আইটিডি ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে চবির সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে ১৭ গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন
‘সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হলেই এবিএম মূসার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে’
নিজস্ব প্রতিবেদক: ১৯৪৭ সালের পরে আমাদের দেশে সকল ক্ষেত্রে যে নতুন ঔজ্জল্য দেখা দিয়েছিল, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যারা নতুন উদ্যোগ নিয়েছিলেন, এর অন্যতম পথিকৃৎ এবিএম মূসা। এক অর্থে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তিনি স্ব-শিক্ষিত কিন্তু তীক্ষ্ণ মেধা এবং জ্ঞানের মাধমে সাংবাকিদতার শিকড়ে ছিলেন। এবিএম মূসাকে আমরা বিশেষভাবে মনে রাখি এ দেশের সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী চেতনা এবং সামগ্রিকভাবে বাঙালি জাতীয়তাবোধে তার ভূমিকার জন্যে।
শুক্রবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে এবিএম মূসা-সেতারা মূসা ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘এবিএম মূসা স্মারকগ্রন্থে’র প্রকাশনা অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে এসব কথা বলেছেন ইমরেটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান।
তিনি বলেন, ‘সামরিক শাসনের অত্যন্ত কঠিন সময়ে তিনি পাকিস্তান অবজারভারের সম্পাদক ছিলেন। তখন সামরিক সরকারের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের পেশাগত জায়গায় যে সমস্ত উপদেশ দেওয়া হতো, তা অবশ্য পালনীয় ছিল। তবে ফাঁক ফোকর দিয়ে সত্য কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। এটি সাংবাদিকতার ইতিহাসের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যেমন তেমনি ক্রীড়া অঙ্গনেও এবিএম মূসা পূর্ব বাংলা স্বার্থ নিয়ে অনেক সংগ্রাম করেছেন। যার ফলে আমরা ক্রীড়া ক্ষেত্রে সকলের মধ্যে একটা সতর্কতার আভাস পাই। ’
গ্রন্থটি সম্পর্কে আনিসুজ্জামান বলেন, ‘মূসা ভাইয়ের মৃত্যুর পরে যারা বিভিন্ন লেখা লিখেছেন তার প্রায় সব লেখায় আমরা সাদরে গ্রহণ করেছি এই গ্রন্থে। কিছু হয়তো রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব আছে। আমরা সকলের লেখাই ধরে রাখতে চেয়েছিলাম বলে কিছু সম্পাদনা করেছি। আশা করি, এই বইটির মাধ্যমে আমাদের সাংবাদিকতার ইতিহাসের একটি চিত্রের উন্মোচন হবে এবং একজন মানুষ কীভাবে নিরলস পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে একটি জাতির ইতিহাসে ভূমিকা রাখতে পারে তারও প্রমাণ পাওয়া যাবে এই বইয়ে।’
প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। স্বাগত বক্তব্য রাখেন স্মারকগ্রন্থের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি এমিরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। প্রধান তথ্য কমিশনার অধ্যাপক ড. গোলাম রহমানের সভাপতিত্বে আলোচনা করেন সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, নিউজ টুডের সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, সাংবাদিক-প্রাবন্ধিক সৈয়দ আবুল মকসুদ, প্রবীণ ক্রীড়া সাংবাদিক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, বিএফইউজের একাংশের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল, বিএফইউজের একাংশের মহাসচিব এম আবদুল্লাহ, ফটোসাংবাদিক এবিএম রফিকুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, স্মারকগ্রন্থের প্রকাশক মাওলা ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী আহমেদ মাহমুদুল হক।
ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এবিএম মূসা-সেতারা মূসা ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক পারভীন সুলতানা ঝুমা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন গ্রন্থের সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য সাংবাদিক হাসান হাফিজ। এ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. সাখাওয়াত আলী খান।
