শিরোনাম :

  • শনিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৪

ফাঁস হওয়া একটি ফোনালাপ ও অনেক প্রশ্ন

মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস প্রকাশিত বিশ্বের ক্ষমতাধর ১০০ নারীর তালিকায় ২০২২ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম ছিল ৪২ নম্বরে। আগের বছর তিনি ছিলেন ৪৩তম। ২০০৪ সাল থেকে ফোর্বস প্রতিবছর এ তালিকা প্রকাশ করে আসছে।

পুরোনো সংবাদ ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, ফোর্বস সাময়িকীর ২০২২ সালের রিপোর্ট প্রকাশের সাত দিনের মাথায় শেখ হাসিনা রাজধানীতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় বিরোধী দলকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, ‘আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করা সহজ নয়।’ (সমকাল, ১৮ ডিসেম্বর ২০২২)

শেখ হাসিনা ঠিকই বলেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বাধীন বিনাভোটে রেকর্ড সময় গদি দখলে রাখা নিষ্ঠুর স্বৈরশাসনকে উৎখাত করা অত সহজ ছিল না। বিভিন্ন সময়ে যখনই আন্দোলন দানা বাঁধত তখনই খুন, গুম, গায়েবি মামলা, সন্ত্রাসী হামলা, নিষ্ঠুর নির্যাতনের মাধ্যমে অঙ্কুরেই নস্যাৎ করা হতো। দলীয় লাঠিয়াল বাহিনী হয়ে ওঠা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দমনপীড়নের জবাবদিহি ছিল না। ফোনালাপে আড়ি পাতা ও মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে বিরোধী রাজনীতিক ও ভিন্নমতের মানুষের গতিবিধির ওপর নজরদারি চলত। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী, এমনকি তাদের পরিবার-পরিজনকেও আতঙ্কে রেখে সরকারবিরোধী আন্দোলন ভন্ডুল করতে পেরেছিলেন বারবার।

অন্যদিকে বাংলা প্রবাদ আছে– ‘বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান/ এবার ঘুঘু তোমার বধিব পরান’। অপরাধ, অত্যাচার, অনাচার, দুঃশাসন ষোলকলায় পূর্ণ হওয়ার পর করুণ পরিণতি দেখা গেল আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতার সঙ্গে দেশও ছাড়তে হয়েছে বিশ্বের ৪২তম ক্ষমতাধর নারী শেখ হাসিনাকে। ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় অভ্যুত্থানে দল বা সরকারের কাউকে কিছু না জানিয়ে গত ৫ আগস্ট দিল্লির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করতে হয়েছে তাঁকে।

শেখ হাসিনা গত দেড় দশকে অনেকবারই বলেছেন, তিনি কীভাবে কর্মীদের কথা সবার আগে ভেবে থাকেন। যেমন নিজের কারামুক্তি দিবস উপলক্ষে ২০২২ সালেই গণভবনে আয়োজিত সভায় বলেছিলেন, ‘যতবার গ্রেপ্তার হয়েছি ততবারই নেতাকর্মীর উদ্দেশে চিঠি দিয়েছি। চিঠির মাধ্যমে নেতাকর্মীকে নির্দেশনা দিয়েছি। দেশবাসীকে চিঠি দিয়েছি। আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মী সবসময় ঠিক থাকে।’ (যুগান্তর, ১১ জুন ২০২২)

কৌতূহল জাগে, ৫ আগস্ট ঢাকা ত্যাগের সময়ও কি শেখ হাসিনা নেতাকর্মীকে চিঠি দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন? বা দিল্লিতে গিয়েও কি নেতাকর্মীকে চিঠি লিখেছেন? অবশ্য চিঠির যুগ অতীত হয়েছে। এখন মোবাইল, হোয়াটস অ্যাপ, মেসেঞ্জারের যুগ। তিনি যে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করেই কোনো কোনো নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলছেন বা নির্দেশনা দিচ্ছেন, তার প্রমাণ মিলেছে সম্প্রতি ফাঁস হওয়া একাধিক ফোনালাপে (এসব ফোনালাপের সত্যতা সমকালের পক্ষে যাচাই করে দেখা হয়নি– বিভাগীয় সম্পাদক)।

