• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

অপরাধ গুরুতর: তবু হাসপাতালে ‘ভিআইপি’ বন্দিদের বিলাসী জীবন

1নিজস্ব প্রতিবেদক: তারা একাধিক মামলার আসামি। কারও বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ, কেউবা ইয়াবা সম্রাট, আবার কেউ দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। কিন্তু তারা জেলাখানার পরিচিত বন্দি জীবনে আবদ্ধ নন। হাসপাতালের বিলাসবহুল কেবিনে তাদের দিন কাটছে বেশ আরাম-আয়েশে। তিন বেলা বাসাবাড়ি থেকে আনা হরেক রকমের পছন্দের খাবারের সঙ্গে আরও পাচ্ছেন এসি, টিভি, ফ্রিজ ও মোবাইল ফোন ব্যবহারের বাড়তি সুবিধাও।

একশ্রেণীর অসাধু কারা কর্মকর্তা ও চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগসাজশে তারা মাসের পর মাস হাসপাতালেই বাস করছেন। সেখানেই আত্মীয়-পরিজন, শুভানুধ্যায়ী ও সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে অনেকটা রাজকীয় স্টাইলে জীবন কাটছে তাদের।
পাঁচ বন্দির রাজকীয় জীবন : বারডেম হাসপাতালের ৬০১ নম্বর কেবিন। কেবিনটি অনেকটা বিলাসবহুল হোটেল স্যুটের মতো। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই কেবিনে রয়েছে টিভি ও ফ্রিজসহ আধুনিক আসবাবপত্র। সুপরিসর এই কেবিনটি বারডেম হাসপাতালের ভিআইপি কেবিন হিসেবে পরিচিত। প্রায় দু’মাস ধরে এই কেবিনে আছেন বহুল আলোচিত এমএলএম (মাল্টিলেভেল মার্কেটিং) কোম্পানি ডেসটিনি’র কর্ণধার রফিকুল আমিন। শনিবার কেবিনের সামনে গিয়ে দেখা যায়, কেবিন লাগোয়া ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছেন একজন কারারক্ষী ও তিনজন পুলিশ সদস্য। তাদের সঙ্গে স্যুট পরে বসে আছেন এক যুবক। দরজা ঠেলে ড্রইংরুমে ঢুকতেই তিনি এ প্রতিবেদকের পরিচয় জানতে চান। সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পর তিনি বসতে বললেন। ভেতরে তখন অবস্থান করছেন রফিকুল আমিনের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) বিশ্বজিৎ। ড্রইংরুমে অপরিচিত লোকের কণ্ঠস্বর পেয়ে মূল কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন বিশ্বজিৎ। তিনি প্রতিবেদকের পরিচয় জানার জন্য ভিজিটিং কার্ড চাইলেন। এরপর ভিজিটিং কার্ডটি নিয়ে তিনি রফিকুল আমিনকে দিয়ে এলেন। বললেন, স্যার এখন ঘুমাচ্ছেন। আপনারা পরে আসেন। কিন্তু তার কথা শেষ না হতেই কেবিনের দরজায় এসে দাঁড়ালেন স্বয়ং রফিকুল আমিন নিজেই। এ সময় তার পরনে ছিল পরিচ্ছন্ন পোশাক। সাদার ওপর হালকা গোলাপি স্ট্রাইপের জামা-পাজামা। রফিকুল আমিন হ্যান্ডশেক করার জন্য প্রতিবেদকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। কী অসুখে ভুগছেন জানতে চাইলে রফিকুল আমিন বলেন, নানান রোগ আছে। ডায়াবেটিস, বুকে ব্যথা, চর্মরোগ ইত্যাদি। সব মিলিয়ে শরীরের অবস্থা ভালো নয়। এরপর হাসিমুখে বিদায় দিয়ে তিনি ভেতরে চলে গেলেন। কেবিনের দরজার স্বল্প ফাঁক দিয়ে দেখা গেল ভেতরে পরিপাটি বিছানাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা আসবাবপত্র বেশ সাজানো গোছানো।

বারডেম হাসপাতালের রেকর্ডবুকে লেখা রয়েছে, রফিকুল আমিন ডায়াবেটিস, হাইপার টেনসন ও থ্যালাসেমিয়ায় ভুগছেন। তিনি মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রাজিউর রহমানের অধীনে চিকিৎসাধীন। রফিকুল আমিনের রোগ ও শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. রাজিউর রহমান বলেন, ‘আদালতের আদেশ নিয়ে তিনি (রফিকুল আমিন) চিকিৎসাধীন। তাই তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া গণমাধ্যমের কাছে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারবেন না।’

