শিরোনাম :

  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪

করোনাভাইরাসের ধাক্কা কিভাবে সামলাচ্ছে কওমি মাদ্রাসাগুলো?

নিউজ ডেস্ক |

করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে টানা লকডাউনের কারণে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোতেও।

একাধিক মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষ বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে লকডাউন শুরু হওয়ার পর তাদের আয় কমে গেছে। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানই শিক্ষকদের ঠিকমতো বেতন দিতে পারছেন না।

সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে ১৪ হাজার ৩৯৭ কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। তবে কওমি সংশ্লিষ্টদের দাবি, সারা দেশে মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানে ২২ লাখের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে বলে তারা বলছেন।

বাংলাদেশে ছয়টি পৃথক আঞ্চলিক বোর্ডের মাধ্যমে এসব মাদ্রাসা পরিচালিত হয়।

আর্থিক সংকটে কওমি মাদ্রাসা

বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো মূলত স্থানীয় সাহায্য, অনুদান ও শিক্ষার্থীদের বেতনের ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হয়। দারুল উলুম দেওবন্দের রীতিনীতি অনুসরণ করে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সরকারি কোন সহায়তা গ্রহণ করেনা এসব মাদ্রাসা।

সাধারণত এসব মাদ্রাসার অনুদানের সবচেয়ে বড় অংশটি আসে রমজান মাসে। কিন্তু এই বছর রমজানে লকডাউনের ফলে বেশিরভাগ মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় মাদ্রাসাগুলোরও আয় হচ্ছে না, ফলে সেগুলো পরিচালনা করাও কঠিন হয়ে পড়ছে।

সিলেটের একটি কওমি মাদ্রাসা শরীফগঞ্জ তাহফিজুল কুরআন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সাইফুল ইসলাম বলছেন, ”আমাদের বেশিরভাগ সাহায্য আসে বিদেশ থেকে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে যারা আমাদের সাহায্য করবেন, তাদের নিজেদেরই আয় রোজগার নেই। স্থানীয় ব্যবসাবাণিজ্যও বন্ধ, ফলে তাদের কাছ থেকেও তেমন সহায়তা আসছে না।”

তার এই প্রতিষ্ঠানে ১৬ জন শিক্ষক আর ২৩০ শিক্ষার্থী আছে। এখন প্রতিষ্ঠান ছুটি দিয়ে দেয়া হয়েছে। শিক্ষকদের কারো কারো বেতন বাকি পড়েছে। তাদের বলে দেয়া হয়েছে, পরবর্তীতে আয় হলে বেতন দেয়া হবে।

ঢাকার একটি মাদ্রাসা জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া সাত মসজিদ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মাহফুজুল ইসলাম বলছেন, ”করোনাভাইরাসে যে আমাদের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সংকটে পড়েছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। অনেক প্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের বেতন দিতে পারছে না, চালাতে পারছে না। আগে যারা সাহায্য সহযোগিতা করতেন, তাদের ইচ্ছা থাকলেও তারা সেভাবে করতে পারছেন না।”

তাদের এই প্রতিষ্ঠানে ১২০০ শিক্ষার্থী আর শিক্ষক-কর্মচারী মিলে ৮০ জন রয়েছেন।

করোনাভাইরাসের কারণে আয় কমে গেছে কওমি মাদ্রাসাগুলোর
করোনাভাইরাসের কারণে আয় কমে গেছে কওমি মাদ্রাসাগুলোর

সরকারি সহযোগিতা

১৮৬৬ সালে কওমি মাদ্রাসা ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে যে মাদ্রাসাগুলো পরিচালিত হয়ে আসছে, তাদের কোন স্বীকৃতি ছিল না। তবে ২০১৭ সালে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশের সরকার। তবে সেই সময়েও আলোচনায় দেওবন্দের আদলে স্বতন্ত্র ও স্বকীয়তা বজায় রাখতে সরকারের আর্থিক সহযোগিতা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল কওমি নেতারা।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসসের খবর অনুযায়ী, রমজান উপলক্ষে দেশের ছয় হাজার ৯৫৯টি কওমি মাদ্রাসার জন্য আট কোটি ৩১ লাখ ২৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে বাংলাদেশের সরকার। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে সেসব অর্থের বিতরণও শুরু হয়।

