প্রধান বিচারপতি বিরুদ্ধে সংসদে সমালোচনার ঝড়

00001নিজস্ব প্রতিবেদকঃ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করলেন কয়েকজন সংসদ সদস্য। মঙ্গলবার দশম জাতীয় সংসদের নবম অধিবেশনে তাঁরা এই সমালোচনা করেন। তাঁদের মতে, অবসরে যাওয়ার পর রায় লেখার এই রীতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে। এ নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন তোলার অধিকার নেই। কেউ প্রশ্ন তুললে মানুষ মনে করে, নিশ্চয়ই কোনো অসাংবিধানিক শক্তির সঙ্গে আঁতাত করে সাংবিধানিক শক্তি এই কথা বলছে।

এর আগে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানাতে আলোচনার সূত্রপাত করেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য পিরোজপুর ২-এর সাংসদ ডা. রুস্তম আলী ফরাজী। এরপর আলোচনায় অংশ নেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সাবেক আইনমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক আবদুল মতিন খসরু। সবশেষে আলোচনায় অংশ নেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক।

আইনের ব্যাখ্যা তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের যে সংবিধান, তার কোনো আর্টিকেলে (অনুচ্ছেদ) এই কথা লেখা নাই যে বিচারপতি তাঁর অবসর গ্রহণের পর তিনি রায় লিখতে পারবেন না। সেটাই যদি হয়, তাহলে সেটা অসাংবিধানিক হতে পারে না, আর যা কিছু হোক, আনকনস্টিউশনাল (অসাংবিধানিক) নয়, আইনের ভাষায় অসাংবিধানিক নয়।’

আনিসুল হক বলেন, ‘হাইকোর্ট ডিভিশনের যে রায় মাননীয় বিচারপতিরা লেখেন সেটা যতদূর সম্ভব, এজলাসে বসেই দেওয়ার কথা। কিন্তু যদি এমন হয়, মামলাজটের কারণে রায়টা তাঁরা শেষ করতে পারছেন না, তাহলে এজলাসের বাইরে রায় লেখার অধিকার তাঁরা রাখেন।’

আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আপিল বিভাগেও এ কথা লেখা নাই, রায় দিতে হবে এজলাসে। আপিল বিভাগে পরিষ্কার করে লেখা আছে রায় দিতে হবে কোর্টে, সেখানেও কিন্তু কোথায় লেখা নেই অবসরের পর রায় লেখা যাবে না। তাই অবসরের পর রায় লেখা অবৈধ নয়।’

প্রধান বিচারপতির উদ্দেশ্যে মন্ত্রী বলেন, ‘তিনি বিচার বিভাগের প্রধান। তাঁর কিছু সমস্যা আছে সেটা আমরাও জানি। কোনো বিচারপতি রায় অনেক দেরি করে লেখেন, যদি রায় দেরি করে লেখেন তাহলে জনগণ ভোগান্তিতে পড়ে। জনগণ চায় তাদের রায় দ্রুত হাতে পেতে। আমরাও দেখেছি রায় অনেক দেরি করে লেখা হচ্ছে। এটা যদি তিনি দূর করতে চান, তাহলে প্রধান বিচারপতি একটা প্র্যাকটিস ডাইরেকশন দিতে পারেন, সেই প্র্যাকটিস ডাইরেকশনে উল্লেখ করতে পারেন অবসরে যাওয়ার তিন মাস বা চার মাস পর বা একটা টাইম ফ্রেম দিতে পারেন, যে এর মধ্যে লিখতে হবে। এটা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু দুঃখের কথা হচ্ছে, প্রধান বিচারপতির কথা বলার পর অনেক কথাই অনেকে বলেন, আমাদের জনগণকে যাঁরা বাসের মধ্যে পেট্রলবোমা ছুড়ে মেরে ফেলেন, তাঁরা এই কথাটা লুফে নেন।

প্রধান বিচারপতির কথা লুফে নিয়ে তাঁরা বলেন, সকল কাজকর্ম যা হয়েছে রায় যা লেখা হয়েছে তা অসাংবিধানিক। আমি তাঁদের আবার সংবিধান পড়তে বলব, তাঁদের সংবিধান পড়তে হবে।

