংলাদেশের ওপর সাহায্যের ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়তেই পারে। ইইউ থেকে ব্রিটেন বেরিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদেরা। ইইউ ছিন্ন একক ব্রিটেনে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে দু’পক্ষকেই হয়তো নতুন করে হিসেব মেলাতে হবে। যুক্তরাজ্যের এমপি রুশনারা আলী মনে করছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেন বের হয়ে যাওয়ার ফলে চাকরি হারাতে হবে প্রায় পাঁচ লাখ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতের। ব্রিটেনের সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি এমন মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে বাংলাদেশিসহ এথনিক মাইনোরিটির লোকজন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

Print Friendly, PDF & Email