নেপালে বাংলাদেশি বিমান দুর্ঘটনা

৪৯ আরোহী নিহত, আহত ২২ : তদন্ত কমিটি গঠন, দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ জানা যায়নি * ফার্স্ট অফিসার নাবিলা নিহত * ৭১ যাত্রীর মধ্যে পাইলট কেবিন ক্রুসহ ৩৬ বাংলাদেশি * ত্রিভুবন বিমানবন্দরের টাওয়ারের ভুল বার্তার কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে -ইউএস-বাংলা * শাহজালালের পরিচালকসহ সিভিল এভিয়েশনের একটি দল কাঠমান্ডু পৌঁছেছে

বিমান বিদ্ধস্তনিজস্ব প্রতিবেদকঃ নেপালের কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়েছে। সোমবার স্থানীয় সময় (নেপাল) দুপুর ২টা ২০ মিনিটে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৪৯ আরোহী নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ২৫ জন বাংলাদেশি। আর ২২ যাত্রী নেপালের ৪টি হাসপাতালে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।

এখনও পর্যন্ত দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে নেপাল সিভিল এভিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের আগ মুহূর্তে উড়োজাহাজটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছিল বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। পাইলট উড়োজাহাজের ইঞ্জিনে আগুন দেখতে পেয়েছিলেন। ওই অবস্থায় ফ্লাইটটি জরুরি অবতরণ করাতে গিয়ে রানওয়েতে ছিটকে পড়ে বিধ্বস্ত হয়। পাইলট অবতরণের আগে অল্প দূরত্ব থেকে মোড় ঘোরাতে গেলে উড়োজাহাজটি রানওয়েতে ছিটকে পড়ে। এ ঘটনায় উড়োজাহাজে থাকা ৪ ক্রুর মধ্যে ফার্স্ট অফিসার ক্যাপ্টেন প্রিথুলা রশিদ নাবিলা মারা গেছেন। পাইলটসহ দুই কেবিন ক্রুকে একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যদিকে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ত্রিভুবন বিমানবন্দরের টাওয়ারের ভুল বার্তার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।

বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে বিধ্বস্ত উড়োজাহাজ থেকে ব্ল্যাকবক্স উদ্ধার করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ব্ল্যাকবক্স পরীক্ষা করলেই উড়োজাহাজটির দুর্ঘটনার সব ধরনের কারণ উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে। কারণ যে কোনো উড়োজাহাজ উড্ডয়নের পর থেকে অবতরণ পর্যন্ত ওই উড়োজাহাজে কি ধরনের তথ্য আদান-প্রদান হয়েছে এবং পাইলট, কো-পাইলট কিভাবে ফ্লাইটটি চালিয়েছেন, কোনো ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি হয়েছিল কিনা- এসব তথ্য ব্ল্যাকবক্সে রেকর্ড হয়ে থাকে। এ ঘটনায় সোমবার রাতে সিভিল এভিয়েশন, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সসহ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

দুর্ঘটনার পরপরই নেপালের সেনাবাহিনী ও উদ্ধারকারী টিমের সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার অভিযান শুরু করেন। দুর্ঘটনার পরই পুরো উড়োজাহাজটি দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করে। এ সময় পুরো বিমানবন্দর ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। অনেক দূর থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখা গেছে। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে যাত্রীদের আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা বিমানবন্দরে ছুটে আসেন। একই সঙ্গে নেপালে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনারসহ কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিমানবন্দরে ছুটে আসেন। এ সময় পুরো বিমানবন্দরে হৃদয়বিদারক ঘটনার সূত্রপাত ঘটে।

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের সিইও ইমরান আসিফ সাংবাদিকদের বলেন, কাঠমান্ডু এয়ারপোর্টের কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে ভুল বার্তা (রং ডিরেকশন) পাওয়ার কারণে পাইলট ভুল বোঝাবুঝির শিকার হন। তিনি বলেন, অবতরণের সময় টাওয়ার থেকে ৩ মিনিটে ৩ ধরনের তথ্য দিয়েছিল পাইলটকে। এতে বিভ্রান্তিতে পড়েন পাইলট। ততক্ষণে ফ্লাইটটি রানওয়ের খুবই কাছাকাছি চলে আসে। এ কারণে পাইলট নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। ইমরান আসিফ বলেন, গত ৭ বছরে এ এয়ারপোর্টে ১৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ১৩৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের হিসাব অনুযায়ী, কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন এয়ারপোর্টটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটি বিমানবন্দর। বিশ্বের ১০টি ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দরের মধ্যে এটি অন্যতম।