কনস্টিটিউশন ইজ নট অনলি…. হ্যাভ গট সামথিং এলস…। ইট হ্যাজ ভেরি ভেরি ক্লিয়ার। তাই আমাদের পশ্চাতে যা হয়েছে তাতে ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পশ্চাতে যাওয়া কোনোভাবেই গ্রহণ করা হবে না, সামনের দিকে যেতে যদি প্রধান বিচারপতির কোনো পরামর্শ থাকে, তাহলে আমরা সেদিকেই যাব। আমরা আর পশ্চাতে ফিরে যাব না।’

মন্ত্রী আরো বলেন, ‘আর এই বিতর্ক সৃষ্টি করার চেষ্টা করবেন না। এখন তাদের বক্তব্যের কোনো সারমর্মতা নেই। তার কারণ হচ্ছে, বিচারপতি আবার বলেছেন, পুরোনো কোনো রায় বাতিল হবে না। হি হ্যাজ মেইড ইন ভেরি ক্লিয়ার (তিনি খুব পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন)। এরপরও বিতর্ক সৃষ্টি করা মানে হলো ষড়যন্ত্র করে পানি ঘোলা করা।’

সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন,‘এই ধরনের কোনো কথা জুডিশিয়ারির হেড হিসেবে চলে আসা মানেই হচ্ছে দেশটা অস্থিতিশীল হউক।
প্রাক্তন বিরোধী দল সঙ্গে সঙ্গে লুফে নিল। তারা বলে বসল, সরকারের নাকি ভূকম্পন হয়ে গেছে। ওনারা কি ভূ কোথায় আর কম্পন কোথায় হয় জানেন?’

‘এই সংবিধান অনুয়ায়ী আমরা চলছি। উনি এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ওনারা বলা শুরু করল এই সরকার অবৈধ। এইটা নিয়ে হঠাৎ করে কথা এসেছে যখন বাংলাদেশের রাজনীতি স্থিতিশীল হয়ে উঠেছে’ এমন প্রশ্নও উত্থাপন করে সুরঞ্জিত বলেন, ‘আমরা মনে করি, সুপ্রিম কোর্টের মতো প্রতিষ্ঠানকে নির্বাহী ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। সেইখান থেকে যদি এই ধরনের একটি মন্তব্য চলে আসে যে এটি অসাংবিধানিক, এটি অবৈধ। কেউ কেউ আবার দেখছি-এটাতে সমর্থনও জোগাচ্ছেন। কারো কথায় সংবিধান অসাংবিধানিকও হয় না, সাংবিধানিকও হয় না। সুতরাং যে রেওয়াজ চলে আসছে, সে রেওয়াজ চলবে।’

সুরঞ্জিত আরো বলেন, ‘হ্যাঁ এটা ঠিক। এটা যদি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি মনে করেন এই রেওয়াজটি খারাপ। তাহলে এই রেওয়াজটি বন্ধ করে অন্য কিছু করতে চান। তাহলে তাকে (রিট্রো-রেসপেকটিভ) কিছু করা যাবে না অর্থাৎ পশ্চাতে ফিরে যাওয়া যাবে না। যেটা হয়ে গেছে। সেটা নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন তোলার অধিকার নাই। তাহলেই মানুষ মনে করবে, আপনার কোনো এজেন্ডা আছে। তখনই মানুষ মনে করে, আমরা ঘর পোড়া গরু, নিশ্চয়ই কোনো অসাংবিধানিক শক্তির সঙ্গে আঁতাত করে সাংবিধানিক শক্তি এই কথা বলছে।’

আবদুল মতিন খসরু বলেন, ‘মাননীয় প্রধান বিচারপতি একজন ব্যক্তি নয়, একটি প্রতিষ্ঠান। এটাকে সুপ্রিম কোর্টকে বিতর্কিত করা কিংবা কথা বলাও ঠিক হয়নি। কিন্তু তিনি বারবার এটি নিয়ে কথা বলেছেন। উনি হবিগঞ্জ গিয়েও একই কথা বললেন। এটা ঠিক না। উনি তো আস্থার প্রতীক। যখন যা ইচ্ছা তাই তিনি বলতে পারেন না।’

গত ১৯ জানুয়ারি দায়িত্ব এক বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বাণী দেন। এটি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। এতে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কোনো কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর দীর্ঘদিন পর্যন্ত রায় লেখা অব্যাহত রাখেন, যা আইন ও সংবিধান পরিপন্থী।’ প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্যের পর নানা আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে।

Print Friendly, PDF & Email