বাস্তবতা হচ্ছে, শেখ হাসিনা দেশের বাইরে নিরাপদে থাকলেও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এখন অনিরাপদ, আতঙ্কগ্রস্ত। মাথায় হুলিয়া। দলীয় প্রধানের ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার আগে-পরে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির নেতারা হয় বিদেশ পাড়ি জমিয়েছেন, নয়তো আত্মগোপনে রয়েছেন। ক্ষমতায় থাকাকালে দেশটা লুটেপুটে খাওয়া যাদের জন্য অবারিত করেছিলেন, তাদের ফোনে পাওয়া স্বাভাবিকভাবেই অত সহজ হচ্ছে না। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এক নেতার সঙ্গে ফোনে যে কথা বলেছেন, সেই অডিও ফাঁস হয়েছে।

এসব ফোনালাপ কীভাবে ফাঁস হলো, কারা কী উদ্দেশ্যে ফাঁস করল, তা নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে চলছে নানামুখী বিশ্লেষণ। তবে সবচেয়ে আলোচিত চুম্বক অংশ হচ্ছে ‘চট করে’ দেশে ঢুকে পড়ার বার্তা। আলোচ্য ফোনালাপে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের প্রতি ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেছেন মানবাধিকার, ভোটাধিকার ও ন্যায়বিচার নিয়ে সোচ্চার আমেরিকান নেতাদের বাংলাদেশ পরিস্থিতি জানিয়ে রাখতে।

শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে যুক্তরাষ্ট্র যখনই গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে তখনই তাদের এক হাত নিয়েছেন তিনি। ‘বঙ্গবন্ধুর খুনিকে আশ্রয় দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের’ বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে সমালোচনার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি একবার বলেছিলেন, ‘তাদের কাছ থেকে আমাদের আইনের শাসনের সবকও শুনতে হয়, গণতন্ত্রের কথাও শুনতে হয়, ন্যায়বিচারের কথাও শুনতে হয়, সেটিই আমার কাছে অবাক লাগে।’ (সমকাল, ২৮ ডিসেম্বর ২০২১)

ভাগ্যের পরিহাস, এখন সেই আমেরিকার নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার পরামর্শ দিতে হচ্ছে, তাদের অনুকম্পা পাওয়ার ফন্দি শেখাতে হচ্ছে শেখ হাসিনাকে!
আলোচ্য ফোনালাপে শেখ হাসিনা তাঁর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ১১৩ মামলা বিষয়েও জাতিসংঘকে জানানোর পরামর্শ দেন। অথচ ক্ষমতার ১৫ বছরে জাতিসংঘকে পাত্তা না দেওয়ার কৌশল নিয়েছিলেন। এখন সেই জাতিসংঘকেই বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা জানানোর পরামর্শ দিতে হচ্ছে!

আর চট করে দেশে ঢুকে পড়ার কথা যে রাজনৈতিক স্টান্টবাজি, তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার আছে বলে মনে হয় না। ফোনালাপে মামলায় পড়ার ভয় দেখিয়ে প্রবাসী নেতাকে যেখানে দেশে আসতে বারণ করছেন, সেখানে দেড় শতাধিক খুনের মামলা মাথায় নিয়ে তিনি নিজে দেশে চলে আসবেন বলে মনে হয় না। আকস্মিকভাবে দেশে ঢুকলেও ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের রূপ কেমন হতে পারে, তা ৫ আগস্টের অপরাহ্ণে গণভবনে খানিকটা দেখা গেছে।

হতে পারে এসব ফোনালাপ নেতাকর্মীর মনোবল বাড়ানোর কৌশল। আমার ধারণা, নেতাকর্মীকে কোনো ধরনের চিঠি, নির্দেশনা, বার্তা না দিয়ে কেবল নিজের বোনকে নিয়ে দেশত্যাগের যে গ্লানি শেখ হাসিনা বয়ে বেড়াচ্ছেন, তা থেকে বাঁচার জন্যও এমন কৌশল নিতে পারেন তিনি।

এম আবদুল্লাহ: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক; সাবেক সভাপতি, বিএফইউজে