আদালত সূত্র জানায়, ডেসটিনি’র চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ ও এমডি রফিকুল আমিনের বিরুদ্ধে ৪ হাজার ১১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও ৯৬ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে দুদক তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়। ২০১২ সালের ৩১ জুলাই রাজধানীর কলাবাগান থানায় মামলা করে দুদক।

বারডেম হাসপাতালের ৮০১ নম্বর কেবিনে ভর্তি আছেন আরেক বন্দি ইয়াবা সম্রাট আমিন হুদা। এই কেবিনটিও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভিআইপি কেবিন। আমিন হুদার বন্দি জীবনের প্রায় পুরো সময় হাসপাতালেই কাটছে। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হলে তাকে কারাগারে ফিরিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু সপ্তাহ পার না হতেই তিনি আবার হাসপাতালে চলে আসেন। বারডেম হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের আওতায় চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। বুকে ব্যথার কথা বলে তিনি গত বছর ২৬ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হন।

তার শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চাইলে কার্ডিওলজি বিভাগের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বলেন, ‘দয়া করে আমার নাম লিখবেন না। রোগী হিসেবে আমিন হুদা ভর্তি হয়েছেন। চিকিৎসক হিসেবে আমার কর্তব্য তাকে চিকিৎসা দেয়া।’ তিনি জানান, আমিন হুদা চর্মরোগ, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা রোগে আক্রান্ত।

আদালত সূত্র জানায়, ২০০৭ সালের ২৫ অক্টোবর গুলশান থেকে আমিন হুদা ও তার সহযোগী আহসানুল হক হাসানকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তার বাসা থেকে ইয়াবা তৈরির মেশিন উদ্ধার করা হয়। এছাড়া ৪২ ধরনের বিদেশী মদ, পাঁচ কেজি ইয়াবা ট্যাবলেটসহ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা, ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল ও রাসায়নিক যন্ত্রপাতি এবং ভিওআইপি সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। গুলশান থানায় মাদকদ্রব্য আইনে দুটি মামলায় তিনি গ্রেফতার হন। ওই মামলায় ২০১২ সালের ১৫ জুলাই আমিন হুদা ও তার সহযোগী আহসানুল হককে ৭৯ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। একই সঙ্গে দু’জনকে ৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

কিন্তু গুরুতর এমন অপরাধ করেও বাস্তবিক অর্থে জেলখানার বন্দি জীবন তাকে ছুঁতে পারছে না। তিনি বছরের পর বছর হাসপাতালের ভিআইপি কেবিনে একরকম রাজকীয় জীবনযাপন করছেন।

এদিকে রাজধানীর দিলকুশা এলাকার সানমুন টাওয়ার দুর্নীতি মামলার আসামি মিজানুর রহমানের দিন কাটছে মিটফোর্ড হাসপাতালের বিলাসবহুল কেবিনে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের রেকর্ড বুক থেকে জানা যায়, বুকে ব্যথার কথা বলে মিজানুর রহমান গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন। এরপর প্রায় এক বছর ধরে তিনি হাসপাতালেই আছেন। মিজানুর রহমান বসবাস করছেন মিটফোর্ড হাসপাতালের ১০ তলায় ৩ নম্বর ভিআইপি কেবিনে। তবে তিনি এখানে ভর্তি আছেন হাসপাতালের নাক-কান-গলা বিভাগে। তার চিকিৎসক বিভাগীয় প্রধান ডা. মনিলাল আইচ।

শনিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মিটফোর্ড হাসপাতালের কেবিন ফ্লোরটি অন্য হাসপাতাল থেকে একেবারেই ভিন্ন। কারণ এ হাসপাতালের কেবিন ফ্লোরে ঢোকার কোনো সিঁড়ি নেই। বিশেষ ভাবে নিয়ন্ত্রিত লিফট ব্যবহার করে কেবিন ফ্লোরে ঢুকতে হয়। হাসপাতাল থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এই কেবিন ফ্লোরে গিয়ে দেখা যায়, চারজন পুলিশ ও দু’জন কারারক্ষী মিজানুর রহমানের কেবিনের অনেকটা দূরে একটা ফাঁকা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন। খোলা জানালা দিয়ে আসা রোদ পোহাচ্ছেন তাদের কয়েকজন। মিজানুর রহমানের ৩ নম্বর কেবিনের সামনে গিয়ে দেখা যায়, কক্ষটি ভেতর থেকে বন্ধ। কক্ষের দরজার কাছে নতুন পাপোশ পাতা। এক জোড়া নতুন স্যান্ডেল এক পাশে গুছিয়ে রাখা। মিজানুর রহমানের অসুস্থতার বিষয়ে জানতে চাইলে চিকিৎসক মনিলাল আইচ শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘তিনি আসলে নানা ধরনের শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। তার কার্ডিয়াক সমস্যা আছে। এছাড়া অ্যাজমা ও চর্মরোগেও তিনি আক্রান্ত।’

