থেমে গেল বিবেকের কণ্ঠস্বর, নিভে গেল বাতিঘর

দেশ নিউজ প্রতিবেদন ।।

তিনি ছিলেন সৎ-সত্যভাষী-সাহসী। ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, কলমযোদ্ধা, কণ্ঠযোদ্ধা।  বহুমুখি প্রতিভার সব্যসাচি ব্যক্তিত্ব। একাধারে অর্থনীতিবিদ-শিক্ষাবিদ-গবেষক। ছিলেন দক্ষ আমলা ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। এতদিন জ্বেলে গেছেন আলো। হঠাৎ ড. আকবর আলি খান নামের বাতিঘর নিভে গেল। বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর) রাত ১০টার পর রাজধানীর একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন তিনি (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর।

তাঁর ছোট ভাই কবির উদ্দিন খান সাংবাদিকদের বলেন, আকবর আলি খান বাড়িতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে দ্রুত এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন হার্ট অ্যাটাকে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তিনি জানান, রাতে আকবর আলি খানের কফিন হাসপাতালটির হিমঘরে রাখা হয়। শুক্রবার  সকাল ৯টার পর তাঁর গুলশানের বাসায় নেওয়া হয়। বাদ জুমা গুলশানের আজাদ মসজিদে জানাজা শেষে তাঁকে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হবে।

আকবর আলি খানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া মন্ত্রিসভার সদস্যসহ বিশিষ্টজন শোক জানিয়েছেন।

তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, আকবর আলি খান ছিলেন বিবেকের কণ্ঠস্বর। তিনি খুবই অবলীলায় সত্য কথাগুলো বলে যেতেন। নিষ্ঠা ও নৈতিকতারও কণ্ঠস্বর ছিলেন তিনি। সরকারি আমলা হয়েও নীতি-নৈতিকতা এবং সততার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে পথ দেখিয়ে গেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। পেশাগত জীবন ও সুনাগরিক হিসেবে তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। সাহসিকতার সঙ্গে সত্যকে উচ্চারণ করাই ছিল আকবর আলি খানের নিষ্ঠার দৃষ্টান্ত। তিনি একই সঙ্গে ছিলেন জ্ঞানপিপাসু এবং গবেষণাপ্রিয় মানুষ।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আকবর আলি খান দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন অগ্রগ্রামী সৈনিক। জাতীয় উন্নয়ন এবং নাগরিক অধিকার আদায়ে তিনি ছিলেন সক্রিয় কর্মী। তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন পণ্ডিত ও আলোকিত মানুষকে হারাল।

তাঁর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদের। এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, এক আদর্শবান মানুষ ছিলেন আকবর আলি খান। নতুন প্রজন্মের সামনে অনুকরণীয় আদর্শ রেখে গেছেন তিনি। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। যে কোনো দায়িত্বে আজীবন আপসহীন ছিলেন তিনি। প্রশাসন পরিচালনা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় তিনি ছিলেন অনন্য। তাঁর মৃত্যুতে দেশের অভিভাবক মহলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। আকবর আলি খানের মৃত্যুতে জাতি এক দেশপ্রেমিক অভিভাবক হারাল।

আকবর আলি খান ১৯৪৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে জন্ম নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। পরে কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ এবং পিএইচডি করেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি হবিগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক বা এসডিও ছিলেন। তখন পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণ শুরু হলে হবিগঞ্জ পুলিশের অস্ত্র সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং তাঁদের মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রাণিত করেন। মুজিবনগর সরকার তখনও প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় অনেক সরকারি কর্মচারীই লিখিত অনুমতি ছাড়া অস্ত্র দিতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে আকবর আলি খান নিজ হাতে লিখিত আদেশ তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র, খাদ্য ও অর্থ জোগান দেওয়ার আদেশ দেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য তহবিল তৈরি করতে ব্যাংকের ভল্ট থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকা উঠিয়ে ট্রাকে করে আগরতলায় পৌঁছে দেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য জোগান দেওয়ার জন্য গুদামঘর খুলে দেন এবং পরে আগরতলায় চলে যান। এ অপরাধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই তাঁর বিচার করে পাকিস্তান সরকার। বিচারে তাঁর ১৪ বছরের সশ্রম কারাদ হয়।

দেশ স্বাধীন হলে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং সচিবালয়ে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। তিনি সেখানে ছয় মাস চাকরি করেন এবং মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান থেকে ফেরত ব্যক্তিদের চাকরি পেতে সহায়তা করেন। পরে তাঁকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে শিক্ষকতায় যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

২০০৬ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা ছিলেন। পরে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে না- এমন শঙ্কায় তিনজন উপদেষ্টার সঙ্গে একযোগে পদত্যাগ করেন তিনি। আকবর আলি খান রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া তিনি অধ্যাপনা করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়েও।

তার প্রকাশিত মোট গ্রন্থের সংখ্যা ১৭টি। তাঁর জনপ্রিয় প্রকাশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’, ‘আজব ও জবর আজব অর্থনীতি’, ‘অবাক বাংলাদেশ : বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’, ‘বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য : একটি ঐতিহাসিক বিশ্নেষণ’, ‘দুর্ভাবনা ও ভাবনা : রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে’, ‘ডিসকভারি অব বাংলাদেশ’, ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ারস’, ‘হাম্পটি ডাম্পটি ডিসঅর্ডার অ্যান্ড আদার এসেস’, ‘গ্রেশাম’স ল সিন্ড্রম অ্যান্ড বিঅন্ড’, ‘দারিদ্র্যের অর্থনীতি : অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’, ‘চাবিকাঠির খোঁজে : নতুন আলোকে জীবনানন্দের বনলতা সেন’ ইত্যাদি। আকবর আলি খানের সর্বশেষ আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘পুরানো সেই দিনের কথা’।সর্বশেষ গত ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ মিলনায়তনে আবুল মনসুর আহমদের ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর: পাঠ ও পর্যালোচনা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন তিনি।

Print Friendly, PDF & Email