শিরোনাম :

  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪

আমাদের ওয়াজ, আমাদের ওয়ায়েজ


সৈয়দ শামছুল হুদা |♦|

মসজিদের মিম্বর থেকে আরো একটু বড় পরিসর হলো দেশের মাহফিলগুলো, যেখানে এদেশের উলামায়ে কেরাম এখনো সকল প্রকার প্রতিবন্ধকতামুক্তভাবে কথা বলতে পারছেন। মসজিদগুলোতে আলোচনার ক্ষেত্রে কিছুটা সীমাবদ্ধতা থাকলেও মাহফিলগুলোতে তা থাকছে না। লম্বা সময় নিয়ে ইচ্ছেমতো কথা বলতে পারছেন। আর সমস্যাটা বাধছে এ কারণেই। মিম্বরের আলোচনায় সময়ের সীমাবদ্ধতা থাকে। বিষয়-বস্তুর সীমাবদ্ধতা থাকে। মুসুল্লিদের মেজাজ বুঝার ব্যাপার-স্যাপার থাকে। কিন্তু মাহফিলগুলোতে তা থাকে না। ফলে এমন সব সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে যে কারণে মাহফিলগুলো নিয়ে এখন আলোচনা-সমালোচনা তুঙ্গে।

মাহফিলগুলোর প্রতি অনেক বক্তার আকর্ষণও অনেক। কারণ এখানে অর্থের ভালো একটি যোগান আসে। এজন্য সুরের চর্চাটা খুব ভালোভাবে করা হচ্ছে। উপস্থাপনার ধরণে এসেছে আকর্ষণীয় কৌশল। মাহফিলগুলো জমিয়ে তোলার সর্বশেষ আধুনিক ভার্সন হলো মিজানুর রহমান আজহারী সাহেব। তিনি মাহফিলগুলো জমাতে সুর, চেহারা, আরবী, ইংরেজি, বাংলার নান্দনিক উপস্থাপনার সর্বশেষ আকর্ষণ তুলে ধরেছেন। ফলে তার মাহফিলগুলোতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে মানুষ।

বর্তমানে কমবেশি সব বক্তারাই জনগণকে সর্বোচ্চমাত্রার শীতেও ধরে রাখতে সক্ষম। ওয়াজ শিল্পে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বক্তাদের আকর্ষণীয় পোশাক, চেহারা, সুর, গাল-গল্প বলার ধরণ এক কথায় অতুলনীয়। এক সময় দেখতাম, আল্লামা নুরুল ইসলামী ওলীপুরি দা.বা.কে মাহফিলের প্রধান আকর্ষণ হলেও তাকে চেনাই যেতো না। পোশাকের সরলতা, চলার সরলতার কারণে। এখন এ সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটেছে। এখন যে কোন বক্তাকে দেখলেই চেনা যায় তিনি একজন বক্তা। বক্তার চলার স্টাইল আলাদা, তার আগমন এবং প্রস্থানে মানুষ টের পায় কেউ এসেছেন। শত শত পুলিশ দিয়েও এখন ওয়াজ মাহফিল নিয়ন্ত্রন করা যায় না।

মাহফিলগুলোতে কৃত্রিমতা এসেছে। গ্রামে গঞ্জে এখন আর যাত্রা সিনেমা হয় না। ব্যাপক আকারে মাহফিল হয়। ব্যয় বহুল ডেকোরেশন হয়। দ্বীন শেখার এই মাহফিলগুলো এখন স্বাভাবিক সরলতা ধারণ করে না। প্রধান বক্তার জন্য মঞ্চে রাজকীয় পরিবেশ তৈরী করতে হয়। এমন একটি পরিবেশ মঞ্চে তৈরী করা হয়, তাতে বক্তা সাময়িক সময়ের জন্য হলেও নিজেকে রাষ্ট্রের কেউ কেটা মনে করতে বাধ্য হন। ফলে তার আলোচনায় এমন একটি ভাব তৈরী হয়, যাতে মনে হবে, উনি যা বলবেন দেশের মন্ত্রী, সচিব, সবাইকে সেই কথা মানতেই হবে।

