বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি

দ্রব্যমূ্ল্য বৃদ্ধি ও শিল্পখাতে বিপর্যয়ের আশংকা

নিজস্ব প্রতিবেদক: বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধির ফলে সব ধরনের পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। আগুন জ্বলবে নিত্যপণ্যের বাজারে। শিল্প খাতে নামবে বিপর্যয়। বাড়বে সেবার খরচ। এর প্রভাবে মানুষের জীবনযাত্রার সার্বিক ব্যয় বাড়বে। সেবা ও পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে রফতানি পণ্যের দামও বাড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে বাংলাদেশ।

সূত্র জানায়, সব ধরনের শিল্প খাতে বিদ্যুতের ব্যবহার রয়েছে। শহরের পাশাপাশি গ্রামের মানুষও এখন বিদ্যুৎনির্ভর হয়ে পড়েছে। কাজেই বিদ্যুতের দাম বাড়লে মানুষের জীবন মানেও তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ে। শিল্প খাতে মোট উৎপাদন খরচের মধ্যে ১৫ শতাংশ প্রভাবিত করে বিদ্যুৎ। এর দাম বাড়ার কারণে ব্যবসা খরচ যেমন বাড়বে, তেমনি বাড়বে পণ্যের দাম। ফলে পণ্য কিনতে বেশি খরচ করতে হবে ভোক্তাদের।

সারা দেশে গণপরিবহনের একটি বড় অংশ চলে বিদ্যুতে। এগুলোর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত অফিসগুলোতে বিদ্যুতের ব্যবহার হচ্ছে। ফলে এ খাতে বাড়তি ভাড়া গুনতে হবে। বিদ্যুৎ ছাড়া ভোক্তাদের জীবনযাত্রা অচল। ফলে আবাসিকে বিদ্যুতের খরচও বাড়বে। সব শিল্প খাতেই বিদ্যুতের ব্যবহার রয়েছে। এতে বাড়বে শিল্প পণ্যের উৎপাদন খরচ। এ কারণে বাড়বে পণ্যের দাম। পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে বাড়াতে হবে রফতানি মূল্য। তখন বিদেশের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যকে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম শনিবার যুগান্তরকে বলেন, এমনিতে শিল্প খাত বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে। এরপর করোনাভাইরাসের কারণে পুরো খাত স্থবির। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ-পানির দাম বাড়ানো হল।

এর মানে হল, যারা এ পলিসি করেন, তারা শিল্পের কথা ভাবেন না। শিল্পপ্রতিষ্ঠান বাঁচল না মরল, তাতে তাদের কিছু আসে যায় না। সাধারণ ভোক্তাদের কথাও ভাবেন না তারা। নিজেদের মতো করে অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন। দ্বিতীয়ত, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হল কেন। দাম বাড়ানোর আগে একটি গণশুনানির আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। ওই গণশুনানিতে দাম না বাড়ানোর পক্ষে অনেক যুক্তি তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু তার কোনো কিছুই

আমলে নেয়নি কমিশন। ফলে এ ধরনের গণশুনানি লোক দেখানো। এটি বন্ধ করা উচিত। মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি ও লুটপাট চলছে। দাম বাড়ানোর আগে এটি বন্ধ করতে হবে। তার মতে, বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে যোগসাজশে কেউ কেউ অবৈধ লাইন নিয়ে ব্যবসা করছে। কিন্তু যারা নিয়ম মেনে ব্যবসা করছেন, তাদের এর মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে। কোনোভাবেই এটি যৌক্তিক নয়।

এদিকে বিদ্যুৎ-পানির দাম বাড়ানোয় আবারও বাজারে আগুন জ্বলবে বলে সতর্ক করে দিয়েছে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। ক্যাব চট্টগ্রাম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শনিবার এসব কথা বলে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি উল্লেখ করা হয়, মুজিববর্ষে জনগণ আশা করেছিল ভোগ্যপণ্য, বিদ্যুৎ-পানি ও গ্যাসের মূল্য এ বছরে তাদের নাগালের মধ্যে থাকবে। কিন্তু বছরের শুরুতেই একসঙ্গে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানো হয়েছে।

ইতিমধ্যেই সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে হুহু করে বেড়েছে, তাতে বাজারে আবারও আগুন জ্বলে উঠবে। সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। সেখানে ১৬ কোটি সাধারণ জনগণের স্বার্থ চিন্তা না করে বিদ্যুতের দাম খুচরা পর্যায়ে ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র শিল্প গ্রাহক ৪ দশমিক ৯, মাঝারি শিল্পে ৫ দশমিক ৩, ওয়াসার পানির দাম ২৭ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।

এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এর ফলে সাধারণ ভোক্তাদের চলমান জনজীবনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। জীবনযাপনের খরচ আরও বাড়বে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, সব শ্রেণি-পেশার মানুষের বিরোধিতার পরও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি নেই। প্রতি মাসে ভোক্তাদের বাড়তি টাকা গুনতে হবে। এমনিতে গত কয়েক মাসে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। পেঁয়াজ ও চালের দাম বেড়েছে কয়েক দফা। বেড়েছে চিনি, ভোজ্যতেল, ডাল ও রসুনের দাম। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতিও হঠাৎ লাফ দিয়েছে। সব মিলিয়ে মধ্যম ও নিু আয়ের মানুষ যখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে, তখনই বিদ্যুতের দাম বাড়াল সরকার।

ক্যাব নেতারা আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করে এবং এ খাতে বিরাট দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি করে। সাময়িক সংকট সমাধানের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কথা বলা হলেও এখনও সেগুলো চলছে। উৎপাদন না করেই ভাড়া হিসেবে জনগণের পয়সা নিয়ে হরিলুট করা হচ্ছে।

বিদ্যুতের এ দাম বাড়ার প্রভাব শুধু বাসাবাড়িতে পড়বে তা নয়, কৃষি ও শিল্পপণ্যের উৎপাদন খরচও অনেক বাড়বে। করোনাভাইরাসসহ বৈশ্বিক অনেক কারণে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে। বেশির ভাগ সূচকই নিুমুখী। বিশ্ব অর্থনীতিও মন্দার আশঙ্কায়। কমে যাচ্ছে সামগ্রিক চাহিদা। এ রকম এক সময়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কতটা সময়োপযোগী।

তাদের মতে, এ মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নিু ও মধ্যবিত্তের স্বার্থবিরোধী। পুরো প্রক্রিয়াটিই জনগণের বিরুদ্ধে চলে গেছে। বিবৃতিতে যারা স্বাক্ষর করেন তারা হলেন ক্যাবের কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন, ক্যাব চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক কাজী ইকবাল বাহার ছাবেরী, ক্যাব মহানগরের সভাপতি জেসসিন সুলতানা পারু, সাধারণ সম্পাদক অজয় মিত্র শংকু, ক্যাব দক্ষিণ জেলা সভাপতি আলহাজ আবদুল মান্নান, ক্যাব মহানগরের যুগ্ম সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম প্রমুখ।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বৃহস্পতিবার বলেন, অর্থনৈতিকভাবে সরকারের দুর্বলতা রয়েছে। বিশেষ করে বাজেট বাস্তবায়নের অবস্থা মোটেও সন্তোষজনক নয়। রাজস্ব আয়ে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। সঞ্চয়পত্রের বিক্রি অস্বাভাবিক হারে কমেছে।

ফলে ব্যাংক নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এ অবস্থা থেকে কিছুটা স্বস্তি পেতে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানো হল। তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি পণ্যের দাম বাড়ানোও শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়বে। সাধারণ মানুষের জীবনে এর আঘাত আসবে। এছাড়া সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতিও এর প্রভাব পড়বে। তার মতে, বিদ্যুতে সরকার ভর্তুকি দিয়ে আসছে। কিন্তু প্রশাসনিক দক্ষতার অভাবে এ খাতে দুর্নীতি বন্ধ করা যাচ্ছে না। তিনি মানুষের ওপর বোঝা চাপানোর আগে দুর্নীতি বন্ধ করা উচিত বলে মনে করেন।

পানির মান না বাড়িয়ে ওয়াসার পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ওয়াসা সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে না পারার কারণে শহরের প্রান্তিক মানুষের বিভিন্ন কোম্পানির বাজারজাতকরণ পানি কিনে খাচ্ছে। জনসেবার মহান ব্রত নিয়ে পানির মতো মৌলিক সেবা নিশ্চিত করতে অনেকাংশে ব্যর্থ ঢাকা ও চট্টগ্রাম ওয়াসা। সেবার পরিবর্তে ওয়াসা ব্যবসায়িক আচরণ করছে। জনগণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওয়াসাকে কর্পোরেট আচরণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

ড. আদিল বলেন, ওয়াসার সরবরাহকৃত পানির মান ভালো হলে জনগণ বেশি টাকা দিয়ে কিনে খেতে আপত্তি করবে না। কিন্তু, ওয়াসার পানির মান নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন রয়েছে। বিভিন্ন পরীক্ষায় ঢাকা ওয়াসার পানিতে জীবাণু পাওয়ার খবর জানা গেছে। এ অবস্থায় মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর জীবাণু বহনকারী পানি মানুষ কেন বেশি টাকায় কিনে খাবে? পানির মান নিশ্চিত করে বাস্তবসম্মত দাম নির্ধারণ না করলে জনগণ ওয়াসার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াবে।

বিআইপির সাধারণ সম্পাদক বলেন, ঢাকা ওয়াসা বাস্তবসম্মত চিন্তা না করে বিপুল অর্থ খরচ করে দূর-দূরান্ত থেকে ঢাকায় পানি আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সেসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে ব্যয়ও কয়েকগুণ বেড়েছে। উচ্চমূল্যের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে এখন বাছবিচারহীন পানির দাম বাড়ানো হচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email