এদিকে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে সোমবার সন্ধ্যায় হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কাজী ইকবাল করিম, পরিচালক (সিভিল এভিয়েশন) সরোয়ার ভূঁইয়া, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের পাইলট ক্যাপ্টেন লুৎফুর রহমান ও দুই চিকিৎসক কাঠমান্ডু পৌঁছেছেন। বেসরকারি বিমান সংস্থা রিজেন্ট এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট (আরএক্স-৭৯৫) সন্ধ্যা ৬টা ৫৮ মিনিটে কাঠমান্ডুর উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করে। রিজেন্ট এয়ারওয়েজের কর্মকর্তা ইজাজ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, তাদের ফ্লাইটটি ঢাকা ফেরার পথে কাঠমান্ডুতে অপেক্ষারত ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ৩৫ যাত্রীকে তাদের ফ্লাইটে নিয়ে আসবেন।

কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জেনারেল ম্যানেজার রাজ কুমার ছেত্রিকে উদ্ধৃত করে দেশটির ইংরেজি নিউজ পোর্টাল মাই রিপাবলিকা জানিয়েছে, ড্যাশ-৮ কিউ৪০০ মডেলের ওই উড়োজাহাজে ৭১ জন আরোহী ছিলেন। এর মধ্যে ৬৭ যাত্রী ও ৪ ক্রু ছিলেন। যাত্রীদের মধ্যে ৩২ জন বাংলাদেশি, ৩৩ জন নেপালি, একজন চাইনিজ এবং একজন মালদ্বীপের নাগরিক ছিলেন।

সোমবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টা পর্যন্ত ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের সিইও ইমরান আসিফ সাংবাদিকদের বলেছেন, ৬৭ যাত্রীর মধ্যে তারা জানতে পেরেছেন মৃতের সংখ্যা ৮ জন। বাকিদের নেপালের ৪টি হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তিনি চিকিৎসাধীন ১৬ যাত্রীর নামও প্রকাশ করেন। তিনি বলেছেন, নেপালের দুর্ঘটনাস্থলে যাওয়ার জন্য তাদের একটি বিশেষজ্ঞ টিম উড়োজাহাজ নিয়ে শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছে। নেপালের বিমানবন্দরের রানওয়ে উন্মুক্ত হলে ওই ফ্লাইটটি ছেড়ে যাবে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রাতে ওই ফ্লাইটটি কাঠমান্ডু পৌঁছেছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশের কোনো উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে ১৯৮৪ সালে। ওই বছর ৫ আগস্ট বাংলাদেশ বিমানের একটি ফকার এফ-২৭ বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যে ঢাকা বিমানবন্দরের কাছে বিধ্বস্ত হলে ৪৯ জন নিহত হন।

দুর্ঘটনার পরপর রাত ৮টা পর্যন্ত কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান উঠানামা বন্ধ রাখা হয়েছিল। কাঠমান্ডুর বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওই উড়োজাহাজে যাত্রীদের মধ্যে ১৭ জনকে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। জরুরি যোগাযোগের জন্য একটি হটলাইন খুলেছে দূতাবাস কর্তৃপক্ষ। মোহাম্মদ আল আলামুল ইনাম, ফোন নম্বর : +৯৭৭৯৮১০১০০৪০১, অশিত বারন সরকার, +৯৭৭৯৮৬১৪৬৭৪২২ নম্বরে যোগাযোগ করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

নেপালের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ডিজি সঞ্জিব গওতমের বরাত দিয়ে কাঠমান্ডু পোস্ট লিখেছে, ড্যাশ-৮ কিউ৪০০ মডেলের ওই উড়োজাহাজ ত্রিভুবনে নামার কথা ছিল রানওয়ের দক্ষিণ দিক দিয়ে। কিন্তু সেটি নামার চেষ্টা করে উত্তর দিক দিয়ে। ধারণা করা হচ্ছে, পাইলট কোনো ধরনের কারিগরি জটিলতায় পড়েছিলেন। ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মুখপাত্র প্রেমনাথ ঠাকুর বলেছেন, রানওয়েতে অবতরণের চেষ্টার সময় বিমানটিতে আগুন ধরে যায়। পরে বিমানবন্দরের পাশের একটি ফুটবল মাঠে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। তিনি বলেন, ত্রিভুন বিমানবন্দরে অবতরণের আগে বেশ কয়েকটি উঁচু পাহাড় অতিক্রম করতে হয়। এসব পাহাড়ের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ ধরে সব ধরনের ফ্লাইটকে অবতরণ করতে হয়।

