শিরোনাম :

  • মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৪

গণতন্ত্র ও আইনের শাসন ফিরিয়ে আনাই মূল চ্যালেঞ্জ

এম আবদুল্লাহ?

তেতাল্লিশে পা দিচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। নানা ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতন আর ভাঙ্গা-গড়ায় ৪২ বছরের পরিণত বয়স হয়েছে। ১৯৭৮ সালের এই দিনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে জন্ম হয় দেশের অন্যতম বৃহৎ এই রাজনৈতিক দলটির। চারবার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা বিএনপি এমন একটি সময়ে ৪৩ বছরে পা রাখছে, যখন দলটির জন্য বলতে গেলে সবকিছুই প্রতিকূলে। বিশ মাস আগের মিডনাইট ভোটের একাদশ নির্বাচনের চরম গ্লানিকর ফলাফলের পর নেতাকর্মীরা অনেকটাই হতাশাগ্রস্ত ও হতোদ্যম। দলের বর্তমান কান্ডারী চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বানোয়াট মামলায় ২৫ মাসের অধিক সময় দুঃসহ কারাজীবন থেকে ‘সরকার-পরিবার’ সমঝোতায় গেল মার্চে মুক্তি পেলেও কার্যতঃ এখনো গৃহবন্দী। শারিরীক অসুস্থতা ও সরকারি শর্তের জালে আটকে ব্যস্ত রাজনৈতিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন তিনি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ক্ষমতাদর্পিদের রোষে পড়ে একাধিক মামলায় সাজা ও কয়েকটিতে পরোয়ানা মাথায় নিয়ে লন্ডনে নির্বাসিত। সেখান থেকে তার নির্দেশনায় চলছে দল।
টানা চৌদ্দ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি ও দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এখনও বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্খার কেন্দ্রে। প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কালজয়ী জাতীয়তাবাদী আদর্শ আর উন্নয়ন, উৎপাদন ও জনগণতান্ত্রিক রাজনীতির থেকে বিএনপি অনেকটাই বিচ্যুত- এমন আক্ষেপ করছেন দলটির কোন কোন শুভাকাঙ্খী। মহান আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থাকে মূলমন্ত্র করে দুর্গম পথে সাহসী অভিযাত্রা থেকে যে অনেকটাই বিচ্যুতি ঘটেছে তার কারন বিচার বিশ্লেষণের তাগিদও জোরদার হচ্ছে। যদিও বিএনপির নীতি-নির্ধারকেরা আদর্শিক বিচ্যুতি ও বিরাজমান হতাশার কথা কবুল করছেন না। তারা বলছেন, সাময়িক হতাশাগ্রস্ত নেতাকর্মীদের মাঝে নতুন করে স্বপ্ন জাগিয়ে তুলছেন তারা। খালেদা জিয়া শৃঙ্খলমুক্ত হয়ে স্বাভাবিক রাজনীতিতে হাল ধরলেই সব ঠিক হয়ে যাবে-এমন আশা তাদের। দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন ফিরিয়ে আনাই তাদের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ।

চার দশকের বেশি সময় আগে দেশে চরম অনিশ্চয়তা ও টালমাটাল পরিস্থিতিতে হতাশা, ক্ষোভ, না পাওয়ার বেদনা এবং একদলীয় দুঃশাসনে অতিষ্ঠ জনগণের মাঝে স্বস্তি ও আশার সঞ্চার করে পথচলা শুরু হয় বিএনপির। দীর্ঘ এই পথ পরিক্রমায় দলটির সাফল্য যেমন ঈর্ষণীয়, তেমনি বহুবার সীমাহীন প্রতিকূল পরিস্থিতিও মোকাবেলা করেছে। ২০০৭ সালে মইন-ফখরুদ্দিনের সেনাসমর্থিত ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমল থেকে দলটির ওপর যে মামলা, হামলা, জেল, জুলুম, নির্যাতন-নিপীড়ন শুরু হয়েছিল তার ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। হাজার হাজার নেতাকর্মী বিচারবহির্ভুত হত্যা এবং গুম খুনের শিকার হয়েছেন। শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত লক্ষাধিক নেতাকর্মীরা মামলায় জর্জরিত। এরকম নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে সংগঠনকে গতিশীল করে নতুন আশায় পথ চলতে চাইছে বিএনপি।

