শিরোনাম :

  • শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪

জালিয়াতি, মিথ্যা তথ্য ও প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ নিলে বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞাসহ নানা ব্যবস্থা

সংসদ রিপোর্টার ।।

ঋণ জালিয়াতি ও বেনামি ঋণ ব্যাংক খাতে বহুদিন ধরেই ব্যাপক আলোচিত ঘটনা। এভাবে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করলেই এখন থেকে তা ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি’ হিসেবে গণ্য করা হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির এমন সংজ্ঞা নির্ধারণসহ বেশকিছু পরিবর্তন এনে ব্যাংক কোম্পানি আইনে আবারও সংশোধনী এনে বুধবার (২১ জুন) সংসদে বিল পাশ হয়েছে। পাশকৃত বিলটিতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিদেশভ্রমণ, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু ও পাঁচ বছর পর্যন্ত  ব্যাংকে পরিচালক পদে থাকতে না পারার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।

বিলে বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঐ তালিকা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পাঁচ বছর পার না হওয়া পর্যন্ত কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না। কোনো ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ইচ্ছাকৃত খেলাপির তালিকা না পাঠালে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা জরিমানা করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গতকাল সংসদে ‘ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) বিল-২০২৩’ পাশের প্রস্তাব তুললে তা যাচাই-বাছাইয়ের দাবি জানান জাতীয় পার্টির (জাপা) সংসদ সদস্যরা। জাপার এমপি ফখরুল ইমাম বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে এসব সংশোধনী আনা হয়েছে এবং সংসদে কোনো কিছু গোপন করা উচিত নয়। এটি পাশের আগে আরো যাচাই-বাছাই প্রয়োজন। দলটির অন্য সদস্যরাও বিলটি ফেরত নিয়ে আরো যাচাই-বাছাইয়ের প্রস্তাব দেন। তবে তাদের প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী নাকচ করে দিলে প্রতিবাদে তারা কিছুক্ষণের জন্য অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করেন।

১৪ বছরে খেলাপি ঋণ ১৩.২ থেকে ৮.৬ শতাংশে নেমেছে: অর্থমন্ত্রী

জাপার এমপিদের বক্তব্যের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, কারো পরামর্শে এ সংশোধনী আনা হচ্ছে না। আধুনিক ও সময়োপযোগী ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই এসব সংশোধনী আনা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, গত ১৪ বছরে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৩.২ শতাংশ থেকে ৮.৬ শতাংশে নেমে এসেছে। সরকারি তহবিল থেকে এখন আর মূলধন নিতে হয় না রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে। তাই আগের চেয়ে আর্থিক খাতের পরিস্থিতি ভালো। ফলে সাত গুণ বেড়েছে আমানতের হার। ব্যাংককে মোট আমানতের পরিমাণ বেড়ে এখন ১৬ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

৩২ বছরে ব্যাংক কোম্পানি আইন সাত বার সংশোধন

‘ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) বিল-২০২৩’ গত ৮ জুন সংসদে উত্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। সাত দিনের মধ্যে বিলটি পরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ঐদিন সেটি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। সংসদীয় কমিটি এক বৈঠকে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে সংসদে প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। এর আগে গত মার্চে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের শর্ত মেনে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনের খসড়া অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। উল্লেখ্য, গত ৩২ বছরে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন হয়েছে সাত বার। এর মধ্যে ব্যাংকমালিকদের চাপে এক পরিবার  থেকে চার জন এবং টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকার সুযোগ দিয়ে সর্বশেষ আইন সংশোধন করা হয় ২০১৮ সালে।

‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’র সংজ্ঞা

পাস হওয়া বিলে প্রথমবারের মতো ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞা দেওয়াসহ তাদের সুবিধা কমানোর প্রস্তাব রয়েছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি কারা হবেন, সে বিষয়েও সুস্পষ্ট তালিকা দেওয়া হয়েছে। ঋণ শোধ করছেন না, এমন গ্রাহকদের মধ্যে যারা সামর্থ্য থাকার পরেও শোধ করবেন না এবং জালিয়াতি, মিথ্যা তথ্য ও প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ নেন, তারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবেন। এছাড়া এক উদ্দেশ্যে ঋণ নিয়ে অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলে ও ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া জামানত হস্তান্তর করলেও খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবেন।

ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাবে ব্যাংকগুলো

বিলে বলা হয়েছে, পরিচালনা পর্ষদের সদস্য বা আত্মীয় যে-ই হোক না কেন, তাদের সবাইকে জামানত দিয়ে ঋণ নিতে হবে। ব্যাংকগুলো ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের তালিকা করে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাবে। আর ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিদেশভ্রমণ, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু ইত্যাদি বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে সরকার।

এখন এক পরিবার থেকে পরিচালক হতে পারবেন তিন জন

বিদ্যমান আইনে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবার থেকে পরিচালক হতে পারেন চার জন এবং টানা ৯ বছর তারা পর্ষদে থাকতে পারেন। গতকাল পাশ হওয়া বিলে সংশোধনী এনে বলা হয়েছে, একই পরিবার থেকে সর্বোচ্চ তিন জন পরিচালক হতে পারবেন। কোনো ব্যাংকে ন্যূনতম তিন জন স্বতন্ত্র পরিচালকসহ সর্বোচ্চ ২০ জন পরিচালক থাকবেন। স্বতন্ত্র পরিচালক হবেন এমন ব্যক্তি, যার সঙ্গে ব্যাংক বা ব্যাংকের কোনো ব্যক্তির অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যত্ স্বার্থের কোনো বিষয় জড়িত নেই।

প্রথমবারের মতে বিকল্প পরিচালক নিয়োগের সুযোগ

বিকল্প পরিচালকের বিষয়ে বিলটিতে নতুন ধারা সংযোজন করে বলা হয়েছে, কোনো পরিচালক বিদেশে তিন মাস টানা অবস্থান করলে তার অনুপস্থিতির কারণে পর্ষদ মূল পরিচালকের বিপরীতে বছরে সর্বোচ্চ একবার তিন মাসের জন্য বিকল্প পরিচালক নিয়োগ দিতে পারবে। উল্লেখ্য, এত দিন ব্যাংকে বিকল্প পরিচালক নিয়োগের বিধান ছিল না।

সাধারণ পরিচালক নিয়োগের বিষয়ে এত দিন নিয়ম ছিল কোনো ব্যক্তি কোনো ব্যাংক কোম্পানির পরিচালক থাকলে, একই সময়ে তিনি অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না। তবে দুই  মেয়াদে বিমা কোম্পানির পরিচালক থাকতে পারবেন। নতুন সংশোধনীতে বলা হয়েছে, এখন বিমা কোম্পানির পরিচালকও হতে পারবেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ছাড়া কোনো ব্যাংকের পরিচালক এবং পরিচালকের পরিবারের সদস্যদের বা কোনোভাবে তাদের নিয়ন্ত্রিত কোনো প্রতিষ্ঠানের সুদ বা মুনাফা মওকুফ করা যাবে না।

সবলের সঙ্গে দুর্বলের একীভূত হওয়ার সুযোগ

সংসদে পাশ হওয়া বিলে সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকের একীভূত হওয়ার সুযোগের কথা বলা হয়েছে। তবে, আইনের খসড়া যেভাবে করা হয়েছিল, তা থেকে অনেকটাই বদলে গেছে। খসড়ায় বলা হয়েছিল, কোনো ব্যাংক তার বিদ্যমান আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে বা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে মনে করলে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক তখন ব্যাংকটিকে পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা করবে। এর আগে একটি পুনরুদ্ধার কর্মপরিকল্পনা বাংলাদেশ ব্যাংকে দাখিল করবে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। বাংলাদেশ ব্যাংক দুই বছর সময় দিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে কি না দেখবে। পুনরুদ্ধার কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হলে অবসায়ন হবে ব্যাংকটির।

পাশ হওয়া ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনী বিলে বলা হয়েছে, ব্যাংকের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে আশু সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যাংকের কার্যাবলি এবং তার পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে নির্দেশনা দিতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক যদি পুনরুদ্ধার কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয় এবং আমানতকারীদের জন্য ক্ষতিকর কার্যকলাপ অব্যাহত রাখে, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক বাধ্যতামূলকভাবে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একত্রীকরণ বা পুনর্গঠন বিষয়ে এক বা একাধিক বিশেষ ব্যবস্থা নেবে।