অবতরণের আগেই আগুন ধরে বিমানটিতে : নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (টিআইএ) ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমানটিতে আগুন ধরে যায় বিধ্বস্ত হওয়ার আগেই। নেপালের স্থানীয় দৈনিক হিমালয় টাইমস বলছে, ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের আগেই বিমানটিতে আগুনের সূত্রপাত হয়। দেশটির বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক সানজিব গৌতম বলেন, রানওয়েতে অবতরণের চেষ্টার সময় বিমানটির পাইলট নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। তিনি বলেন, ইউএস-বাংলার বিমানটিকে বিমানবন্দরের দক্ষিণ-প্রান্ত থেকে রানওয়েতে অবতরণের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বিমানটি বিমানবন্দরের উত্তর অংশ থেকে অবতরণের চেষ্টা করে। এ সময় হঠাৎ বিমানটিতে আগুন ধরে যায়।

পরে বিমানবন্দরের পাশের একটি ফুটবল মাঠে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। সানজিব গৌতম বলেন, অস্বাভাবিক এ অবতরণের পেছনের কারণ এখনও আমরা জানতে পারিনি। যান্ত্রিক ত্র“টির কারণে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করছে ত্রিভুবন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।

অবতরণের নির্দেশনা মানেননি পাইলট : নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (টিআইএ) ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমানটির পাইলটকে বিমানবন্দরের দক্ষিণ-প্রান্ত থেকে রানওয়েতে অবতরণের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বিমানবন্দরের উত্তর অংশ থেকে বিমানটি অবতরণের চেষ্টা করে পাইলট। এ সময় হঠাৎ বিমানটিতে আগুন ধরে যায়। নেপালের বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক সানজিব গৌতম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে কি কারণে পাইলট বিমানবন্দর কন্ট্রোল রুমের ওই নির্দেশনা পালন করেননি তা জানা যায়নি। দেশটির এ কর্মকর্তা বলেন, রানওয়ের উত্তর অংশ দিয়ে অবতরণের চেষ্টার সময় বিমানটির পাইলট নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। ফলে বিমানবন্দরের পাশের একটি ফুটবল মাঠে আছড়ে পড়ে বিমানটি।

ভুল বার্তায় দুর্ঘটনা -ইউএস-বাংলা : ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইমরান আসিফ সাংবাদিকদের বলেন, নেপালের কাঠমান্ডু এয়ারপোর্টের এটিসি টাওয়ার তাদের ভুল বার্তা দিয়েছে। রানওয়ের কোনদিক থেকে বিমানটি ল্যান্ড করবে, সে বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বার্তা দেয়া হয়েছিল। এ বার্তা বিভ্রান্তির কারণেই দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে আমরা মনে করছি। আমাদের পাইলটের দিক থেকে কোনো সমস্যা ছিল না। তিনি বলেন, বিমানে পাইলট ছিলেন ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান। এ এয়ারক্র্যাফটে তিনি ১৭ ঘণ্টার বেশি ফ্লাই করেছেন। তিনি (পাইলট) এই এয়ারক্র্যাফটের ইন্সট্রাকটর (নির্দেশক), কাঠমান্ডু টাওয়ারের সঙ্গে পাইলটের কথোপকথন ইতিমধ্যে ইউটিউবে দেয়া হয়েছে। এ কথোপকথন যে কোনো বিশেষজ্ঞকে শোনানো হলে তারাও একই কথা বলবেন। এক্ষেত্রে বিমানের কোনো যান্ত্রিক ত্র“টি ছিল কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অবশ্যই যান্ত্রিক ত্র“টি ছিল না। বিমানটির বয়স ১৬ বছর। আমাদের এ ধরনের ৪টি এয়ারক্র্যাফট রয়েছে। ইউএস বাংলার সিইও বলেন, সর্বশেষ খবরে ৮ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া গেছে। এদের পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি। বাকিদের মধ্যে ৯ জনকে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। হাসপাতালগুলো হল- কেএমসি ৯ জন, নরউইকে ৩ জন, বান্ডিতে ২ জন, উমে ১ জন এবং ডিসি হাসপাতালে ১ জনসহ ১৬ জনকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এয়ারক্র্যাফটের ফ্লাইড ডাটা রেকর্ডার এবং কপটিপ ভয়েস রেকর্ডার উদ্ধার হলে ঘটনার কারণ বিস্তারিত জানা যাবে। তিনি বলেন, আমাদের যাত্রীদের চিকিৎসার বিষয়টি আমরা প্রাধান্য দিচ্ছি। এক্ষেত্রে নেপালের বাংলাদেশ দূতাবাস সহায়তা করছে।