বিএনপি প্রতিষ্ঠার পটভূমি: ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি এক দলীয় বাকশালী শাসন কায়েম করে রক্ষীবাহিনী, লালবাহিনী গঠনের পর এদেশে আবার বহুদলীয় গণতন্ত্র, বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে তা ছিল ভাবনারও অতীত। পচাত্তরের ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে অভাবনীয় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে। তার পর ৩ নভেম্বর প্রতিবিপ্লব ও তার ধারাবাহিকতায় ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের রাজনীতির সূচনা। সেদিন সিপাহী জনতার মিলিত সমর্থনে স্বাধীনতার ঘোষক ও অকূতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান বীর উত্তম দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পান। তখন দেশের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। দুর্দান্ত সাহসিকতায় ভর করে দৃঢ় ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সমুজ্জ্বল রেখে দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করেন তিনি। আর তখন দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে জাগিয়ে তুলতে প্রয়োজন পড়ে একটি প্লাটফর্মের।

এ প্রেক্ষাপটে জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁর শাসনকে দ্রুত অসামরিকীকরণের লক্ষ্যে ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল ১৯ দফা কর্মসুচি ঘোষণা করেন। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠিত হয়। ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে করা হয় এ দলের আহবায়ক। নবগঠিত দলের অন্য নেতাদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, জামাল উদ্দিন আহমদ প্রমুখ। জাগদলের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে দলের ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের স্বাধীন, জাতীয়, মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশ সুনিশ্চিত করার জন্য জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে এমন একটি জাতীয় সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা প্রবলভাবে অনুভব হচ্ছে যা কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, বুদ্দিজীবী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও কর্মজীবি মানুষকে একতাবদ্ধ করে স্বাধীন জাতীয় বিকাশ নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে। …… জাগদলের মাধ্যমেই কেবল জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে জাতীয় বিকাশ সম্ভব।’

জাগদল গঠনের পর একই বছর ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’ নামে একটি রাজনৈতিক জোট গঠিত হয়। জাগদল ছাড়াও এই জোটে যোগ দেয় মশিউর রহমান যাদু মিয়ার নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), কাজী জাফর ও ক্যাপ্টেন আবদুল হালিমের নেতৃত্বে ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (ইউপিপি), শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে মুসলিম লীগসহ আরও কয়েকটি দল ও গ্রুপ। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের পক্ষ থেকে ১৩ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এ নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন জাতীয় ফ্রন্টের জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী। নির্বাচনে ওসমানীকে হারিয়ে বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জেনারেল জিয়াউর রহমান। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার অব্যবহিত পরই ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। বিলুপ্তি ঘটে জাগদল ও ঐক্যফ্রন্টের। নির্বাচনী জোট জাতীয়তাবাদী ঐক্যফ্রন্ট ছাড়াও মুসলিম লীগের অপরাংশ ও ন্যাপ (ভাসানী) বিএনপিতে যোগ দেয়। অবশ্য কাজী জাফরের নেতৃত্বে জাগদলের একটি অংশ বাইরে থেকে যায়। জিয়াউর রহমান ঘোষিত ১৯ দফাকেই নবগঠিত বিএনপি’র মূল আদর্শ হিসেবে ধরা হয়। জিয়াউর রহমান প্রথমে দলের আহবায়ক ও পরে চেয়ারম্যান হন। প্রথম মহাসচিব হন অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। মুক্তদ্বার নীতি গ্রহণ করে দলকে ব্যাপকভিত্তিক একটি জাতীয়তাবাদী প্লাটফর্ম হিসেবে রূপ দিতে জিয়াউর রহমান দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী মতাদর্শের রাজনীতিকদের স্বাগত জানান। তখন দলের ৪৫ শতাংশেরও বেশী নেতাকর্মী ও সদস্য ছিলেন রাজনীতিতে নবাগত ও তরুণ। দলের প্রধান লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়- অর্থনৈতিক উন্নয়ন, গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ইস্পাতকঠিন জাতীয় ঐক্য ও জনগণের মধ্যে স্বনির্ভরতার চেতনা সৃষ্টি। পাশাপাশি চারটি মূলনীতি ছিল সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার।

রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাকালে গোটা জাতি ছিল বিভক্ত। আর এই বিভক্তি ডান, মধ্য ও বাম ইত্যাকার রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তিতেই শুধু নয়, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে বা করেনি কিংবা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ বা বিপক্ষ শক্তি হিসেবেও। ফলে ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সংস্কৃতিসেবীর মত সামাজিক শক্তিগুলোও বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। আমলা এমনকি সামরিক বাহিনীও মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রপতি জিয়ার বিএনপি গঠনের প্রধান লক্ষ্য ছিল এ বিভাজন দূরীকরণ এবং গোটা জাতি যাতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একক সত্তা হিসেবে কাজ করতে পারে সেজন্য বিবদমান গোষ্ঠী ও উপদলের একত্রিকরণ। জিয়াউর রহমান শুধু তার প্রতিষ্ঠিত দল নয়, বাকশালের কারণে বিলীন হয়ে যাওয়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও প্রকাশ্যে রাজনীতির সুযোগ করে দেন। বিলুপ্ত হওয়া আওয়ামী লীগকেও নিজ নামে রাজনীতি করার পথ সুগম করে দেন।

