শিরোনাম :

  • বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪

এবি পার্টির বাজেট প্রস্তবনা

জানুয়ারি-ডিসেম্বর অর্থবছর ও ব্যক্তি আয়কর সীমা ৪ লাখ নির্ধারণের দাবি

নিজস্ব প্রতিবেদক |

এবি পার্টি (আমার বাংলাদেশ পার্টি) ২০২০-২১ বর্ষে দলের প্রাক বাজেট প্রস্তাবনা তুলে ধরার জন্য এক ফেসবুক ও ইউটিউব লাইভ ব্রিফিং এর আয়োজন করে। মঙ্গলবার (৯ জুন) বিকেল তিনটায় দলের ঢাকা, বিজয় নগরস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে “করোনা আক্রান্ত অর্থনৈতিক দুর্যোগে কেমন বাজেট চাই: সংস্কার ও খাতভিত্তিক সুপারিশ” শীর্ষক বক্তব্য তুলে ধরেন এবি পার্টির আহ্বায়ক এএফএম সোলায়মান চৌধুরী। যিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চেয়ারম্যান, জনতা ব্যাংক চেয়ারম্যান সহ বহু বৃহৎ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। দলের সহকারী সদস্য সচিব আমিনুল ইসলাম এফসিএ-এর সঞ্চালনায় প্রেস ব্রিফিং-এ এবি পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক প্রফেসর ডা. মেজর (অব.) আব্দুল ওহাব মিনার, যুগ্ম সদস্য সচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, ব্যারিস্টার যুবায়ের আহমেদ ভুঁইয়া, সহকারী সদস্য সচিব নাজমূল হুদা অপু, আনোয়ার সাদাত টুটুল, শাহ আব্দুর রহমান প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন।

প্রস্তাবনার উল্লেখযোগ্য কিছু দিক নিম্নরুপ:

  • বাজেট সময়কাল পরিবর্তন করে জানুয়ারী-ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করা
  • সার্বজনীন স্বাস্থ্য বীমা ও সেবা নিশ্চিত করতে জিডিপির কমপক্ষে ১০ শতাংশ তহবিল বরাদ্ধ প্রদান।
  • ঔষধ উৎপাদন, বিতরণ, স্বাস্ব্য সেবার মাননোন্নয়ন, প্রয়োজনীয় মেডিকেল যন্ত্রপাতি, আইসিইউ এবং ভ্যান্টিলেটর মেশিন ক্রয়, সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, কম্যুনিটি-ভিত্তিক চিকিৎসা প্রদানের সক্ষমতা বাড়াতে ব্যায় বরাদ্ধ করা।
  • সরকার উন্নয়ন বাজেটের মাত্র ৬০-৬৫ শতাংশ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম। সে অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে অযথা বিশাল অংকের উন্নয়ন বাজেট না করে ২০২০-২১ অর্থ বছরে বাস্তবভিত্তিক বাজেট ঘোষণা করা।
  • কৃষককে সর্বোচ্চ প্রণোদনা ও কৃষি খাতে বাজেটের কমপক্ষে ১০% বরাদ্দ প্রদান।
  • নিজস্ব আয়কর সীমা ২.৫ লাখ হতে ৪ লাখ টাকা নির্ধারণ।
  • দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ আইন ২০১০” ও দুর্নীতিযুক্ত কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বাতিলের দাবি।
  • বায়ু এবং পানি দূষণ কমাতে, দূষণ কর আরোপ করা। পরিবেশ অধিদফতরকে স্বাধীন এবং সক্ষম প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলা।
  • সুন্দরবন ও অন্যান্য সংরক্ষিত বনাঞ্চলের নিকটে কোন শিল্প ও কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমতি প্রদানের পরিবর্তে ঐসব জায়গায় নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র করা।
  • উপকুলে লবণাক্ততা নিরসনে অধিক মাত্রার লবণ সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন, স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ।
  • ‘শিক্ষা ও গবেষণা তহবিল’ প্রতিষ্ঠা এবং সেখানে প্রতি বছর কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্ধ প্রদান।
  • অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য আমদানিকৃত উপকরণকে সব ধরনের কর হতে অব্যাহতি।
  • প্রত্যেক সক্ষম নাগরিকের সামরিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুপারিশ।

বক্তব্যে বাজেট সময়কাল পরিবর্তন করে জানুয়ারী-ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়। বাজেট বাস্তবায়নে দক্ষতা আনতে যথাযথ জবাবদিহিতা মেকানিজম চালু এবং তিরস্কার/পুরস্কার উভয় প্রণোদনার ব্যাবস্থা করার দাবি জানানো হয়। প্রস্তাবে বলা হয় অর্থমন্ত্রী প্রত্যেক কোয়ার্টার শেষে বাজেটের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রতিবেদন পেশ করবেন এবং পরবর্তী কোয়ার্টারে বাস্তবায়নে দক্ষতা নিশ্চিতে সাংসদরা দিকনির্দেশনা দিবেন।

