জিয়ার বিরুদ্ধে ক্যু সংঘটিত করেন এরশাদঃ বই থেকে তথ্য

002নিউজ ডেস্কঃ  ১৯৮১ সালের ২৯শে মে কুমিল্লার জিওসি মেজর জেনারেল আবদুস সামাদ সপরিবারে সিলেটে বেড়াতে আসেন। এর মাত্র কয়েক দিন আগে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেছেন। তিনিও সেই সময় মাজার জিয়ারত ও রাজনৈতিক সভা করতে সিলেট অবস্থান করছিলেন। সিলেটে এসে শেখ হাসিনা সার্কিট হাউসে ওঠেন। এজন্য আমরা সার্কিট হাউসের পরিবর্তে টি-গার্ডেনের একটি বাংলোতে জিওসি মেজর জেনারেল সামাদের থাকার ব্যবস্থা করলাম। ৩০ তারিখ সকালে জিওসিসহ আমরা শাহজালালের (র.) মাজারে যাই। এখানেই ওয়ারলেসের মাধ্যমে আমরা খবর পেলাম, প্রেসিডেন্ট জিয়া চট্টগ্রামে নিহত হয়েছেন। এটা শোনার পর জিওসি সামাদ খুব অস্থির হয়ে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গেই আমরা খোঁজ করে জানতে চেষ্টা করলাম। জিয়া সত্যি নিহত হয়েছেন, না অ্যারেস্ট অবস্থায় আছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা সঠিক খবর জানতে পারলাম। প্রেসিডেন্ট জিয়া সত্যি মারা গেছেন। আরও জানতে পারলাম, মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর বীর উত্তম এর সঙ্গে জড়িত। পরদিনই মেজর জেনারেল সামাদ সিলেট থেকে কুমিল্লায় চলে গেলেন।
প্রয়াত মেজর জেনারেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী ‘১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন’ শীর্ষক বইতে এসব কথা লিখেছেন। সদ্য প্রকাশিত এ বইতে তিনি আরও লিখেছেন, জিয়া অত্যন্ত সাহসী সেনানায়ক এবং কঠোর নিয়মতান্ত্রিক ও শৃঙ্খলাবদ্ধ লোক ছিলেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধে পাকিস্তানের খেমকারানে সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে পাকিস্তানের খেমকারান ভারত দখল করেছিল। তিনি খেমকারান পুনরুদ্ধার করেছিলেন। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক যুদ্ধে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছিলেন। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। সেই ঘোষণা প্রথমবার নিজের নামে দিলেও দ্বিতীয়বার তিনি বঙ্গবন্ধুর নামে দিয়েছিলেন। এর ফলে তার যে ভাবমূর্তি দেশে এবং বিদেশে গড়ে ওঠে সেটা আজও অম্লান। দেশ ও জাতির চরম বিপদের সময় তার কণ্ঠস্বরে জনগণ উজ্জীবিত হয়েছিল। এটা তার এক বিরাট অবদান। অবশ্য এ কাজটি তখন যে কেউই করতে পারতেন। কিন্তু ভাগ্যবান বলে তিনি এটা করেছিলেন। তার সেই ভরাট গলার আহ্বানে বাঙালি জাতির মধ্যে আশার আলো সঞ্চারিত হয়েছিল।
কিন্তু চাকরিজীবনে রাজনীতি বা রাজনৈতিক দর্শন চর্চার সঙ্গে জিয়া সম্পৃক্ত ছিলেন না। ফলে, রাজনীতির দায়িত্ব যখন তার কাঁধে এসে পড়ে, তখন তিনি শিখতে চেষ্টা করেন। এটা শিখতে গিয়ে তিনি ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত নানা ধরনের লোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলে যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন, তাতে বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক দর্শন ও মতবাদের সমাগম ঘটে। অন্যদিকে, ব্যক্তিগতভাবে জিয়ার দেশপ্রেম, সততা, ঐকান্তিকতা ছিল সব সন্দেহের ঊর্ধ্বে। যদিও কর্নেল তাহেরের বিচার নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তি ও ধূম্রজাল রয়েছে। কর্নেল তাহের সেনাবাহিনীর ভেতরে যেভাবে হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিলেন, সেটা ছিল এক ঘৃণ্য অপরাধ। অনেক নিরীহ মানুষকে তার বিপ্লবী সংস্থা হত্যা করেছে। নিহত কেউ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। তাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীতে দুর্নীতির কোনো অভিযোগও ছিল না। অন্যদিকে, জনগণের মধ্যে কর্নেল তাহেরের কোনো ভিত্তি ছিল না। জাসদের যে গণবাহিনী ছিল তারা বিভ্রান্তিকর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠালগ্নে জাসদের এই হঠকারী ভূমিকা গণতন্ত্রকে অনেকদূর পর্যন্ত বসিয়ে দিয়েছিল। