বিএনপি দলটিই পাকিস্তানপ্রেমী, বললেন বিচারপতি শামসুদ্দিন

manik-2নিজস্ব প্রতিবেদকঃ যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকরের পর প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিএনপির ‘চেহারা’ স্পষ্ট হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াকে ‘উন্মাদনা’ হিসাবে আখ্যায়িত করে বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “তাদের উন্মাদনার ফলে দুটি জিনিস প্রমাণিত হয়েছে। প্রথমত পৃথিবীতে সিভিলাইজড জাতি হিসাবে থাকার অধিকার তাদের নাই। দ্বিতীয়ত তারা প্রমাণ করেছে, এদেশে তাদের দোসর কারা এবং সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিএনপি নামক দলটি পাকিস্তানপ্রেমী।”

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গতমাসে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মো. মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর এক বিবৃতিতে উদ্বেগের কথা জানায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
যুদ্ধাপরাধের এই বিচারকে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ আখ্যায়িত করে এ নিয়ে ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়ার’ কথা বলা হয় ওই বিবৃতিতে।

অন্যদিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি বলেছে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন তাদের নেতা।

যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায়ের প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আইনের লংঘন করেছে মন্তব্য করে শামসুদ্দিন চৌধুরী কমনওয়েলথ ও সার্ক থেকে দেশটিকে বহিষ্কারের দাবি তোলার আহ্বান জানান।

বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী “পাকিস্তান নির্লজ্জের মতো আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী প্রতিটি দেশ তার আইনে বিচার করবে। কিন্তু পাকিস্তান উন্মাদের মতো যে বক্তব্য দিয়েছে তা সেই আইনের লঙ্ঘন।”
পল্টনের মুক্তিভবনের প্রগতি সম্মেলন কক্ষে ‘আমাদের আইন’ নামক সংগঠন আয়োজিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন শামসুদ্দিন চৌধুরী।

তিনি বলেন, “এখন কাজ হচ্ছে, তারা যে বক্তব্য দিয়েছে তার জন্য জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ ও সার্কে বিচার আনা। কারণ কমনওয়েলথ ও সার্কের ঘোষণায় রয়েছে প্রতিটি দেশের সার্বভৌমত্ব থাকবে এবং কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা যাবে না।”

১৯৭২ সালে সিমলা চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানে ফেরত যাওয়া ১৯৫জন যুদ্ধাপরাধী সেনা সদস্যের বিচার শুরুর দাবি জানান এই বিচারপতি।

“চুক্তিতে ছিল-পাকিস্তান তাদের বিচার করবে, কিন্তু তারা সেই চুক্তি ভঙ্গ করেছে। পাকিস্তানের কাছে আমরা দাবি করছি- তাদেরকে এদেশে ফেরত দেওয়া হোক, এই বাংলার মাটিতে আমরা তাদের বিচার করব।”

জিয়াউর রহমান ও খন্দকার মোশতাককে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ‘মূল পরিকল্পনা ও নকশাকারী’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, “স্বাধীনতা উত্তরকালে মানবাধিকার লংঘনের যে ঘটনা জাতিকে কলঙ্কিত করে রেখেছে সেটা হচ্ছে, জাতির পিতাকে হত্যা। সরাসরি জড়িত কয়েকজন সেনা সদস্যের শাস্তি আমরা দিতে পেরেছি। তবে কয়েকজন পালিয়ে থাকায় তাদের শাস্তি দিতে পারিনি।

“তার চেয়ে বড় কথা- এই ঘটনার নীল নকশাকারী জিয়াউর রহমান ও মোশতাকের বিচার আমরা করতে পারিনি, কারণ বিচারের আগেই তারা এই পৃথিবী ছেড়ে পালিয়ে গেছে। তারা যে মূল পরিকল্পনাকারী ছিল সেটা ওই বিচারের সময় সাক্ষ্যপ্রমাণে পাওয়া গেছে।”

বক্তব্যে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে ‘বড় মানবাধিকার লংঘনকারী’ আখ্যায়িত করে শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, “শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িতই নয়, তার হাত ছিল রক্তে রঞ্জিত। হাই কোর্ট বলেছে, সে কর্নেল তাহেরকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছে। তার সময়ে কয়েকশ মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে।”

