শিরোনাম :

  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪

ডলারের বিপরীতে টাকার রেকর্ড মানহানি

ডলারের বিপরীতে টাকার রেকর্ড মানহানি

আতাউর রহমান।।

একদিনেই ইতিহাসের সর্বোচ্চ দরপতন দেখল বাংলাদেশী মুদ্রা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষণা অনুযায়ী, সোমবার প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৯৬ টাকা। একদিনের ব্যবধানে মঙ্গলবার প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ১০৬ টাকা ১৫ পয়সা পর্যন্ত উঠেছে। আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে লেনদেন হওয়া ডলারের এ দরকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে একদিনের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে সাড়ে ১০ শতাংশেরও বেশি টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। ডলারপ্রতি বিনিময় মূল্য ১০ টাকা ১৫ পয়সা পর্যন্ত বেড়েছে। আর গত ছয় মাসে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ২৩ শতাংশেরও বেশি।

এদিকে টাকার রেকর্ড পতনের দিনে সচল হয়েছে দেশের আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজার। প্রায় ছয় মাস পর গতকাল এ বাজারে আটটি ব্যাংক ডলার বিক্রি করেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২০ লাখ ডলার করে বিক্রি করেছে বেসরকারি খাতের দ্য সিটি ব্যাংক ও ডাচ্-বাংলা। প্রতি ডলার ১০৫ টাকা দরে বিক্রি করেছে ব্যাংক দুটি। আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে মঙ্গলবার ডলার বিক্রি করা অন্য ব্যাংকগুলো হলো মিউচুয়াল ট্রাস্ট, প্রাইম, প্রিমিয়ার, ঢাকা, ইস্টার্ন ও ব্র্যাক ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এখন থেকে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। বরং বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) পক্ষ থেকে ডলারের যে দর নির্ধারণ করা হবে, বাংলাদেশ ব্যাংক সেটিই আমলে নেবে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকাতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বাধ্য না হলে ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে কোনো ব্যাংকের কাছে আর ডলার বিক্রি করবে না। ব্যাংকগুলো নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজার থেকেই ডলার কিনবে।

 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলামও প্রায় একই কথা বলেছেন।  তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন থেকে ডলারের কোনো দর নির্ধারণ করবে না। বাফেদার পক্ষ থেকে যে দর নির্ধারণ করা হবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটির স্বীকৃতি দেবে। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ডলারের যে দর ঘোষণা করা হয়েছে, সেটি বাফেদার নির্ধারিত দর।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ডলারের সর্বনিম্ন দর ঘোষণা করা হয়েছে ১০১ টাকা ৬৭ পয়সা আর সর্বোচ্চ ১০৬ টাকা ১৫ পয়সা। ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা দরটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করল কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে সিরাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ঘোষণা দেয়নি। ভবিষ্যতেও আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেবে না। বাফেদা ডলারের যে বিনিময় হার নির্ধারণ করেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটি আমলে নিল। কোনো ব্যাংক ঘোষণার বাইরে গিয়ে ডলার কেনাবেচা করছে কিনা সেটি আমরা তদারক করব।

ডলারের বাজার স্থিতিশীল করতে ১১ সেপ্টেম্বর বাফেদা ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) শীর্ষ নেতারা বৈঠকে বসেন। ওই বৈঠকে ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা এক দরে ডলার বেচাকেনার সিদ্ধান্ত নেন। রেমিট্যান্স হাউজগুলোর কাছ থেকে সর্বোচ্চ ১০৮ টাকা আর রফতানি বিলের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৯৯ টাকায় ডলার কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। দুই সংগঠনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় থেকে কেনা ডলারের সঙ্গে ১ টাকা মুনাফা যোগ করে বিক্রি করার কথা। এ হিসাবে আমদানিকারকদের সর্বোচ্চ ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা দরে ব্যাংক থেকে ডলার কেনার সুযোগ তৈরি হয়।

ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ব্যাংকগুলো প্রতি পাঁচদিনে ডলার কেনার গড় দাম হিসাব করে বাফেদাকে জানাবে। বাফেদা সব ব্যাংকের তথ্য নিয়ে প্রতিদিন ডলারের ক্রয় ও বিক্রয়মূল্য ঘোষণা করবে। সোমবার থেকে দুই সংগঠনের নেয়া সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে। বাফেদার তথ্য অনুযায়ী, গতকাল দেশের ব্যাংকগুলোর ডলার কেনার গড় মূল্য ছিল ১০৩ টাকা ৩০ পয়সা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাফেদার সিদ্ধান্ত আমলে নিয়ে এদিন ডলারের সর্বোচ্চ দাম ১০৬ টাকা ১৫ পয়সা ঘোষণা দিয়েছে।

এতদিন বাংলাদেশ ব্যাংক যে দামে ডলার বেচাকেনা করত সেটিকেই আন্তঃব্যাংক দর বিবেচনা করা হতো। নিজেদের ঘোষণা করা দরই ওয়েবসাইটে উল্লেখ করত বাংলাদেশ ব্যাংক। আগের অবস্থান থেকে সরে এসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মঙ্গলবার বাফেদার ঘোষণা করা ডলারের বিনিময় মূল্য ওয়েবসাইটে আপলোড করেছে। ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, টাকা ও ডলারের বিনিময় মূল্য ব্যাংকগুলো নির্ধারণ করেছে। চাহিদা ও জোগান এবং বাফেদার নির্ধারণ করা দামের ভিত্তিতে ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক দৈনন্দিন ভিত্তিতে ডলার কেনাবেচার মধ্যে নেই। তবে বাজার বিবেচনায় প্রয়োজন হলে কেনাবেচা করবে।

ডলারের সর্বোচ্চ মূল্য ১০৬ টাকা উল্লেখ করলেও গতকাল ৯৬ টাকা দরে রিজার্ভ থেকে ৪ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের এখন পর্যন্ত রিজার্ভ থেকে ২৮০ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। গত অর্থবছরে (২০২১-২২) রিজার্ভ থেকে বিক্রি করতে হয়েছিল ৭৪০ কোটি ডলার। বৈদেশিক ঋণ ও আমদানি দায় পরিশোধ করতে গিয়ে চলতি বছরের শুরু থেকে রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। গত বছরের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়া রিজার্ভ এখন ৩৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। রিজার্ভের অব্যাহত পতন ঠেকাতে ডলারের বিনিময় হার আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এখন বাড়লেও আগামী সপ্তাহে ডলারের দাম কমে আসবে বলে মনে করেন দ্য সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন। তিনি বলেন, বাফেদা ও এবিবি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার ফল পেতে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দেশের কোনো ব্যাংকই এখন ১০৮ টাকার বেশি দরে রেমিট্যান্সের ডলার কিনছে না। আগে ব্যাংকগুলো ১১০-১১৫ টাকায়ও রেমিট্যান্স কিনেছে। গতকাল ব্যাংকগুলোর কেনা ডলারের গড় মূল্য পড়েছে ১০৩ টাকা ৩০ পয়সা। সিটি ব্যাংক এদিন ১০৫ টাকা দরে আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে ২০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে। আশা করছি, ১৯ সেপ্টেম্বর ডলারের প্রকৃত বিনিময় মূল্য জানা যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চেও প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৬ টাকা। গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতি ডলার ১০৬ টাকা ১৫ পয়সায় গিয়ে ঠেকল। এ হিসাবে মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হলো ২৩ শতাংশেরও বেশি। আর গত এক যুগের হিসাব আমলে নিলে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশী মুদ্রা টাকা ৫৬ শতাংশ দর হারাল। ২০১০ সালে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৬৮ টাকা।