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জিএম, মার্কেটিং সাপোর্ট অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন) কামরুল ইসলাম বলেন, ক্র্যাফটে মোট ৬৭ জন যাত্রী এবং ৪ জন ক্রু ছিলেন। যাত্রীদের মধ্যে ৩২ জন বাংলাদেশি, ৩৩ জন নেপালি, মালদ্বীপের একজন এবং চীনের একজন যাত্রী ছিলেন। তিনি বলেন, ক্যাপ্টেন লুৎফরসহ আরও একজন নেপালের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। তারা দুর্ঘটনার বিষয়ের ওপর খোঁজখবর নিয়ে আমাদের জানাবেন। দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, সাড়ে ৩ বছরে আমরা ৩৬ হাজার ফ্লাইট পরিচালনা করেছি। আগে কখনও এমনটি হয়নি। তবে এ বিষয়ে নেপালের সিভিল এভিয়েশন এবং দুর্ঘটনায় পতিত বিমানের ব্ল্যাকবক্স উদ্ধারের পর জানা যাবে। ‘আমাদের ধারণা এটি একটি দুর্ঘটনা’- বলেন তিনি।

৭ বছরে নেপালে ১৫ বিমান বিধ্বস্ত : নেপালে গত ৭ বছরে অন্তত ১৫টি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়। নেপালের জরিপ সংস্থা নেপাল ইন ডাটার তথ্যমতে ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এসব বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ১৩৪ জন যাত্রীর প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। সংস্থাটি আরও দাবি করেছে, নেপালে প্রতি বছর গড়ে ছোট-বড় মিলিয়ে একটি করে দুর্ঘটনা ঘটে। সংস্থাটির প্রকাশিত একটি গ্রাফে দেখা যায়- ২০১০ সালে ৩৬ জন, ২০১১ সালে ১৯ জন, ২০১২ সালে ৩৪ জন, ২০১৪ সালে ১৮ জন, ২০১৫ সালে ২৫ জন ও ২০১৭ সালে ২ জন বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন।

একই সঙ্গে সংস্থাটি সোমবার নেপালের কাঠমান্ডুতে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৫০ জনের নিহতের খবর পাওয়া গেছে।

স্বজনহারাদের আহাজারি : বিমান বিধ্বস্তের খবরে রাজধানীর বারিধারায় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স কার্যালয়ে ছুটে আসেন স্বজনরা। তাদের মধ্যে একজন শাওন। তিনি বলেন, ‘বাবা কবির হোসেন সহযোগী দুই ব্যবসায়ীকে নিয়ে ওই ফ্লাইটে কাঠমান্ডু গেছেন। বাবার মোবাইল ফোন থেকে আমাকে ফোন দিয়ে জানানো হয়, তিনি একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।’ ওই খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বারিধারার অফিসে আসি। শাওনের বাসা উত্তরার উত্তরখান এলাকায়।

রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকার উম্মে সালমা। সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তিনি। বর্তমানে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ হিসেবে কর্মরত। ৩ দিনের সরকারি সেমিনারে সোমবার ইউএস-বাংলার বিমানে কাঠমান্ডু যান তিনি। এরপরই আসে বিমান দুর্ঘটনার খবর। সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর বারিধারারা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের অফিসে ছুটে আসেন তার বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ। বোনের জন্য আহাজারি করতে থাকেন তিনি। তিনি জানান, তার বোনের সঙ্গে একই বিমানে ছিলেন সিনিয়র সহকারী প্রধান নাজিয়া আফরিন চৌধুরী। এদিকে নেপালে বিধ্বস্ত হওয়া ইউএস-বাংলার বিমানে পরিকল্পনা বিভাগের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) দুই নারী কর্মকর্তার থাকার কথাটি নিশ্চিত করেছেন জিইডির সদস্য ড. সামসুল আলম। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা খোঁজখবর রাখছি। নেপাল দূতাবাসে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।

নিহতরা বীমার আওতায় : ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ যুগান্তরকে জানিয়েছে, তাদের যাত্রীদের বীমা করা রয়েছে। ফলে দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার বীমার টাকা পাবেন। আহতদের চিকিৎসা খরচসহ সব ধরনের সহায়তা দেবে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়াও প্রত্যেক যাত্রীর পরিবারের পক্ষ থেকে একজন সদস্যকে আজ নেপালে নিয়ে যাবে প্রতিষ্ঠানটি।