‘জিয়ার প্রতিষ্ঠিত বিএনপির নেতাকর্মীরা মানবাধিকার লংঘনের ধারা অব্যাহত রেখেছে’ মন্তব্য করে এ প্রসঙ্গে ২০০১ সালের নির্বাচনের পরে কয়েকশ মানুষকে হত্যা এবং গত দুই বছরে সরকারবিরোধী আন্দোলনে পেট্রোল বোমায় মানুষের প্রাণহানির কথা বলেন তিনি।

শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, “জিয়া-মোশতাক বাহাত্তরের সংবিধানটি একেবারে তছনছ করে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর প্রথম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শুরু হয় তাদের হাত ধরেই।”

একাত্তরে বাংলাদেশে সংঘটিত মানবাধিকার লংঘন বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা বলে মন্তব্য করেন এই বিচারপতি।

তিনি বলেন, “এই মানবাধিকার লংঘনকারীদের বিচারের পর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল কোনো প্রশংসা না করে বিরোধিতা করেছে। প্রশংসার বদলে আমরা পেলাম তিরস্কার।

“কারণ একাত্তরের মানবতাবরোধী অপরাধীরা পর্বত সমান সম্পদের মালিক। সেখান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে তারা বিদেশে অনেক লোককে লবিস্ট হিসেবে নিয়োগ করেছে।”

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের কারণে এই বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে দীর্ঘদিন লেগেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানাতে চেয়েছিলেন। পঁচাত্তর পরবর্তী ঘটনা থেকে এটা ধারণা করা হয়, তিনি পাকিস্তানের চর হিসাবে যুদ্ধের সময় এদেশে এসেছিলেন। তার বন্দুক থেকে একটিও গুলি ফোটেনি।

“তাই তার শাসনামলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের তো প্রশ্নই আসে না। বরং তার বদৌলতে স্বাধীনতাবিরোধীরা সম্পদের পাহাড় গড়তে পেরেছিল।”

স্বাধীনতাবিরোধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার দাবি জানিয়ে বিচারপতি শামসুদ্দিন বলেন, “সাকা-মীর কাসেম আলীর অবৈধ সম্পদ পরিবারের সদস্যরা ভোগ করবে, তা হতে পারে না। বরং তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে যারা একাত্তর সালে ভুক্তভোগী হয়েছিল তাদের মধ্যে তাদের সম্পদ বিতরণ করা হোক।”

‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ কোনো রাজনৈতিক স্লোগান নয় মন্তব্য করে বিচারপতি শামসুদ্দিন বলেন, “জয় বাংলা স্লোগানের ভিত্তিতে আমরা নয় মাস যুদ্ধ করেছি। কিন্তু জিয়াউর রহমান জয়বাংলা স্লোগানকে খুন করেছে। যারা জয়বাংলাকে রাজনৈতিক স্লোগান মনে করে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না।”

কওমী মাদ্রাসাগুলোতে ভুল ইতিহাস শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তাদের ওপর আমাদের কোনো হাত নাই। তারা জাতীয় পতাকা ব্যবহার করে না, মুক্তিযুদ্ধের ভুল ইতিহাস শিক্ষা দেয়। তাদেরকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। শিশুদেরকে যেন ভুল শিক্ষা দেওয়া না হয় সেজন্য রাষ্ট্রকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।”

নারী-শিশু-সংখ্যালঘু নির্যাতনকারীদের কঠোর হস্তে দমন করার আহ্বান জানান এই বিচারপতি।

অনুষ্ঠানের প্রধান আলোচক সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান বলেন, “কোনো অধিকারই নিরঙ্কুশ নয়, অধিকার চাইলে দায়িত্বও পালন করতে হবে। অধিকার ও দায়িত্বের সঙ্গে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। তাই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে আয়োজক সংগঠন ‘আমাদের আইন’র উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট ফরিদ খান, নির্বাহী পরিচালক শাহাদাত হোসেন ভূঁইয়া ও সাধারণ সম্পাদক শওকত ওসমান, আইনজীবী সাইফুল বারী বক্তব্য দেন।

Print Friendly, PDF & Email