কিন্তু কওমি মাদ্রাসার ছয়টি বোর্ডই সিদ্ধান্ত নেয় যে, রীতি মেনে তারা সরকারি এই অনুদান গ্রহণ করবেন না।

তবে বিবিসি জানতে পেরেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানের অনেক কওমি মাদ্রাসা এই অনুদান গ্রহণ করেছে। একেকটি প্রতিষ্ঠান ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার করে টাকা পেয়েছে।

মাওলানা সাইফুল ইসলাম বলছেন, স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা মাধ্যমে তার প্রতিষ্ঠান ১০ হাজার টাকা পেয়েছে।

তবে একই উপজেলার আরেকটি মাদ্রাসা বিলাছড়া মোকামবাজার ইশহাকিয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, তাদের প্রতিষ্ঠান কোন অর্থ সহায়তা পায়নি।

একজন অধ্যক্ষ বিবিসিকে জানিয়েছেন, যদিও সরকারি সাহায্যের পরিমাণ খুবই কম, কিন্তু স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অনুরোধে তারা সেই অর্থ সাহায্য গ্রহণ করেছেন।

কওমি মাদ্রাসাগুলোর ছয়টি শিক্ষা বোর্ডের একটি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক)সহ-সভাপতি মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”আমরা বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছি সরকারি অনুদান গ্রহণ না করার, কারণ কওমি মাদ্রাসার সরকারি অনুদান গ্রহণের রীতি নেই। কিন্তু কোন মাদ্রাসা যদি সেটা নিতে চায়, আমরা কাউকে বাধাও দিচ্ছি না।”

ঢাকার একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মাহফুজুল ইসলাম বলছেন, ”সরকার যে অর্থ সহায়তার কথা বলছে, তা একেকটি মাদ্রাসার আসলে খুব একটা উপকারে আসবে না। কারণ ১০ হাজার, বিশ হাজার টাকা করে দেয়া হলেও, একেকটি মাদ্রাসার মাসিক খরচ এর বহুগুণ বেশি।”

তিনি বলছেন, দেওবন্দের রীতি তো আছেই, সেই সঙ্গে টাকার পরিমাণ কম হওয়ায় বহু মাদ্রাসা আর এটি গ্রহণ করতে আগ্রহী নয়।

আর্থিক অনুদানের অপর্যাপ্ততার কথা মেনে নিয়ে বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শেখ মোঃ আব্দুল্লাহ বলছেন, ”কওমি মাদ্রাসাগুলোকে সাহায্য দিতে যে তালিকা এসেছিল সেটা সম্পূর্ণ তালিকা ছিল না। ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে মাদ্রাসাগুলোকে সাহায্য দেয়ার নতুন একটি তালিকা দেয়া হয়েছে, সেটা এখন বিবেচনায় রয়েছে।”

কওমি মাদ্রাসায় বহু শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়
কওমি মাদ্রাসায় বহু শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়

পরিস্থিতি কীভাবে সামলাচ্ছে কওমি মাদ্রাসাগুলো

ঢাকার একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মাহফুজুর রহমান বলছেন, ”সংকট তো আর চিরদিন থাকবে না। আমরা সবাইকে অনুরোধ করেছি একটু ধৈর্য ধারণ করার। পরিস্থিতি ভালো হলে নিশ্চয়ই সবকিছু আবার আগের মতো হবে।”

দেশের বিভিন্ন স্থানে কওমি মাদ্রাসাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকেই বেশিরভাগ মাদ্রাসা ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নিজ বাড়ি বা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে চলে গেছেন। শিক্ষকদের আংশিক বেতন দেয়া হয়েছে। বাকি টাকা পরবর্তীতে দেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।

কোন কোন মাদ্রাসা রমজানের কারণে কিছুটা আর্থিক সহায়তা পাচ্ছে। আবার অনেকে অপেক্ষা করছেন ঈদুল আযহার জন্য, যে সময় চামড়া সংগ্রহ করে মাদ্রাসাগুলো বড় একটি আয় করে থাকে।

এসব মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষ আশা করছে, লকডাউন উঠে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা আবার স্থানীয় সাহায্য-অনুদান পেতে শুরু করবেন এবং তাদের সংকট কেটে যাবে।

সূত্রঃ বিবিসি