সরকারি মেডিকেল টিম প্রস্তুত : আহতদের চিকিৎসা সুবিধা দিতে বাংলাদেশের মেডিকেল টিম প্রস্তুত রয়েছে। সরকারের নির্দেশ পেলেই সঙ্গে সঙ্গে নেপালে যাবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম যুগান্তরকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

নেপালের কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়েছে। সোমবার স্থানীয় সময় (নেপাল) দুপুর ২টা ২০ মিনিটে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৪৯ আরোহী নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ২৫ জন বাংলাদেশি। আর ২২ যাত্রী নেপালের ৪টি হাসপাতালে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।

এখনও পর্যন্ত দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে নেপাল সিভিল এভিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের আগ মুহূর্তে উড়োজাহাজটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছিল বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। পাইলট উড়োজাহাজের ইঞ্জিনে আগুন দেখতে পেয়েছিলেন। ওই অবস্থায় ফ্লাইটটি জরুরি অবতরণ করাতে গিয়ে রানওয়েতে ছিটকে পড়ে বিধ্বস্ত হয়। পাইলট অবতরণের আগে অল্প দূরত্ব থেকে মোড় ঘোরাতে গেলে উড়োজাহাজটি রানওয়েতে ছিটকে পড়ে। এ ঘটনায় উড়োজাহাজে থাকা ৪ ক্রুর মধ্যে ফার্স্ট অফিসার ক্যাপ্টেন প্রিথুলা রশিদ নাবিলা মারা গেছেন। পাইলটসহ দুই কেবিন ক্রুকে একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যদিকে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ত্রিভুবন বিমানবন্দরের টাওয়ারের ভুল বার্তার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।

বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে বিধ্বস্ত উড়োজাহাজ থেকে ব্ল্যাকবক্স উদ্ধার করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ব্ল্যাকবক্স পরীক্ষা করলেই উড়োজাহাজটির দুর্ঘটনার সব ধরনের কারণ উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে। কারণ যে কোনো উড়োজাহাজ উড্ডয়নের পর থেকে অবতরণ পর্যন্ত ওই উড়োজাহাজে কি ধরনের তথ্য আদান-প্রদান হয়েছে এবং পাইলট, কো-পাইলট কিভাবে ফ্লাইটটি চালিয়েছেন, কোনো ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি হয়েছিল কিনা- এসব তথ্য ব্ল্যাকবক্সে রেকর্ড হয়ে থাকে। এ ঘটনায় সোমবার রাতে সিভিল এভিয়েশন, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সসহ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

দুর্ঘটনার পরপরই নেপালের সেনাবাহিনী ও উদ্ধারকারী টিমের সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার অভিযান শুরু করেন। দুর্ঘটনার পরই পুরো উড়োজাহাজটি দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করে। এ সময় পুরো বিমানবন্দর ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। অনেক দূর থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখা গেছে। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে যাত্রীদের আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা বিমানবন্দরে ছুটে আসেন। একই সঙ্গে নেপালে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনারসহ কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিমানবন্দরে ছুটে আসেন। এ সময় পুরো বিমানবন্দরে হৃদয়বিদারক ঘটনার সূত্রপাত ঘটে।

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের সিইও ইমরান আসিফ যুগান্তরকে বলেন, কাঠমান্ডু এয়ারপোর্টের কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে ভুল বার্তা (রং ডিরেকশন) পাওয়ার কারণে পাইলট ভুল বোঝাবুঝির শিকার হন। তিনি বলেন, অবতরণের সময় টাওয়ার থেকে ৩ মিনিটে ৩ ধরনের তথ্য দিয়েছিল পাইলটকে। এতে বিভ্রান্তিতে পড়েন পাইলট। ততক্ষণে ফ্লাইটটি রানওয়ের খুবই কাছাকাছি চলে আসে। এ কারণে পাইলট নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। ইমরান আসিফ বলেন, গত ৭ বছরে এ এয়ারপোর্টে ১৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ১৩৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের হিসাব অনুযায়ী, কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন এয়ারপোর্টটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটি বিমানবন্দর। বিশ্বের ১০টি ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দরের মধ্যে এটি অন্যতম।

