যে কারণে কপাল পুড়ল সাঈদ খোকনের

বিশেষ প্রতিনিধি |

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন থেকে বাদ পড়েছেন মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। তার বদলে মেয়র পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসকে। আওয়ামী লীগের সূত্র মতে, নগরবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে না পারা, বিভিন্ন সময়ে ‍বেফাঁস মন্তব্য, মশা নিধনে ব্যর্থতা ও নগরবাসীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে না পারা ইত্যাদি কারণে দলীয় মনোনয়ন পাননি খোকন।এছাড়া শেখ পরিবারের নানা প্রভাব বলয়ও সাঈদ খোকনের কপাল পোড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে অনেকে মনে করেন।

তবে সাঈদ খোকনের দাবি, তিনি কখনও কর্তব্যে অবহেলা করেননি। 

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, মেয়র হিসেবে সাঈদ খোকন অনেক কাজ করেছেন। কিছু কাজ বাকি রয়েছে। তার আরও কাজ করার সুযোগ ছিল। তবে কিছু বেফাঁস কথাবার্তা তাকে সমালোচিত করেছে।

আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী সূত্র জানায়, সাঈদ খোকন মেয়র হিসেবে পুরো একটি টার্ম দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু এসময় ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি ও বেফাঁস কিছু মন্তব্যের কারণে অনেকবার নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হয়েছেন খোকন। এছাড়া, দলীয় রাজনীতিতেও কোন্দলে জড়িয়ে পড়েন তিনি, যেটা ক্ষমতাসীন দলের ইমেজকে নষ্ট করেছে। এছাড়া, মেয়র হিসেবে খোকন নগরবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারেননি। মূলত এসব কারণেই তাকে বাদ দিয়ে ডিএসসিসির মেয়র পদে এবার নতুন প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ।

গত ২৫ জুলাই রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে এক অনুষ্ঠানে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যাকে ‘গুজব’ বলে অবহিত করেন মেয়র খোকন। তিনি বলেন, ‘মশা নিয়ে রাজনীতি কাম্য নয়। সাড়ে তিন লাখ আক্রান্তের যে তথ্য এসেছে সেটি কাল্পনিক তথ্য। ছেলে ধরা আর সাড়ে তিন লাখ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত একই সূত্রে গাঁথা।’ মেয়রের এমন মন্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ দলের ভেতরে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ’

এর আগে ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর আজিমপুরের পার্ল হারবাল কমিউনিটি সেন্টারের পাশে কর্মী সমাবেশ ডাকে আওয়ামী লীগ। তার পাশেই ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন পাল্টা কর্মসূচি দেন। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেওয়ায় কে বা কারা সমাবেশস্থলের সামনে সিটি করপোরেশনের ট্রাক ভর্তি করে ময়লা রেখে যান। ওই ঘটনার জন্য মেয়র সাঈদ খোকনকেই দোষারোপ করা হয়। এসময়  মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন  মেয়র খোকন। এ নিয়েও দলীয়ভাবে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।

গত শুক্রবার (২৭ ডিসেম্বর) ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘জনপ্রিয়, গ্রহণযোগ্য এবং ভোটারদের কাছে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি রয়েছে, এমন প্রার্থীদের ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন দেওয়া হবে। বিতর্কের ঊর্ধ্বে যারা আছেন, যাদের কোনও অপকর্মের রেকর্ড নেই— তাদের মনোনয়ন দেওয়া হবে। আমাদের নেত্রীরও ইচ্ছা ক্লিন ইমেজের প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়ার।’ দলের সাধারণ সম্পাদকের মুখে এমন ঘোষণার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে মেয়র খোকনের মনোনয়ন নিয়ে নানা কানাঘষা শুরু হয়। ধারণা করা হচ্ছে,  নানা ধরনের বিতর্কিত বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডের কারণেই ইমেজ সংকটে পড়া মেয়র খোকনকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

মেয়র খোকন নির্বাচনের আগে ও পরে নগরবাসীকে বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সেগুলোর পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেননি। তবে অনেক দূর এগিয়েছেন বলে মনে করেন নগর বিশেষজ্ঞরা। তার প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে ছিল— নাগরিকদের জন্য ফুটপাত উন্মুক্ত করে দেওয়া, বুড়িগঙ্গার স্বরূপ ফিরিয়ে আনা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়ন, ডিজিটাল নগরী প্রতিস্থাপন, অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ, মাঠ ও পার্ক উদ্ধার, বাস্তি উন্নয়ন ও যানজট মুক্ত ঢাকা গড়া। এসব প্রতিশ্রুতির মধ্যে পুরোপুরিভাবে কোনোটাই বাস্তবায়ন হয়নি। তবে প্রতিটি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে বলে মনে করছেন নগর বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ ইনিস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘মেয়র খোকনের সামনে ভালো কাজ করার অনেক সুযোগ ছিল। তিনি চেষ্টাও করেছেন। পাঁচ বছর আগের পরিস্থিতি আর বর্তমান পরিস্থিতি এক না। এখন ঢাকায় জনসংখ্যা অনেক বেড়েছে। সমস্যাও বেড়েছে। এখতিয়ার বহির্ভূত কিছু প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন। যে কারণে সব প্রতিশ্রুতি তিনি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তবে আগের চেয়ে ঢাকার অনেক পরিবর্তন হয়েছে।’

সাঈদ খোকন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ হানিফের ছেলে। তিনি পুরান ঢাকার অন্যতম ব্যক্তিত্ব মাজেদ সর্দারের নাতি। বাবা মোহাম্মদ হানিফের হাত ধরেই সাঈদ খোকন রাজনীতিতে নামেন। তিনি আওয়ামী লীগে নাম লেখান ১৯৮৭ সালে ওয়ার্ড শাখার আইন বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে। ১৯৯৯ সালে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ২০০৪ সালে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে মনোনিত হন। সর্বশেষ তিনি মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদে ছিলেন।

২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে ৫ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৬ ভোট পেয়ে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে বিএনপির প্রার্থী মির্জা আব্বাসকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। ৬ মে তিনি মেয়র হিসেবে শপথ নেন।

Print Friendly, PDF & Email