দুর্গম পথ চলা : জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সাথে ইসলামী মূল্যবোধের সমন্বয় তার দলকে দ্রুততম সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয় করে তোলে। অতুলনীয় দেশপ্রেম ও সততা, অসীম কর্মোদ্দীপনা, জনগণের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যাওয়ার অনন্য গুণে ক্যারিশমেটিক রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান মাত্র তিন বছরেরও কম সময়ের মধ্যে দেশকে বিশ্বমঞ্চে মর্যাদার আসনে সমাসীন করার পাশাপাশি স্বনির্ভর অর্থনীতির দেশে রূপান্তর করতে সক্ষম হন। কিন্তু ১৯৮১ সালের ৩০ মে’র কালোরাতে কতিপয় বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে জিয়াউর রহমান শাহাদতবরণ করেন। জাতি আবার হতাশায় নিমজ্জিত হয়। অস্তিত্বের সংকটে পড়া বিএনপির রাজনীতির হাল ধরতে হয় গৃহবধু বেগম খালেদা জিয়াকে। তার পর থেকে স্বৈরাচারবিরোধী বিরামহীন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নন্দিত নেত্রী হিসেবে অভাবনীয় উত্থান ঘটে বেগম খালেদা জিয়ার। সেই সময় থেকে বিএনপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনিই।

স্বৈরশাসনবিরোধী দীর্ঘ নয় বছরের লড়াকু সংগ্রামে আপসহীন নেত্রীর খেতাব পান বেগম খালেদা জিয়া। গণঅভ্যূত্থানে ১৯৯০-এর গণতন্ত্রায়নের পর ২০০১ সাল পর্যন্ত দেশে মোট চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি তিনটিতেই জয়লাভ করে। ১৯৯১-এর নির্বাচনে বিএনপি ১৪২টি আসন লাভ করে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে অনেকটা বাধ্য হয়ে করা একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে স্বল্পস্থায়ী সরকার গঠন করে বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে আন্দোলনমুখী হওয়ায় ৪৫ দিনের মাথায় সেই সরকার একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে পুনরায় নির্বাচন করার জন্য ক্ষমতা তুলে দেয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ চারদল প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করে। তবে এক-এগারোর সরকারের দুই বছর পর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে দলটির ইতিহাসে প্রথম বারের মত ভরাডুবির মুখোমুখি হয়। সেনানিয়ন্ত্রিত ওই নির্বাচন ও তার ফলাফল যে পাতানো ছিল এবং বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কহীন ছিল তা পরে প্রকাশ পায়। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনের নির্বাচনের দাবি আদায় না হওয়ায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে অংশ নেয়নি দলটি।

আবার ভঙ্গুর সাংগঠনিক অবস্থা এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায় না করেই চরম বৈরী পরিস্থিতিতে ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় দলটি। জনবিচ্ছিন্ন হিসেবে খ্যাতি পাওয়া ড. কামাল হোসনকে শীর্ষ নেতা মেনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে ঘরে বাইরে বিতর্কের জন্ম দেয় ড. কামালকে প্রধান করে ঐক্যফ্রন্ট গঠনকে খালেদা জিয়া । পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে ‘মহাভুল’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মাঠ দখলে ব্যর্থ হলে নিশিভোটের নির্বাচনে মাত্র সাতটি আসন দেয়া হয় বিএনপি জোটকে। সংসদে যাওয়ার ‘বিনিময়ে’ দলের চেয়ারপারসনের কারামুক্তির আশাও দূরাশায় পরিণত হয়। এরই মধ্যে আবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটে চলছে ব্যাপক টানাপড়েন।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। তার পরও একদিকে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ভয়ানক নিপীড়ন, প্রতিবেশী আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রের নগ্ন হস্তক্ষেপ, অন্যদিকে ভুলের চক্করে পড়ে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে চরমভাবে ব্যর্থ হয় বিএনপি জোট। ফলশ্রুতিতে জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়াই দু’টি সংসদ গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ সদর্পে জারি রেখেছে ফ্যাসিবাদী শাসন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর অজানা কারণে আন্দোলনের কর্মসূচি স্থগিতকরণ, একাদশ নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে আবার শপথ নিয়ে সংসদীয় তামাশার অংশ হওয়া, বিভিন্ন উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নাজেহাল ও নাস্তানাবুদ হওয়ার পরও বার বার নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিএনপি’র রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতাকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এসব সিদ্ধান্তের সঙ্গে খালেদা জিয়ার সায় ও সম্পর্ক ছিলনা বলেই চাউর আছে। নিরাপস ও উজ্জ্বল ভাবমূর্তি নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া এখনও জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির ঐক্যের প্রতীক। বিএনপি মানেই এখনো খালেদা জিয়া। সাজানো ও বানোয়াট মামলায় একের পর এক সাজা দিয়েও তাঁর মাথা নোয়ানো যায়নি। দেশের স্বার্থ, জনগণের অধিকার প্রশ্নে একচুলও ছাড় দেননি তিনি। সেজন্য অনেক মূল্য দিতে হচ্ছে বটে। অসুস্থতা ও বার্ধক্যজনিত নাজুক শারিরীক অবস্থায়ও তিনি থেকেছেন অটল-অবিচল। বন্দী অবস্থায় চিকিৎসাবঞ্চিত করে, নিষ্ঠুর আচরণ করে তাঁর মনোবলে এতটুকু চিড় ধরানো যায়নি।