এদিকে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে সোমবার সন্ধ্যায় হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কাজী ইকবাল করিম, পরিচালক (সিভিল এভিয়েশন) সরোয়ার ভূঁইয়া, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের পাইলট ক্যাপ্টেন লুৎফুর রহমান ও দুই চিকিৎসক কাঠমান্ডু পৌঁছেছেন। বেসরকারি বিমান সংস্থা রিজেন্ট এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট (আরএক্স-৭৯৫) সন্ধ্যা ৬টা ৫৮ মিনিটে কাঠমান্ডুর উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করে। রিজেন্ট এয়ারওয়েজের কর্মকর্তা ইজাজ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, তাদের ফ্লাইটটি ঢাকা ফেরার পথে কাঠমান্ডুতে অপেক্ষারত ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ৩৫ যাত্রীকে তাদের ফ্লাইটে নিয়ে আসবেন।

কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জেনারেল ম্যানেজার রাজ কুমার ছেত্রিকে উদ্ধৃত করে দেশটির ইংরেজি নিউজ পোর্টাল মাই রিপাবলিকা জানিয়েছে, ড্যাশ-৮ কিউ৪০০ মডেলের ওই উড়োজাহাজে ৭১ জন আরোহী ছিলেন। এর মধ্যে ৬৭ যাত্রী ও ৪ ক্রু ছিলেন। যাত্রীদের মধ্যে ৩২ জন বাংলাদেশি, ৩৩ জন নেপালি, একজন চাইনিজ এবং একজন মালদ্বীপের নাগরিক ছিলেন।

সোমবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টা পর্যন্ত ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের সিইও ইমরান আসিফ সাংবাদিকদের বলেছেন, ৬৭ যাত্রীর মধ্যে তারা জানতে পেরেছেন মৃতের সংখ্যা ৮ জন। বাকিদের নেপালের ৪টি হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তিনি চিকিৎসাধীন ১৬ যাত্রীর নামও প্রকাশ করেন। তিনি বলেছেন, নেপালের দুর্ঘটনাস্থলে যাওয়ার জন্য তাদের একটি বিশেষজ্ঞ টিম উড়োজাহাজ নিয়ে শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছে। নেপালের বিমানবন্দরের রানওয়ে উন্মুক্ত হলে ওই ফ্লাইটটি ছেড়ে যাবে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রাতে ওই ফ্লাইটটি কাঠমান্ডু পৌঁছেছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশের কোনো উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে ১৯৮৪ সালে। ওই বছর ৫ আগস্ট বাংলাদেশ বিমানের একটি ফকার এফ-২৭ বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যে ঢাকা বিমানবন্দরের কাছে বিধ্বস্ত হলে ৪৯ জন নিহত হন।

দুর্ঘটনার পরপর রাত ৮টা পর্যন্ত কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান উঠানামা বন্ধ রাখা হয়েছিল। কাঠমান্ডুর বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওই উড়োজাহাজে যাত্রীদের মধ্যে ১৭ জনকে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। জরুরি যোগাযোগের জন্য একটি হটলাইন খুলেছে দূতাবাস কর্তৃপক্ষ। মোহাম্মদ আল আলামুল ইনাম, ফোন নম্বর : +৯৭৭৯৮১০১০০৪০১, অশিত বারন সরকার, +৯৭৭৯৮৬১৪৬৭৪২২ নম্বরে যোগাযোগ করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

নেপালের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ডিজি সঞ্জিব গওতমের বরাত দিয়ে কাঠমান্ডু পোস্ট লিখেছে, ড্যাশ-৮ কিউ৪০০ মডেলের ওই উড়োজাহাজ ত্রিভুবনে নামার কথা ছিল রানওয়ের দক্ষিণ দিক দিয়ে। কিন্তু সেটি নামার চেষ্টা করে উত্তর দিক দিয়ে। ধারণা করা হচ্ছে, পাইলট কোনো ধরনের কারিগরি জটিলতায় পড়েছিলেন। ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মুখপাত্র প্রেমনাথ ঠাকুর বলেছেন, রানওয়েতে অবতরণের চেষ্টার সময় বিমানটিতে আগুন ধরে যায়। পরে বিমানবন্দরের পাশের একটি ফুটবল মাঠে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। তিনি বলেন, ত্রিভুন বিমানবন্দরে অবতরণের আগে বেশ কয়েকটি উঁচু পাহাড় অতিক্রম করতে হয়। এসব পাহাড়ের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ ধরে সব ধরনের ফ্লাইটকে অবতরণ করতে হয়।