এবিএম মূসা সম্পর্কে সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার বলেন, ‘আমি যুগান্তরের সম্পাদক ছিলাম। ৫ বছরের মাথায় আমাকে যুগান্তর ছাড়তে হলো। ছাড়তে হলো আর কী; সে প্রেক্ষাপটে যাচ্ছি না। দীঘদিন পর একটু অবসর পেলাম বলে একটু নিশ্বাস নিতে কক্সবাজার গেলাম। হঠাৎ মূসা ভাইয়ের টেলিফোন। ফোনে তিনি বললেন, সারওয়ার তুই কোথায়? তিনি তুই সম্বোধনে আমাদের ডাকতেন। আমি বললাম, একুট কক্সবাজারে এলাম। তিনি বললেন, কেনো? আমি বললাম অনেকদিন পর হাফ ছেড়ে বেঁচেছি তাই। তিনি বললেন আমাকে যুগান্তরের সম্পাদক হওয়ার জন্য টানাটানি করছে। এখন আমি করব ভাবছি। আমি বললাম, হয়ে যান। তিনি বললেন, তুই বললে আমি যাব, কিন্তু যেখানে তুই থাকতে পারিসনি সেখানে আমি কতদিন থাকতে পারব সেটা নিয়ে ভাবছি। তিনি যোগদান করলেন এবং সেখানে গিয়ে সম্পাদকের আসনে বসলেন। তবে আমি যে চেয়ারে বসতাম সেটিতে বসলেন না । বললেন, এটি সারোয়ারের চেয়ার এখানে আমি বসব না। এভাবেই অনুজদের তিনি মূল্যায়ন করতেন। কিন্তু তার পূর্বের আশংকাই সত্যি হলো; সেখানে বেশিদিন থাকতে পারলেন না।’
গোলাম সারওয়ার আরো বলেন, ‘টকশোতে তিনি ছিলেন খুবই জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় । অত্যন্ত সুন্দর শব্দ চয়ন করে, ভেবে চিন্তে, পাছে লোকে কী বলে তা না ভেবে, তিনি কথা বলতেন। এমনও সময় গেছে, তিনি প্রয়োজন মনে করে আমাদের অনুজপ্রতীম মতিউর রহমান চৌধুরীর টকশোতে যেতেন। তিনি বললেন, মতি আজ আমি আসছি। আজ আমি কথা বলব। তিনি আমাদের চেয়ে বেশি বুঝতেন কখন কী লিখতে হবে, কী হবে না। অর্থাৎ সামরিক শাসনের মধ্যেও কীভাবে বলা যায়, তা তিনি ভালো করে জানতেন। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো- বঙ্গবন্ধু যখন বাঙালির মুক্তির সনদ প্রকাশ করলেন, ১০ জন বাঙালিকে মেরে ফেলা হলো, তখন সরকারি বিধি নিষেধ আসার আগেই টেলিগ্রামের মাধ্যমে সবাইকে ঘটনাটি জানিয়ে দেওয়া হলো। এরপর সরকারি নোটিশ আসার পর তিনি তা প্রকাশ করলেন-ইটস অ্যা গভর্নমেন্ট প্রেস নোট। অর্থাৎ এটি সরকারি প্রেস নোট আমাদের না।’
বর্তমান সাংবাদিকতার প্রসঙ্গে গোলাম সারওয়ার বলেন, ‘বর্তমানে মূলধারার পত্রিকাগুলো একটা চর্চা শুরু করেছে কীভাবে কম কথায় একটি আকর্ষণীয় শিরোনাম দেওয়া যায়। সেটিরও কিন্তু দিশারী এবিএম মূসা। সকলের সাথে তিনি সমানভাবে মিশতেন।
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘তার (এবিএম মূসার) সততা ও সাহসীকতার দৃষ্টান্ত এই বইটিতে রয়েছে। তিনি সব সময় বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করেছেন। বর্তমান সময়ে এ ধরনের সম্পাদক, সাংবাদিকের প্রয়োজন রয়েছে। সাংবাদিকদের মধ্যে যে বিভক্তি রেখা রয়েছে তা দূর করতে তিনি কাজ করেছেন। তার কীর্তি সংরক্ষণ করতে হবে, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম সেখান থেকে শিক্ষা নিতে পারে। এ বই কর্মরত সাংবাদিক ও ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়ক হবে বলে তিনি আশা করেন।’
রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এ বইয়ে সবাই সবার দৃষ্টিকোণ থেকে লিখেছেন। তবে সবার একটি সাধারণ মন্তব্য হলো- মূসা ভাই ছিলেন সাহসী সাংবাদিক, শিক্ষক সাংবাদিক, আপোষহীন ও সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিক।’
তিনি আরো বলেন, ‘১৯৭০ সালের সাইক্লোনের একটি অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করে এসে লেখার সময় সে সময়কার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগের দায়িত্বে থাকা শিবলি সাদিক আমাকে সরকারি বক্তব্য লিখতে বাধ্য করেন। এ সময় আমি মূসা ভাইকে ফোন দিলে, তিনি শিবলি সাদিককে ধমক দিয়ে আর কোনোদিন পাকিস্তান অবজারভার অফিসে আসতে মানা করেন। এমনই সাহসী সাংবাদিক ছিলেন তিনি। আমি ধন্য তার অধীনে কাজ করতে পেরে।
এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘তিনি সব সময়ই সাংবাদিকদের ঐক্য চাইতেন। আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হতে পারি, সাংবাদিক ইউনিয়ন যদি ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, তাহলেই তার প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা জানানো হবে।’
সৈয়দ কামালউদ্দীন বলেন, ‘সাংবাদিকতার বস্তুনিষ্ঠতার বিষয়ে তিনি ব্যক্তিগতভাবে যে কাজ করেছেন তা আমাদের প্রেরণা জুগিয়েছে।’
সাংবাদিক এবিএম রফিকুর রহমান বলেন, ‘তিনি শুধু ভালো বার্তা সম্পাদকই ছিলেন না, একজন ভালো আলোকচিত্র সম্পাদকও ছিলেন। তিনি ছবির প্রশংসা করতেন ও ভুল-ত্রুটি ধরতেন।’
সাংবাদিক এইউএম ফখরুদ্দীন বলেন, ‘পেশাগত জীবনে আমি এবিএম মূসার কাছে সবচেয়ে ঋণী।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘এবিএম মূসা দুই প্রখ্যাত সাংবাদিক আতাউস সামাদ ও আবদুস সালামের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে ২০ লাখ করে ৪০ লাখ টাকা দিয়ে ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছিলেন। তিনি তার জীবদ্দশায় এর প্রচার চাননি। এটাই তার বড় গুণ ছিল।’
এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায় এবিএম মূসা স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করেছে মওলা ব্রাদার্স। গ্রন্থটির সম্পাদনা পরিষদে আরও ছিলেন অধ্যাপক ড. সাখাওয়াত আলী খান, সৈয়দ আবুল মকসুদ, মাহফুজ উল্লাহ, মতিউর রহমান চৌধুরী, শামসুদ্দীন পেয়ারা, হাসান হাফিজ, সেতারা মূসা ও মরিয়ম সুলতানা মূসা।
এ স্মারকগ্রন্থে ১০২ জনের লেখা রয়েছে। নামের অধ্যাক্ষর ক্রমানুসারে তারা হলেন- অজয় দাশগুপ্ত, আতাউস সামাদ, ব্যারিস্টার আফতাব উদ্দিন তপন, আবদুর রহিম, আবদুল আউয়াল মিন্টু, আবদুল গাফফার চৌধুরী, আমানউল্লাহ, আলী হাবিব, আশরাফ কায়সার, আসাদ চৌধুরী, আসিফ নজরুল, এবিএম রফিকুর রহমান, এম সাখাওয়াত হোসেন, এরশাদ মজুমদার, ইউসুফ শরীফ, ইকবাল সোবহান চৌধুরী, কাজল ঘোষ, কাজী রওনাক চৌধুরী, কামাল লোহানী, ড. কামাল হোসেন, কে জি মুস্তফা, কেজি মোস্তফা, গোলাম তাহাবুর, গোলাম মোর্তোজা, গোলাম সারওয়ার, ছন্দা দাস, জগলুল আহমেদ চৌধুরী, তৌহিদুর রহমান, দুলাল মাহমুদ, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, নাঈমুল ইসলাম খান, নিনি ওয়াহেদ, নির্মল চক্রবর্তী, নূরুজ্জামান সুমন, নূরে আলম সিদ্দিকী, পারভীন সুলতানা মূসা ঝুমা, পীর হাবিবুর রহমান, মাহমুদ হাসান, ফরিদ হোসেন, ফরিদুর রেজা সাগর, ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী, মইনুল হোসেন, মতিউর রহমান চৌধুরী, মনজুর আহমদ, মনজুরুল আহসান বুলবুল, মনির হায়দার, মনোজ রায়, মরিয়ম সুলতানা মূসা, মাহফুজ উল্লাহ, মাহবুবুল আলম, মাহমুদ হাফিজ, মাহমুদুর রহমান মান্না, মিজানুর রহমান খান, ড. মিজানুর রহমান শেলী, মো. চাঁন মিয়া, মো. জাকারিয়া পিন্টু, লুৎফর রহমান বীনু, মোয়াজ্জেম হোসেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস, মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, রফিকুল ইসলাম রতন, রাশেদা কে চৌধুরী, রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, রুহুল আমিন, রেহানা সালাম, রোবায়েত ফেরদৌস, শওকত মাহমুদ, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, শফিক রেহমান, শান্তা মারিয়া, শামসুদ্দিন পেয়ারা, শামসুল হুদা, শামীমা চৌধুরী, ড. শারমিন মূসা, শাহজাহান মিয়া, শাহজাহান সরদার, সাইফুল আলম, সাখাওয়াত আলী খান, সাজেদুল হক, সাদেক হোসেন খোকা, সায্যাদ কাদির, সিরাজুর রহমান, সেতারা মূসা, সেলিম আজাদ চৌধুরী, সোহরাব হাসান, সৈয়দ আবুল মকসুদ, সৈয়দ কামালউদ্দিন, সৈয়দ বদরুল আহসান, স্বপন সাহা, হাসান হাফিজ, হায়দার আকবর খান রনো প্রমুখ। ইংরেজিতে এবিএম মূসাকে নিয়ে লিখেছেন অনন্ত ইউসুফ, মুস্তফা কামাল মজুমদার, রুবায়েত নিজাম, তাসমিয়াহ চৌধুরী হৃদি, টিউলিপ চৌধুরী এবং ওয়ামিহ চৌধুরী সিঁথি। গ্রন্থটিতে এবিএম মূসার রচনা থেকে অনেক তথ্য উঠিয়ে আনা হয়েছে, ঠাঁই পেয়েছে অনেক দুর্লভ ছবি।
৩২০ পৃষ্ঠার এই বইটির মূল্য এক হাজার টাকা। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন মাসুক হেলাল।