বিএনপির নেতারা বলছেন, রাজনীতিতে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। এ পথে হেরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কৌশল পরিবর্তন করেই পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। বিএনপিও এখন সেই কৌশল নিয়েছে বলে দাবি তাদের। নেতারা বলছেন, বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করাই বিএনপির প্রচেষ্টা। দীর্ঘ ৪২ বছর পরও সে লক্ষ্য অর্জনে দল নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। তাদের দাবি, দেশের অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারী উন্নয়ন, কৃষি, বিজ্ঞান প্রযুক্তি, গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ সব সাফল্য বিএনপি সরকারের আমলেই হয়েছে। জিয়াউর রহমান সংবিধানে বিসমিল্লাহ সংযোজনসহ ইসলামী মূল্যবোধকে জাগ্রত করেছেন।

বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালে সব দল ও সংগঠনের কার্যক্রম চলছে অনলাইনে। কিন্তু ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দলীয় চেয়ারপার্সন কারাবন্দী হওয়ার পর থেকেই বিএনপি’র নীতিনির্ধারণী সভা অনলাইননির্ভর। শীর্ষ নেতার অনুপস্থিতিতে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বৈঠকে বসে স্কাইপে বা জুমে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনা করে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। নানামুখী সমস্যায় থাকা দলটি আগামী দিনে কীভাবে পথ চলবে, তা নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। দল হিসেবে সংগ্রাম করে চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে না পারা বড় ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত করছেন পর্যবেক্ষকরা। দুই বছর আন্দোলন ও আইনি লড়াই চালিয়ে কার্যকর তেমন কিছু করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ায় সরকার এক দিকে খালেদা জিয়াকে হাসাপাতাল বা কারাগারে রাখা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে, অন্যদিকে গুরুতর অসুস্থতায় উদ্বিগ্ন পরিবার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে । এ প্রক্রিয়ায় অনেকটা নাটকীয়ভাবে সরকারের নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিতের মাধ্যমে পিজি হাসাপাতালের কেবিন থেকে গুলশানের ফিরোজায় চার দেয়ালের মধ্যে আনতে সক্ষম হয় পরিবার। সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে সাজা স্থগিতের মেয়াদ শেষ হবে। এরই মধ্যে পরিবার থেকে স্থগিতাদেশ বাড়ানোর আবেদন প্রক্রিয়া চলছে। এর অর্থ দাঁড়ায় খালেদা জিয়া এখনো মুক্ত নন, বরং সরকার প্রধানের খেয়াল-খুশির কাছে বন্দী।

এদিকে মুখে বিএনপি নেতারা সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী দাবি করলেও বারবার উদ্যোগ নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে দল পুনর্গঠনের কাজও শেষ করতে পারেনি। ব্যক্তিস্বার্থে নেতাদের মধ্যেও রয়েছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দল। কাউকে কাউকে সরকারের ‘চর’ আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। এতে অবিশ্বাস ও সন্দেহপ্রবণতা বাড়ছে। আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু রাজধানী ঢাকায় দলের সাংগঠনিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। সাংগঠনিকভাবে দু’ভাগ করে কমিটি গঠন করলেও খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে কিংবা একাদশ নির্বাচনকালে উল্লেখযোগ্য কোন শক্তি প্রদর্শন করতে পারেনি ঢাকা মহানগর বিএনপি। মহানগর, জেলা, থানা কমিটি নিয়েও অবস্থা লেজেগোবরে। এমন সার্বিক প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করছে বিএনপি।