সোলায়মান চৌধুরী বলেন চীন, কিউবার মতো দেশগুলোর ন্যায় স্বাস্থ্য সেবার মান আন্তর্জাতিক মানে নিতে সার্বজনীন স্বাস্থ্য বীমা ও সেবা নিশ্চিত করতে জিডিপির কমপক্ষে ১০ শতাংশ তহবিল বরাদ্দ প্রদান করতে হবে। তিনি বলেন, বিগত অর্থ বছরের সম্পুরক বাজেট পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সরকার উন্নয়ন বাজেটের মাত্র ৬০-৬৫ শতাংশ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম। সে অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে অযথা বিশাল অংকের উন্নয়ন বাজেট না করে ২০২০-২১ অর্থ বছরে বাস্তবভিত্তিক বাজেট ঘোষণা করা উচিৎ।

দুর্যোগ মোকাবেলায় অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর প্রস্তাব রেখে তিনি বলেন, ২০২০-২১ অর্থ বছরের বাজেট গতানুগতিক বাজেটের চেয়ে মন্দাকালীন বাজেট (স্বল্প মেয়াদে ডিসেম্বর ২০২০ সহ) করা, নিজস্ব আয়কর সীমা ২.৫ লাখ হতে ৪ লাখ টাকায় নির্ধারণ, এসএমই’র টার্ণওভারের ওপর সব ধরনের কর হার স্থগিত রাখা, রাজস্ব আদায় ব্যাবস্থা পূর্ণাঙ্গ অটোমেশনের মাধ্যমে সব ধরনের কর ফাঁকি বন্ধ করে প্রাক্কলিত কর আদায় করার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন ২০২০-২১ অর্থ বছরের বাজেটে কৃষিতে কমপক্ষে বাজেটের ১০% বরাদ্দ প্রদান, কৃষককে সর্বোচ্চ প্রণোদনা এবং ন্যায্য মূল্য ন্যায্যমূল্যে ধান ক্রয়, কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, সরকারি বিনিয়োগে কম্যুনিটি ফার্মিং চালু, কৃষিভিত্তিক খামার/শিল্প স্থাপনে সকল প্রান্তিক কৃষককে/বিদেশ ফেরত শ্রমিকদের জামানতবিহীন দীর্ঘমেয়াদী সুদমুক্ত ঋণ প্রদান করতে হবে।

