শিরোনাম :

  • বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪

সংকট কাটেনি

জুনায়েদ বাবুনগরীর পদত্যাগ না অপসারণ, ধূম্রজাল

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি |

হাটহাজারী মাদ্রাসার মুঈনে মুহতামিম বা সহকারী পরিচালক পদ থেকে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন নাকি একতরফাভাবে জবরদস্তি তাঁকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে তা নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। বাবুনগরীর বিরোধী ও আল্লামা আহমদ শফির পুত্র আনাস মাদানীর অনুসারীরা প্রচার করছেন যে, শূরা বৈঠকের মাঝামাঝি সময়ে ডাকা হলে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী পদত্যাগপত্র পেশ করেন এবং শুরা তা গ্রহণ করে। পরে আল্লামা শেখ আহমদকে সহকারী পরিচালক ও আল্লামা শফির উত্তরসূরী হিসেবে মনোনীত করেছেন। মাদ্রাসার ফেসবুক পেজেও এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। তবে এ প্রচারণা প্রত্যাখ্যান করেছেন খোদ আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। তিনি রাতেই এক বিবৃতিতে তা নাকচ করে দেন।

বুধবার (১৭ জুন) রাতে সংবাদমাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগের বিষয়টি অসত্য ও ভিত্তিহীন হিসেবে বর্ণনা করেন।

বিবৃতিতে জানানো হয়, মজলিসে শুরার সদস্যদের কাছে হাটহাজারী মাদরাসার মুঈনে মুহতামিম বা সহযোগী পরিচালকের পদ থেকে সরাসরি পদত্যাগ বা পদত্যাগের বিষয়ে কোনো প্রকারের সম্মতি প্রকাশ করেননি আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী।

প্রসঙ্গত, বুধবার শুরা কমিটির বৈঠকে আল্লামা আহমদ শফী আমৃত্যু মাদরাসার মহাপরিচালক পদে থাকবেন বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একইসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ও হেফাজত মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এছাড়াও নতুন করে মুঈনে মুহতামিম হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক মাওলানা শেখ আহমদকে। এরপর সন্ধ্যায় মাদরাসার ফেসবুক পেজে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, ‘আল্লামা শাহ আহমদ শফীর উপস্থিতিতে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের পদ ছেড়ে দিতে সম্মত হয়েছেন।’

কিন্তু বিবৃতিতে আল্লামা বাবুনগরী বলেন, শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী সাহেব হুজুরের সভাপতিত্বে হাটহাজারী মাদরাসার মজলিসে শুরার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকের শেষ পর্যায়ে কিছু বিষয় সম্পর্কে জানতে আমাকে বৈঠকে ডাকা হয়। সেসব বিষয়ে আমার সুস্পষ্ট বক্তব্য শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী সাহেব ও শুরার সদস্যদের সামনে উপস্থাপন করেছি। কিন্তু বৈঠকে শুরা সদস্যদের কাছে মুঈনে মুহতামিমের পদ থেকে পদত্যাগ চাওয়া বা পদত্যাগের বিষয়ে কোনো ধরনের সম্মতি আমি প্রকাশ করিনি এবং বৈঠকে আমাকে মুঈনে মুহতামিমের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার বিষয়ে শুরার সদস্যরা আমাকে কিছুই বলেননি। বৈঠক শেষ হওয়ার অনেক পর একজন সদস্য মুঈনে মুহতামিমের পদ থেকে আমাকে অব্যাহতির বিষয়টি জানিয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, আমি জানতে পেরেছি, মাদরাসার অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে মাওলানা নোমান ফয়জীর বরাতে এবং একটি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় মাওলানা নুরুল আমীন সাহেবের বরাতে প্রচারিত হচ্ছে যে, আমি মজলিসে শুরার সদস্যদের কাছে মুঈনে মুহতামিম বা সহযোগী পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগের সম্মতি প্রকাশ করায় তারা আমাকে পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। অথচ এ কথা ভিত্তিহীন। আমি শুরার সদস্যদের নিকট কোনো পদত্যাগ চাইনি।

এদিকে হাটহাজারী মাদ্রাসার বিভিন্ন ওয়াকিবহাল সূত্র বলছে, পদত্যাগ করতে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে। সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন থেকে শুরু করে হেফাজতে ইসলামের একটি অংশ তাকে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করেন।

হাটহাজারী মাদরাসার শুরা কমিটির সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশের কওমি মাদরাসা, ইসলামী দলগুলোর নেতাকর্মীদের ব্যাপক কৌতূহল ছিল। কিন্তু শুরার বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে দেয়া আল্লামা বাবুনগরীর এ বিবৃতি চলমান সমস্যাকে জটিল আকার দিতে পারে শঙ্কা সচেতন মহলের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বাবুনগরীর নিরাপস বক্তব্য ও অবস্থান কখনোই সন্তুষ্ট হতে পারেনি সরকার। এজন্য তাকে এই পদ থেকে সরাতে সরকারের প্রভাবশালী মহলের চাপ ছিল। তার অনুসারীরা যাতে এ সিদ্ধান্তের কোনোভাবে প্রতিবাদ জানাতে না পারে সেজন্য সরকারের একটি ক্ষমতাধর সংস্থার পক্ষ থেকে তাদের ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে। অনেকের বাসাবাড়িতেও দফায় দফায় হানা দেওয়া হয়েছে। বুধবার শুরা বৈঠকের সময়ও মাদ্রাসা ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রণসাজ ছিল চোখে পড়ার মত।

মাদ্রাসা সংশ্লিষ্ট সূত্রটির দাবি, গত ৮ জুন আল্লামা আহমদ শফী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির পর মাদ্রাসায় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার লোকজনের আসা-যাওয়া বাড়তে থাকে। অনেককে বিভিন্ন জায়গায় ডেকে নেওয়া হয়। এ সময় বেশ কিছু গোপন বৈঠকও হয়েছে মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সদস্যদের সঙ্গে সরকারের ওইসব সংস্থার কর্মকর্তাদের। তবে এসব বিষয়ে কোনও পক্ষই মুখ খোলেনি।

আল্লামা শফীর অবর্তমানে তার উত্তরাধিকারী নির্বাচনের ইস্যুতে তার ছেলে আনাস মাদানীর সঙ্গে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর সম্পর্ক অনেক আগেই শীতল হয়ে যায়। সম্প্রতি আহমদ শফী অসুস্থ হওয়ার পর গত ৮ জুন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হলে বাবুনগরীকে মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ঘোষণা করায় আনাস মাদানি ও তার অনুসারীরা ক্ষুব্ধ হন। সে সময়ে পরিচালনা কমিটির সহকারী পরিচালক থাকায় জুনায়েদ বাবুনগরীকে দারুল উলুম হাটহাজারী মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হিসেবে ঘোষণা দেন তার ঘনিষ্ঠ পক্ষ। তবে এর বিরোধিতা করে আনাস মাদানীর অনুসারী অপর পক্ষ।

উল্লেখ্য, বুধবার সকাল ১০টা থেকে হাটহাজারী মাদরাসায় শুরার বৈঠক শুরু হলেও প্রথম দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে ওই বৈঠকে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে ডাকা থেকে বিরত থাকে কমিটি। পরে দুপুর পৌনে ১টার দিকে তাকে ডাকা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন মাদরাসার মুহতামিম বা মহাপরিচালক আল্লামা আহমদ শফী।