অবতরণের আগেই আগুন ধরে বিমানটিতে : নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (টিআইএ) ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমানটিতে আগুন ধরে যায় বিধ্বস্ত হওয়ার আগেই। নেপালের স্থানীয় দৈনিক হিমালয় টাইমস বলছে, ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের আগেই বিমানটিতে আগুনের সূত্রপাত হয়। দেশটির বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক সানজিব গৌতম বলেন, রানওয়েতে অবতরণের চেষ্টার সময় বিমানটির পাইলট নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। তিনি বলেন, ইউএস-বাংলার বিমানটিকে বিমানবন্দরের দক্ষিণ-প্রান্ত থেকে রানওয়েতে অবতরণের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বিমানটি বিমানবন্দরের উত্তর অংশ থেকে অবতরণের চেষ্টা করে। এ সময় হঠাৎ বিমানটিতে আগুন ধরে যায়।

পরে বিমানবন্দরের পাশের একটি ফুটবল মাঠে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। সানজিব গৌতম বলেন, অস্বাভাবিক এ অবতরণের পেছনের কারণ এখনও আমরা জানতে পারিনি। যান্ত্রিক ত্র“টির কারণে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করছে ত্রিভুবন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।

অবতরণের নির্দেশনা মানেননি পাইলট : নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (টিআইএ) ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমানটির পাইলটকে বিমানবন্দরের দক্ষিণ-প্রান্ত থেকে রানওয়েতে অবতরণের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বিমানবন্দরের উত্তর অংশ থেকে বিমানটি অবতরণের চেষ্টা করে পাইলট। এ সময় হঠাৎ বিমানটিতে আগুন ধরে যায়। নেপালের বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক সানজিব গৌতম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে কি কারণে পাইলট বিমানবন্দর কন্ট্রোল রুমের ওই নির্দেশনা পালন করেননি তা জানা যায়নি। দেশটির এ কর্মকর্তা বলেন, রানওয়ের উত্তর অংশ দিয়ে অবতরণের চেষ্টার সময় বিমানটির পাইলট নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। ফলে বিমানবন্দরের পাশের একটি ফুটবল মাঠে আছড়ে পড়ে বিমানটি।

ভুল বার্তায় দুর্ঘটনা -ইউএস-বাংলা : ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইমরান আসিফ সাংবাদিকদের বলেন, নেপালের কাঠমান্ডু এয়ারপোর্টের এটিসি টাওয়ার তাদের ভুল বার্তা দিয়েছে। রানওয়ের কোনদিক থেকে বিমানটি ল্যান্ড করবে, সে বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বার্তা দেয়া হয়েছিল। এ বার্তা বিভ্রান্তির কারণেই দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে আমরা মনে করছি। আমাদের পাইলটের দিক থেকে কোনো সমস্যা ছিল না। তিনি বলেন, বিমানে পাইলট ছিলেন ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান। এ এয়ারক্র্যাফটে তিনি ১৭ ঘণ্টার বেশি ফ্লাই করেছেন। তিনি (পাইলট) এই এয়ারক্র্যাফটের ইন্সট্রাকটর (নির্দেশক), কাঠমান্ডু টাওয়ারের সঙ্গে পাইলটের কথোপকথন ইতিমধ্যে ইউটিউবে দেয়া হয়েছে। এ কথোপকথন যে কোনো বিশেষজ্ঞকে শোনানো হলে তারাও একই কথা বলবেন। এক্ষেত্রে বিমানের কোনো যান্ত্রিক ত্র“টি ছিল কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অবশ্যই যান্ত্রিক ত্র“টি ছিল না। বিমানটির বয়স ১৬ বছর। আমাদের এ ধরনের ৪টি এয়ারক্র্যাফট রয়েছে। ইউএস বাংলার সিইও বলেন, সর্বশেষ খবরে ৮ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া গেছে। এদের পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি। বাকিদের মধ্যে ৯ জনকে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। হাসপাতালগুলো হল- কেএমসি ৯ জন, নরউইকে ৩ জন, বান্ডিতে ২ জন, উমে ১ জন এবং ডিসি হাসপাতালে ১ জনসহ ১৬ জনকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এয়ারক্র্যাফটের ফ্লাইড ডাটা রেকর্ডার এবং কপটিপ ভয়েস রেকর্ডার উদ্ধার হলে ঘটনার কারণ বিস্তারিত জানা যাবে। তিনি বলেন, আমাদের যাত্রীদের চিকিৎসার বিষয়টি আমরা প্রাধান্য দিচ্ছি। এক্ষেত্রে নেপালের বাংলাদেশ দূতাবাস সহায়তা করছে।