লিখিত প্রস্তাবে বাজেটে নগদ অর্থ সহায়তা, বেকার ভাতা প্রদান, রেশনিং ব্যাবস্থা, শিশু সহায়তা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, আবাসন সহায়তা, স্বাস্থ্য ভাতা সহ বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা খাতে বিদ্যমান বরাদ্দ বাড়িয়ে জিডিপির কমপক্ষে ১০ শতাংশ করার আহবান জানানো হয়। ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর নির্ভরযোগ্য তালিকা প্রণয়ন করে ব্রাজিলের বলছা এবং ভারতের আধার ব্যাবস্থার ন্যায় সুবিধাভোগীদের স্বচ্ছ ডাটাবেজ তৈরি এবং সে অনুযায়ী ঝুকিতে থাকা প্রায় ৩৫ শতাংশ মানুষ বা তাদের পরিবার প্রতি মাসে কমপক্ষে ১০,০০০ টাকা সরাসরি নগদ অর্থ সহায়তা পায় তার ব্যাবস্থা করার আহবান জানানো হয়।
পরিবেশ সংক্রান্ত প্রস্তাবে বলা হয়- বায়ু এবং পানি দূষণ কমাতে, দূষণ কর আরোপ করতে হবে। পরিবেশ অধিদফতরকে স্বাধীন এবং সক্ষম প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তুলতে আইনের সংশোধন, সক্ষমতা বৃদ্ধি, মানব সম্পদ এবং আর্থিক বরাদ্দ বাড়াতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষা প্রদান সহ জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতিনিধিত্ব করে ‘‘জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সুরক্ষা বোর্ড/পরিষদ” গঠন করতে হবে। সুন্দরবন ও অন্যান্য সংরক্ষিত বনাঞ্চলের নিকটে কোন শিল্প ও কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমতি প্রদানের পরিবর্তে ঐসব জায়গায় নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র করতে হবে। উপকুলে লবণাক্ততা নিরসনে অধিক মাত্রার লবণ সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন, স্থায়ী বাধ নির্মাণ ও তার রক্ষণাবেক্ষণে কম্যুনিটি নেতৃত্বাধীন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং বাধের দুই পাশে পরিকল্পিত ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় তহবিল প্রদান করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা প্রস্তাবিত বাজেটে টেকসই জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতে অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতি রোধ এবং উৎপাদনে প্রতিযোগিতা আনতে “দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ আইন ২০১০” ও দুর্নীতিযুক্ত কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বাতিল করার দাবি জানাচ্ছি । কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবর্তে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ জ্বালানি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা, দেশীয় প্রমাণিত এবং সম্ভাব্য গ্যাস এবং তেল নিজস্ব সক্ষমতায় উত্তোলনের জন্য বাপেক্সকে প্রয়োজনীয় তহবিল প্রদান করার প্রস্তাব করছি।
বাজেটে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করে তিনি বলেন, আসন্ন বাজেটে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের জন্য ৫০০০ কোটি টাকার তহবিলের ব্যবস্থা করার দাবি জানাচ্ছি। আইন-শৃংখলা বাহিনী, সরকারি সেবা প্রদান সহ সব ধরনের সরকারি ক্রয়ে দুর্নীতি রোধ করতে পুর্নাঙ্গ অটোমেশন, ই-প্রকিউরমেন্ট প্রচলন করতে হবে। রাজস্ব সংগ্রহ ও প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতির সুযোগ কমাতে আইসিটি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সর্বাধিক ব্যবহার করতে হবে।
বাজেট বাস্তবায়নে শুদ্ধাচার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে সরকারি সেবা খাতগুলোতে (যেমন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, পাসপোর্ট, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার ইত্যাদি) নজরদারি বাড়াতে হবে। বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ও মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এর কার্যালয় (সিএন্ডএজি) এর সক্ষমতা বাড়ানো এবং বিদ্যমান সরকারি ক্রয় আইন এবং বাস্তবায়ন নীতিমালায় ‘সামাজিক জবাবদিহিতা টুলস’ বা কমিউনিটি-নেতৃত্বাধীন নাগরিক তদারকি/নজরদারি ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা বাড়াতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের অবশ্যই নিজস্ব আচরণবিধি এবং কার্যকর শুদ্ধাচার ব্যাবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

জনাব চৌধুরী বলেন, ‘আয় বুঝে ব্যায়’ এ নীতি মেনে ২০২০-২১ অর্থ বছরের বাজেটে রাজস্ব আয় এবং ব্যয়ের ভারসাম্য বজায় রাখা উচিত। একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও জীবন সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট ঘোষণা করতে হবে। অভ্যন্তরীণ উৎস হতে অর্থায়নে বিদ্যমান কর-জাল কে সম্প্রসারিত করে ধনীদের সম্পদের ওপর ‘কল্যাণ-কর’ আরোপ করা যা বিদ্যমান সম্পদ করের চেয়ে আরো বেশি অর্থবহ হবে।
প্রস্তাবনায় অতিরিক্ত বরাদ্দকৃত বাজেট ঔষধ উৎপাদন এবং বিতরণ, স্বাস্ব্য সেবার মাননোন্নয়ন, প্রয়োজনীয় মেডিকেল যন্ত্রপাতি, আইসিইউ এবং ভ্যান্টিলেটর মেশিন ক্রয়, সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, কম্যুনিটি-ভিত্তিক চিকিৎসা প্রদানের সক্ষমতা বাড়াতে ব্যায় করার দাবি জানানো হয়। তিনি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারীর সংক্রমণ রোধে সরকারি, দক্ষ চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিষ্ট নিয়োগ করতে হবে।
শিক্ষা প্রসঙ্গে প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, সৃজনশীল জ্ঞানার্জন এবং গবেষণায় যেন ছাত্র-ছাত্রীরা স্বউদ্যোগী হয়ে নিয়োজিত হয় এজন্য গবেষণা, সৃজনশীলতা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় তহবিল বরাদ্দ করা উচিত। ‘শিক্ষা ও গবেষণা তহবিল’ প্রতিষ্ঠা করা এবং সেখানে প্রতি বছর কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করতে হবে। তিনি বলেন সরকার কেবল গরিব ও মেধাবীদের বৃত্তি প্রদান করবে। অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য আমদানিকৃত উপকরণকে সব ধরনের কর হতে অব্যাহতি প্রদান করতে হবে।
প্রস্তাবে প্রত্যেক সক্ষম নাগরিকের সামরিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়। যার মধ্যে, জনস্বাস্থ্য, নাগরিক দায়িত্বশীলতা, পরিবেশ সচেতনতা এবং নৈতিক মূল্যবোধের প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত থাকবে বলে মত প্রকাশ করা হয়।