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বলে কোনো সমাজতন্ত্র নেই। সমাজতন্ত্র, রঃংবষভ ংপরবহঃরভরপ ড়ৎমধহরুধঃরড়হ, সেটা মূলত নির্ভর করছে অর্থনীতির ওপর। এইসব স্লোগান দিয়ে তারা সামন্তবাদ উৎখাত করার একটা স্লোগান দিয়েছেন। বাংলাদেশে কখনো সামন্তবাদ প্রসারিত হয়নি। পঞ্চাশের দশকেই জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হয়েছিল।
তাহেরের কাজটি কোনো মূল্যবোধের পর্যায়ে পড়ে না। এটা কোনো ধরনের রাজনৈতিক দর্শন হতে পারে না। ১৯৭৫ সালের ৬ই নভেম্বর রাতে তার বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা স্লোগান দিয়েছে, ‘অফিসারের রক্তচাই/সুবেদারের ওপরে অফিসার নাই’। অর্থাৎ এটা প্লানটেড স্লোগান। বিদেশ থেকে আমদানি করা স্লোগান, যাতে বাংলাদেশে সেনাবাহিনী শক্ত ভিতের ওপর গড়ে ওঠতে না পারে। সেনাবাহিনী যদি গড়ে উঠতে না পারে, তাহলে যারা সুবিধাটা নেবেন, তাঁরাই এ কাজটি করিয়েছিলেন। এ কারণেই জিয়া তাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অ্যাকশনে চলে যান। সেনাবাহিনীতে ডিসিপ্লিন বরখেলাপ করে যখনই কেউ কাজ করবে, ডিসিপ্লিন ভঙ্গের যে ধারাগুলো আছে, সেটা তার ওপরই বর্তাবে। সুতরাং বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। কেউ তাকে জোর করে মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে না। শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণেই বিচার। সেটা সংক্ষিপ্ত আকারেও সেনাবাহিনী করতে পারে। কোর্ট মার্শাল যেটা হয়, সেটা বৈধ এবং আইনগতভাবে এটার বৈধতা আছে।
এরশাদ ১৯৭৪ সালে ভারত গিয়েছিলেন এনডিসি কোর্স করতে। সেখানে থাকাবস্থায় তিনি দুবার পদোন্নতি পেয়ে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে বাংলাদেশে ফেরত আসেন ১৯৭৫ সালের শেষ দিকে। ১৯৭৪ সাল থেকেই তিনি এবং তার কয়েকজন সহযোগী পাকিস্তানি স্টাইলে ক্যু করার মতলব এঁটে আসছিলেন। এজন্য খুব নীরবে তারা সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পদ দখল করছিলেন। পাকিস্তানের সেনাশাসক আইয়ুব খান ১৯৫১ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত যেভাবে নিজ বলয়ের সেনা কর্মকর্তাদের একের পর এক নানা ধরনের কোর্স বা ট্রেনিং করিয়ে সব ধরনের নিয়ন্ত্রণ পকেটগুলোতে তাদের পোস্টিং দিয়েছিলেন, তারপর ক্যু করেছিলেন, এরশাদও ঠিক একইভাবে জেনারেল জিয়াকে গুড হিউমারে রেখে তার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের সব জায়গায় তিনি তার নিজের লোকদের বসান। এরপর জিয়ার বিরুদ্ধে ক্যু সংঘটিত করেন। এই ক্যুয়ের সঙ্গে মনজুর কতটা জড়িত প্রমাণিত নয়। এরশাদ এ এক্ষেত্রে কৌশলী ভূমিকা রাখেন। আত্মসমর্পণের পর সেনা হেফাজতে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি বেশ রহস্যজনক। পরবর্তী সময়ে বিচারপতি আবদুস সাত্তার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হওয়া সত্ত্বেও তাকে অকর্মণ্য ও তার ক্যাবিনেটকে অযোগ্য ঘোষণা করে এরশাদ মার্শাল ল ঘোষণা করেন। মেজর জেনারেল মান্নাফ, মেজর জেনারেল আবদুস সামাদ, আমিসহ আরও কয়েকজন এর প্রতিবাদ করেছিলাম। তিনি তা মানেননি।

Print Friendly, PDF & Email