বিবি’র সন্মতিতেই যেভাবে লুট হলো ৮০০ কোটি টাকা

4783_f1অর্থনৈতিক প্রতিবেদক : কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ১০ কোটি ডলার বা ৮০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে হ্যাকাররা। চক্রটি প্রথমে পাসওয়ার্ড হ্যাক করে। পরে আন্তর্জাতিক লেনদেনের নিয়ম অনুসরণের মধ্য দিয়ে জালিয়াতির কাজ সম্পন্ন করে। সেদিন ছিল বন্ধের দিন। রাত ৮টা থেকে ৩টা পর্যন্ত সময়সীমার মধ্যে লোপাট হয়েছে যায় ৮০০ কোটি টাকা।

একপ্রকার বাংলাদেশ ব্যাংকের (বিবি’র) সম্মতিতে টাকাগুলো নিয়ে যায়। অবশ্য তখনও বাংলাদেশ ব্যাংক বুঝতে পারেনি আসল ঘটনা। বাংলাদেশ ব্যাংক বিশ্বের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে যেভাবে লেনদেন করে সেভাবে লেনদেন হয়েছে। প্রথমে টাকার পরিমাণ চেয়ে একটি আবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগে জমা হয়। আন্তর্জাতিক লেনদেনের প্রাক্কালে যেভাবে আবেদন করা হয় এ আবেদনটিও ছিল অনুরূপ। যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক টের পায়নি। নির্ধারিত হিসাবে টাকা চলে যায় এবং নির্ধারিত সময় শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকও বুঝতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে দুই কর্মকর্তাকে পাঠানো হয় তিন দিনের জন্য। কিন্তু তারা টাকার কোনো হদিস পাননি। সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা ১০ থেকে ১২ দিন পর খালি হাতে ফেরেন। তাদের কথায় টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো আশার বাণীও পাওয়া যায়নি। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দাবি করছে- খোয়া যাওয়া ৮০০ কোটি টাকা ফেরত পাওয়া সম্ভব। ইতিমধ্যে কিছু টাকা ফেরত এসেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ফিলিপাইন-ফেরত দুই কর্মকর্তার দেয়া তথ্যে ৮০০ কোটি টাকা ফেরত পাওয়ার লক্ষণ ক্ষীণ। তবুও চেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।

এদিকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়- ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রক্ষিত স্থিতি থেকে ‘হ্যাকড’ হওয়ার সাম্প্রতিক ঘটনায় সংশ্লিষ্ট অর্থের একাংশ ইতিমধ্যে আদায় করা সম্ভব হয়েছে; অবশিষ্ট অঙ্কের গন্তব্য শনাক্ত করে তা ফেরত আদায়ের বিষয়ে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ফিলিপাইনের অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সক্রিয় রয়েছে। ইতিমধ্যে ফিলিপাইনের এন্টি-মানি লন্ডারিং কর্তৃপক্ষ তাদের দেশের আদালতে মামলা করে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবগুলোর ফ্রিজ আদেশ আদালত থেকে সংগ্রহ করেছে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকে দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন সাইবার বিশেষজ্ঞ পরামর্শক ও তার ফরেনসিক অনুসন্ধান টিম এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের টিমের সঙ্গে কাজ করছে। ফিলিপাইনের অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কর্তৃপক্ষের তদন্ত সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অর্থ ফেরত আদায়ে আদালতের আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে এবং প্রয়োজনবোধে বিশ্বব্যাংকের স্টোলেন এসেট রিকভারি প্রক্রিয়াও অবলম্বিত হবে। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে এ বিষয়ে দেশে এবং দেশের বাইরে তদন্তলব্ধ তথ্যাদি অপ্রকাশিত রাখা হচ্ছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বৃহত্তর আর্থিক খাতে সাইবার নিরাপত্তা সার্বিকভাবে নিশ্ছিদ্র করার প্রক্রিয়া জোরালোভাবে সচল রাখা হয়েছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার একটি অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে সাইবার অপরাধীরা। প্রাথমিক তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, চীনা হ্যাকারদের একটি দল বিপুল এ অর্থ প্রথমে ফিলিপাইনের ব্যাংকিং চ্যানেলে নিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে অন্য কোথাও পাচার করে। হ্যাকের মাধ্যমে অর্থ চুরির বিষয়টি জানার পর দ্রুত তৎপরতা শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই অর্থ ফিলিপাইনে স্থানান্তরের বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে সেখানে পাঠানো হয় দুই কর্মকর্তাকে। তারা ১৬ থেকে ১৮ই ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও দেশটির অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কাউন্সিলের (এএমএলসি) সঙ্গে বিশেষ বৈঠক করে এসেছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে বিপুল এ অর্থ চুরির সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ জড়িত থাকতে পারেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের বিনিয়োগ যেভাবে সংরক্ষিত হয়, তাতে ভেতরের কারও সহযোগিতা ছাড়া হ্যাক করে অর্থ চুরি করা খুবই জটিল। বিষয়টি নিয়ে এখন বিস্তারিত তদন্ত শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া দাপ্তরিক কাজে তথ্যপ্রযুক্তির নিরাপদ ব্যবহার ও অনলাইন কার্যক্রমের বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার সতর্কতামূলক একটি অফিস আদেশও জারি করা হয়েছে।
অন্যদিকে ফিলিপাইনের দৈনিক দি ইনকোয়েরার পত্রিকায় গত ২৯শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ থেকে ১০ কোটি ডলার মানি লন্ডারিং হয়েছে বলে খবর প্রকাশ করে। ওই খবরে বলা হয়, দেশটির মাকাতি শহরে অবস্থিত রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের একটি শাখার মাধ্যমে ওই অর্থ ফিলিপাইনে আসে। চীনা হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংক অথবা সেখানকার কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এ অর্থ হাতিয়ে নেয়। হ্যাকার দল এ অর্থ প্রথমে ফিলিপাইনে পাচার করে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অর্থ পাচারের এ ঘটনা তদন্ত করছে ফিলিপাইনের অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কাউন্সিল। বিভিন্ন তথ্যসূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, পরে ওই অর্থ সেখান থেকে ক্যাসিনোসহ একাধিক হাত ঘুরে অন্য দেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচারের তথ্য জানার পর গত ১৪ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একটি বৈঠক করেন। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৬ থেকে ১৮ই ফেব্রুয়ারি তিন দিনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের ডিজিএম জাকের হোসেন ও বিএফআইইউর যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রবকে পাঠানো হয় ফিলিপাইনে। সেখানে গিয়ে এ দুই কর্মকর্তা দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ব্যাংকো সেন্ট্রাল এনজি ফিলিপিনাস’ (বিএসপি) ও অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কাউন্সিলের (এএমএলসি) সঙ্গে আলদা বৈঠক করেন। বিশেষ এ দুটি বৈঠকে হ্যাকার গ্রুপ চিহ্নিত করে টাকা ফেরতের ব্যবস্থার বিষয়ে তাদের সহায়তা চাওয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, রিজার্ভের অর্থ কোন দেশে, কোথায় বিনিয়োগ বা সংরক্ষণ করা আছে তা সুইফট কোডের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বিশ্বব্যাপী সুরক্ষিত হিসেবে বিবেচিত এ নেটওয়ার্ক হ্যাক করে রিজার্ভ থেকে টাকা চুরির ঘটনা ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ঘটেছে। এরপর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ অব বাংলাদেশের (এনপিএসবি) চ্যানেলের মাধ্যমে সুইফট ব্যবহার বন্ধ রাখা হয়েছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নগদ আকারে বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংকে রাখা হয়। বাকি অংশ বন্ড, স্বর্ণ ও অন্যান্য মুদ্রায় বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা হয়। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ হ্যাক করে চীনভিত্তিক একটি গ্রুপ। পরে তা শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনে সরিয়ে নেয় তারা। তবে এর কিছুদিনের মধ্যেই শ্রীলঙ্কায় সরিয়ে নেয়া অর্থ ফেরত আনতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ ব্যাংক ও ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক।

Print Friendly, PDF & Email