দুদক সূত্র জানায়, রাজধানীর দিলকুশায় ৮২৭ কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি দখলের অভিযোগে ২০১২ সালের ২৯ মার্চ তার বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।

এদিকে আন্ডারওয়ার্ল্ডে যিনি এক নামেই পরিচিত, যার নামের সঙ্গে আর বিশেষ কোনো বিশেষণ বা শব্দ যুক্ত করতে হয় না, তিনি হলেন ‘জোসেফ’। পুরো নাম তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ। এক সময় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে তিনি ছিলেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী। কারাগারের সাক্ষাৎ পান বয়স যখন ২০। যখন জেলে যান তখন তার বিরুদ্ধে ছিল খুন ও সন্ত্রাসের ২৯টি মামলা। মৃত্যুদণ্ডের সাজা মাথায় নিয়ে জেলে আছেন ১৭ বছর। তবে বিচারাধীন মামলায় গত ৯ ডিসেম্বর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ তার মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ফিড্রম পার্টির নেতা মোস্তাফিজুর রহমান হত্যা মামলায় তিনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। ১৯৯৬ সালের ৭ মে মোস্তাফিজুর রহমানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সময় জোসেফ ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন।

বর্তমানে একটি বাদে সবগুলো মামলায় খালাস পেয়েছেন তিনি। এখন সেই জোসেফ আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর অসুস্থতার কথা বলে কেন্দ্রীয় কারাগারের বাইরে বেরিয়ে আসেন তিনি। কেন্দ্রীয় কারাগারের রেকর্ডে তার অসুখ ‘পিঠে ব্যথা’। জোসেফের শারীরিক অবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রশান্ত মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, হাসপাতালের প্রিজন সেলের বন্দিদের বিষয়ে কোনো তথ্য তার জানা নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে জানতে গেলে অযথা বিতর্ক তৈরি হয়। তাই তিনি প্রিজন সেলের তথ্য নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামান না।’

ওদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগী সেজে ভর্তি আছেন নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর ৭ খুন মামলার অন্যতম আসামি তারেক সাঈদ মোহাম্মদ। যিনি র‌্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে অপহরণপূর্বক হত্যার অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হন। এরপর তার চাকরি চলে যায়।

এই তারেক সাঈদ ৩ জানুয়ারি নিু রক্তচাপের কথা বলে কেন্দ্রীয় কারাগারের বাইরে চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ পান। ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজের নিউরো সার্জারি বিভাগে। এই বিভাগে তিনি এখন তার ছোট ভাইয়ের অধীনে চিকিৎসাধীন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনে আছেন তিনি। ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন ব্যবহারসহ বিলাসবহুল জীবনযাপনে কোনো কিছুই কমতি নেই তার। কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, তারেক সাঈদ মোহাম্মদ জেলখানায় প্রথম শ্রেণীর মর্যাদাপ্রাপ্ত (ডিভিশন) বন্দি। প্রসঙ্গত, তিনি সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর জামাতা।

এদিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্র জানায়, ৩০ জানুয়ারি শনিবার পর্যন্ত মোট ৩৬ জন বন্দি চিকিৎসার জন্য রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এরমধ্যে উল্লিখিত বন্দিরা ছাড়াও রয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কয়েকজন নেতা। আরও আছেন বিডিআর বিদ্রোহ মামলার ক’জন আসামি।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার নেছার আলম শনিবার বলেন, অনেক বন্দি অসুস্থতার কথা বলে বাইরের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আবেদন করেন। কারাবিধি অনুযায়ী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতিসাপেক্ষে তাদেরকে চিকিৎসাসংক্রান্ত প্রাপ্য সুবিধা দেয়া হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের আইনের ব্যত্যয়ের সুযোগ নেই।

Print Friendly, PDF & Email