আমাদের মাহফিলগুলোতে অনেক আপত্তিকর বিষয় দেখা যায়, তার মধ্যে যে সকল বিষয় কষ্ট দেয় সেগুলো হলো,

  • অনেক বক্তা শ্রেুাতাদের ধরে রাখার জন্য নানা মিথ্যা গল্প-কাহিনীর আশ্রয় নেয়।
  • অনেক বক্তা মাহফিলে অসত্য তথ্য তুলে ধরেন।
  • অনেক বক্তা কুরআন ও হাদীসের মৌলিক বিষয়গুলোর দিকে না গিয়ে নানা বানানো গল্পকে রসিয়ে কসিয়ে (ধমকিয়ে) প্রচার করেন।
  • অনেক বক্তা মাহফিলে ধমকিয়ে ওয়াজ করেন।
  • অনেক বক্তা শ্রেুাতাদের মুর্খ মনে করেন। এ কারণে মুখে যা আসে তাই বলতে থাকেন।
  • মঞ্চে এমন সব অঙ্গ-ভঙ্গি করেন যা দেখে মঞ্চে বসা অনেক ভদ্রলোক লজ্জাবোধ করেন।
  • দেশের আইন-কানুন সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা না রেখে আজগুবি কথা বলতে থাকেন।
  • “সুবহানআল্লাহ পকেটে রাইখেন, বাড়িতে গিয়ে বইলেন” এসব বলে আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা নিয়ে আপত্তিকর উক্তি করেন।
  • এক বক্তা আরেক বক্তার এসলাহের এমন সব ভাষা ব্যবহার করেন যা পুরোটাই আপত্তিজনক। নিজেই জানেন না এসলাহ কীভাবে করতে হয়, অথচ তিনি মাহফিলে বড় মুসলেহ সেজে যান, ফলে মানুষের মধ্যে খারাপ ধারণার জন্ম নেয়।
  • নিজেই আয়োজকদের বলে দেন, তার নামে শুরুতে, শেষে কী কী লকব লাগাতে হবে। নিজেকে খুব বড় করে তুলে ধরার জন্য নোংরামি করেন। ন্যাকামি করেন।
  • মাহফিলে কান্নার মিথ্যা অভিনয় করেন। ইশকে রাসুল, মা-বাবার স্মরণ, কবর ইত্যাদি বিষয়ে এমন সব মিথ্যা আবেগ সৃষ্টি করেন যা অতিরঞ্জন।
  • বিশেষভাবে নারী অধিকার নিয়ে আধুনিক বিষয়গুলোর সমালোচনা করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেন। বাস্তবতা সম্পর্কে অনেকেই ধারণা রাখেন না। এমনভাবে কথা বলেন যেটা বাস্তবতা বিরোধি। ফলে উপহাসের ক্ষেত্র তৈরী করে।
  • মাহফিলগুলোকে বিনোদনের মঞ্চে পরিণত করেন।

অথচ …

  • মাহফিলগুলো হতে পারতো দ্বীন শিখানোর উত্তম পদ্ধতি।
  • যারা মাদ্রাসায় গিয়ে দ্বীন শেখার সুযোগ পায় না, তাদের মধ্যে দ্বীনি জযবা তৈরী করার সুযোগ হতো।
  • মানুষের অন্তরে সেই ব্যথা তৈরী করা যেটা ঠিকমতো ইসলাম পালন করতে না পারার কারণে হওয়ার কথা।

মাহফিলগুলো একটি ভালো জায়গা ছিল। এই জায়গাটায় কিছু হকপন্থী মানুষের বাড়াবাড়ির কারণে এমনসব বাতেলপন্থী যোগ্যতা অর্জন করে ঢুকে গেছে যারা হকপন্থীদেরকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, এখন কে হক আর কে ভুল সেটা পার্থক্য করাই কঠিন হয়ে পড়ছে।

আমাদের মাহফিলগুলো দ্বীন শিখার মাধ্যম হয়ে উঠুক। রাগ,ক্ষোভ, হিংসা বিস্তার বন্ধ হোক।

লেখকঃ জেনারেল সেক্রেটারী, বাংলাদেশ ইন্টেলেকচুয়াল মুভমেন্ট (বিআইএম)

#ফেসবুক টাইমলাইন থেকে