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জিএম, মার্কেটিং সাপোর্ট অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন) কামরুল ইসলাম বলেন, ক্র্যাফটে মোট ৬৭ জন যাত্রী এবং ৪ জন ক্রু ছিলেন। যাত্রীদের মধ্যে ৩২ জন বাংলাদেশি, ৩৩ জন নেপালি, মালদ্বীপের একজন এবং চীনের একজন যাত্রী ছিলেন। তিনি বলেন, ক্যাপ্টেন লুৎফরসহ আরও একজন নেপালের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। তারা দুর্ঘটনার বিষয়ের ওপর খোঁজখবর নিয়ে আমাদের জানাবেন। দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, সাড়ে ৩ বছরে আমরা ৩৬ হাজার ফ্লাইট পরিচালনা করেছি। আগে কখনও এমনটি হয়নি। তবে এ বিষয়ে নেপালের সিভিল এভিয়েশন এবং দুর্ঘটনায় পতিত বিমানের ব্ল্যাকবক্স উদ্ধারের পর জানা যাবে। ‘আমাদের ধারণা এটি একটি দুর্ঘটনা’- বলেন তিনি।

৭ বছরে নেপালে ১৫ বিমান বিধ্বস্ত : নেপালে গত ৭ বছরে অন্তত ১৫টি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়। নেপালের জরিপ সংস্থা নেপাল ইন ডাটার তথ্যমতে ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এসব বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ১৩৪ জন যাত্রীর প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। সংস্থাটি আরও দাবি করেছে, নেপালে প্রতি বছর গড়ে ছোট-বড় মিলিয়ে একটি করে দুর্ঘটনা ঘটে। সংস্থাটির প্রকাশিত একটি গ্রাফে দেখা যায়- ২০১০ সালে ৩৬ জন, ২০১১ সালে ১৯ জন, ২০১২ সালে ৩৪ জন, ২০১৪ সালে ১৮ জন, ২০১৫ সালে ২৫ জন ও ২০১৭ সালে ২ জন বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন।

একই সঙ্গে সংস্থাটি সোমবার নেপালের কাঠমান্ডুতে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৫০ জনের নিহতের খবর পাওয়া গেছে।

স্বজনহারাদের আহাজারি : বিমান বিধ্বস্তের খবরে রাজধানীর বারিধারায় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স কার্যালয়ে ছুটে আসেন স্বজনরা। তাদের মধ্যে একজন শাওন। তিনি বলেন, ‘বাবা কবির হোসেন সহযোগী দুই ব্যবসায়ীকে নিয়ে ওই ফ্লাইটে কাঠমান্ডু গেছেন। বাবার মোবাইল ফোন থেকে আমাকে ফোন দিয়ে জানানো হয়, তিনি একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।’ ওই খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বারিধারার অফিসে আসি। শাওনের বাসা উত্তরার উত্তরখান এলাকায়।

রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকার উম্মে সালমা। সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তিনি। বর্তমানে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ হিসেবে কর্মরত। ৩ দিনের সরকারি সেমিনারে সোমবার ইউএস-বাংলার বিমানে কাঠমান্ডু যান তিনি। এরপরই আসে বিমান দুর্ঘটনার খবর। সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর বারিধারারা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের অফিসে ছুটে আসেন তার বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ। বোনের জন্য আহাজারি করতে থাকেন তিনি। তিনি জানান, তার বোনের সঙ্গে একই বিমানে ছিলেন সিনিয়র সহকারী প্রধান নাজিয়া আফরিন চৌধুরী। এদিকে নেপালে বিধ্বস্ত হওয়া ইউএস-বাংলার বিমানে পরিকল্পনা বিভাগের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) দুই নারী কর্মকর্তার থাকার কথাটি নিশ্চিত করেছেন জিইডির সদস্য ড. সামসুল আলম। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা খোঁজখবর রাখছি। নেপাল দূতাবাসে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।

নিহতরা বীমার আওতায় : ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ যুগান্তরকে জানিয়েছে, তাদের যাত্রীদের বীমা করা রয়েছে। ফলে দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার বীমার টাকা পাবেন। আহতদের চিকিৎসা খরচসহ সব ধরনের সহায়তা দেবে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়াও প্রত্যেক যাত্রীর পরিবারের পক্ষ থেকে একজন সদস্যকে আজ নেপালে নিয়ে যাবে প্রতিষ্ঠানটি।

সরকারি মেডিকেল টিম প্রস্তুত : আহতদের চিকিৎসা সুবিধা দিতে বাংলাদেশের মেডিকেল টিম প্রস্তুত রয়েছে। সরকারের নির্দেশ পেলেই সঙ্গে সঙ্গে নেপালে যাবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম যুগান্তরকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

 

 

Print Friendly, PDF & Email