শিল্পে ৪ ঘন্টা গ্যাস বন্ধের নজীরবিহীন সিদ্ধান্তে বহুমাত্রিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা
এ আই এন হুদা :
শিল্প কারখানায় ৪ ঘন্টা করে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখার নজীরবিহীন সিদ্ধান্তে উৎপাদন খাতে মারাত্মক বিপর্যয়ের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এমন সিদ্ধান্তে পুরো রপ্তানি খাতের উৎপাদন ব্যাহত হবে। সময়মতো অর্ডার শিপমেন্ট করতে না পারলে পেমেন্ট পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। যার প্রভাব পড়বে আসন্ন ঈদে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধে।
রমজান মাসে প্রতিদিন শিল্প-কারখানায় ৪ ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় এ শঙ্কার কথা জানিয়েছেন শিল্প মালিকরা। তাদের আরও অভিমত-এই মুহূর্তে তৈরি পোশাক শিল্পে অনেক অর্ডার আছে। ক্রেতাদের সময়মতো পণ্য ডেলিভারি দিতে না পারলে অর্ডার হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় সরকার গ্যাসের রেশনিং -এর নামে চার ঘন্টা বন্ধ রাখায় রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প নতুন চ্যালেঞ্জে পড়তে যাচ্ছে।
এই খাতের কারখানাগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি সম্পর্কিত। যেমন স্পিনিং মিলগুলো তুলা থেকে সুতা বানায়, তা দিয়ে কাপড় বানায় টেক্সটাইল মিল। আর সেই কাপড় গার্মেন্টসে সেলাই করে রপ্তানি করা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ডাইং, ফিনিশিং ও প্রিন্টিং কারখানাগুলো। কারণ ৪ ঘণ্টা গ্যাস বন্ধ থাকলে এসব শিল্পের ডাইস, কেমিক্যাল ও রং নষ্ট হয়ে যাবে। এতে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যেতে পারে।
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গ্যাস নিয়ে শিল্প মালিকরা খুব দুশ্চিন্তায় আছে। ঈদে বেতন-বোনাস দেওয়ার জন্য শ্রমিকদের অতিরিক্ত কাজ করানোর পরিকল্পনা ছিল অনেকের। কিন্তু এখন অতিরিক্ত কাজ তো দূরের কথা রেগুলার কাজও করানো যাবে না। আর যথাসময়ে শিপমেন্ট করতে না পারলে পণ্য বিমানে পাঠাতে হবে অথবা ক্রেতাদের ডিসকাউন্ট দিতে হবে। এ কারণে অনেকেই ঈদে বেতন-বোনাস দিতে পারবেন না বিধায় শ্রমিক অসন্তোষের আশঙ্কা রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য এখন ‘গোল্ডেন টাইম’। আমরা সেই সুযোগ কতটুকু কাজে লাগাতে পারব তা নিয়ে সন্দিহান। চীন-ভিয়েতনামে লকডাউন এবং শ্রীলংকা পাকিস্তানে রাজনৈতিক অসন্তোষ বিদেশি ক্রেতাদের বাংলাদেশমুখী করেছে। পোশাক সোর্সিংয়ের জন্য তারা বাংলাদেশকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। এর সুফলও হাতেনাতে দেখা যাচ্ছে। অনেক অর্ডার আসছে। এ সুযোগে রপ্তানি আরও বাড়ানোর সুযোগ আছে। কিন্তু গ্যাস রেশনিং করায় শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হবে। কমিটমেন্ট অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করতে না পারলে এ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তারপরও দেশের মানুষের স্বার্থে শিল্প মালিকদের বেঁধে দেওয়া সময়মতো কারখানা বন্ধ রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।
বিজিএমইএর সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, এখন গ্যাস রেশনিং করার উপযুক্ত সময় নয়। এ বিষয়ে সারা দেশ থেকে গার্মেন্ট মালিকরা ফোনে তাদের হতাশার কথা জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, ঈদকে কেন্দ্র করে পুরোদমে কারখানাগুলো প্রডাকশন করছে। অনেক কারখানা সময়মতো অর্ডার দিতে ৩ শিফটেও কাজ করাচ্ছে। এ অবস্থায় রেশনিং করা হলে উৎপাদনে ধস নামবে। বিধায় ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেওয়াও কঠিন হয়ে পড়বে। তাই সরকারকে শিল্পের স্বার্থে রেশনিংয়ের পরিবর্তে বিকল্প চিন্তা করতে হবে।
গ্যাস সংকট মোকাবিলায় সোমবার রাজধানীর বিদ্যুৎ ভবনে শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। বৈঠকে ইফতার ও তারাবির নামাজের সময় লোডশেডিং কমিয়ে আনতে বিকাল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত শিল্প কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পেট্রোবাংলা শিল্প শ্রেণির গ্রাহকদের গ্যাস ব্যবহার বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, গ্যাস রেশনিংয়ে কাপড় উৎপাদন বন্ধ রাখা গেলেও ফেব্রিক্স ডাইং, প্রসেসিং নিয়ে শিল্প মালিকরা বেশি চিন্তিত। কাপড়ের এক ব্যাচ ডাইং করতে ৮-১২ ঘণ্টা লাগে। ৪ ঘণ্টার গ্যাস না থাকা মানে পুরো এক শিফট বন্ধ রাখা। আবার এমন বয়লার আছে যেগুলো চালু করতে ও বন্ধ করতে ১ ঘণ্টা সময় লাগে। এ অবস্থায় পুরো টেক্সটাইল খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তিনি আরও বলেন, করোনার ২ বছরে স্থানীয় মিল মালিকরা খুবই সংকটাপন্ন অবস্থায় ছিলেন। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এখন অর্থনীতি স্বাভাবিক হওয়ায় ঈদে সেই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েছিলেন মিল মালিকরা। কিন্তু রেশনিংয়ের ফলে টেক্সটাইল শিল্প রুগ্ণ হওয়ার পাশাপাশি শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধে নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
মালিকরা জানাচ্ছেন- অতীতে অন্যান্য খাতে গ্যাস রেশনিং-এর নজীর থাকলেও শিল্পে গ্যাস রেশনিং বাংলাদেশের ইতিহাসে এ প্রথম। গ্যাস বন্ধের নজীরবিহীন এ সিদ্ধান্তে পোশাক শিল্প বহুমাত্রিক চাপে পড়বে। প্রথমত; ডাইং-ফিনিশিংয়ের উৎপাদন ৩০-৪০ শতাংশ কমে যাবে। সামগ্রিক উৎপাদনে যার প্রভাব পড়বে। দ্বিতীয়ত; ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন-বোনাসের চাপ থাকে। যথাসময়ে শিপমেন্ট করতে না পারলে পেমেন্ট পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়বে। তখন শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। তৃতীয়ত; বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের কারণে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের নতুন অর্ডার আসছিল। কমিটমেন্ট অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করতে না পারলে সেই সব অর্ডার ধরে রাখা যাবে না।