শিরোনাম :

  • মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৪

সাংবাদিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতার চেয়ে পেশাগত সুস্থ প্রতিযোগিতা বেশি জরুরি

জেসমিন মলি

এমন কেউ কেউ সাংবাদিকতায় আছেন যারা প্রাতিষ্ঠানিকতার দৌড়ে এগিয়ে থাকায় অন্যকে নিচু চোখে দেখেন অথচ তাদের নিজেদের কাজের মূল্যায়ন করলে হয়তো তারা নিজেরাই লজ্জিত হবেন।

সাংবাদিকের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রায়ই আলাপ ওঠে। আলোচনায় শিক্ষাগত যোগ্যতার তিনটি বিষয় থাকে:

১. গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী থাকা। সেটা হতে পারে দেশের কোন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী। কিংবা অন্য কোন বিষয়ে মাস্টার্স করা কেউ দেশ কিংবা বিদেশ থেকে সাংবাদিকতার উপর ডিপ্লোমা কিংবা ১ বছর বা বেশি সময়ের কোর্স করেছেন।

২. গণমাধ্যম কিংবা সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়েননি কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী থাকা।

৩. দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা করছেন কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নেই।

শিক্ষাগত যোগ্যতার এই আলোচনার কারণটি কিন্তু শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখা নয়, কারণটি হলো এক ধরনের সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করা — কে ভালো সাংবাদিক? কেউ কেউ আরো এক ধাপ এগিয়ে দেখার চেষ্টা করেন কাদের সাংবাদিকতায় থাকা উচিত এবং কাদের থাকা উচিত নয়। যদি কোন আড্ডায় কিংবা ফোরামে তিন ধরনের মানুষের উপস্থিতিতেই আলোচনাটা শুরু হয়, মানে কেউ শুরু করেন তাহলে সেখানে একটা সময় এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়। কেউ কেউ এই ধরনের আলোচনায় উৎসিাহিত বোধ করলেও কেউ আছেন যারা এমন আলোচনাকে মনে মনে স্বাগত জানান না। কিংবা অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকেন। এই বিরত থাকার দলে যদি সার্টিফিকেট অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে থাকা কেউ থাকেন, তাহলে আমি লক্ষ্য করেছি অন্যরা তাকে বিভিন্নভাবে হেয় করার চেষ্টা করেন। আমি এটাও লক্ষ্য করেছি যারা এই কাজটি করেন তাদের সার্টিফিকেট থাকলেও সাংবাদিকতার মানের বিচারে ওই সার্টিফিকেটে দুর্বল মানুষটি অনেকগুণে ভালো।

আমি অনেকসময় চিন্তা করে দেখেছি পাকিস্তান সরকারের ভিত্ কাপিয়ে দেয়া ইত্তেফাক পত্রিকার নামকরা সাংবাদিকদের কয়জন সাংবাদিকতার উপর ডিগ্রী নেয়া ছিল? কিংবা বিশ্বের নামকরা ১০০ সাংবাদিককের কয়জনের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার উপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী আছে? আমাদের চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ নিয়ে সবচেয়ে আলোচিত রিপোর্টটি করেছিলেন জন পিলজার। তিনি সাংবাদিকতায় আসার পর কোর্স করেছিলেন। সেই রকম কোর্স কিন্তু আমাদের দেশের অনেক নামকরা সাংবাদিকও করেছেন। এই কথা বলার মধ্য দিয়ে আমি বলতে চাই যে, অন দা জব ট্রেনিং থাকাটা অন্য সকল পেশার মতো সাংবাদিকতায়ও থাকা দরকার। এবং সেটা উল্লেখিত তিন ধরনের সকলের জন্য প্রযোজ্য। যিনি সাংবাদিকতায় উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে এসেছেন তারও কিন্তু অন দ্যা জব ট্রেনিং দরকার আছে। তার মানে সাংবাদিকতা আমার মনে হয় শুধু প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রীর বিষয় নয়। এটা প্রতিনিয়ত শেখার বিষয় এবং নিজেকে আরো শানিত করার জন্য প্রশিক্ষণেরও দরকার আছে।

আমাদেরকে এটাও মনে রাখতে হবে ৬০ ও ৭০ এর দশকের সাংবাদিকতার সঙ্গে এখনকার সাংবাদিকতায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। কার কি ডিগ্রী আছে তারচেয়েও বোধহয় বেশি দরকার হলো এই পরিবর্তনের সাথে কে কতোটা ভালোভাবে খাপ খাওযাতে পারছে, প্রযুক্তির সুবিধাগুলোকে নিজের পেশাগত উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারছে। যেমন আমি মনে করি এখনকার সাংবাদিকদের কম্পিউটারের ছোট ছোট প্রোগ্রামিং টুলস জানা থাকলে, কীভাবে স্ট্যাটিসটিকসের সাহায্য তথ্য আরো বেশি গ্রহণযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করা যায় জানা থাকলে সে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকবে।

কেউ যদি প্রাতিষ্ঠানিকতার ডিগ্রী না নিয়েও নিজেকে এই সময়ের সাংবাদিকতার জন্য প্রস্তুত করতে পারেন আমি মনে করি তিনি অন্যদের চেয়ে নিশ্চয়ই এগিয়ে থাকবেন। সে কারণে আমার সবসময় মনে হয় পেশাগত সুস্থ প্রতিযোগিতার গুরুত্ব শিক্ষাগত যোগ্যতার আলাপের চেয়ে বেশি জরুরি।

প্রাসঙ্গিকভাবে একটা কথা বলতে চাই, এমন কেউ কেউ সাংবাদিকতায় আছেন যারা প্রাতিষ্ঠানিকতার দৌড়ে এগিয়ে থাকায় অন্যকে নিচু চোখে দেখেন অথচ তাদের নিজেদের কাজের মূল্যায়ন করলে হয়তো তারা নিজেরাই লজ্জিত হবেন। তারা যখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা মানুষদের হেয় করে কথা বলেন কিংবা পরামর্শ দিতে চান অন্য কোন পেশায় যেতে তাদের জন্য আমার পরামর্শ হলো — প্লিজ নিজেকে দেখুন। কে কীভাবে নেবেন জানি না কিন্তু আমার বলতে ইচ্ছা করছে যারা যোগ্যতা থাকার পরও অযত্ন আর অবহেলায় সাংবাদিকতার কাজটা করেন তারা সম্ভবত এই পেশায় না এলেই ভালো করতেন।

আমার কাছে সাংবাদিকতা পেশাকে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ মনে হয়। সেটা হলো সবসময় নিজেকে নিজে ছাড়িয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ।

(এই গ্রুপের অনেকেই সাংবাদিকের শিক্ষাগতা যোগ্যতা নিয়ে লিখছেন। সেজন্য সাহস করে আমার মতামত দিতে হাজির হয়ে গেলাম। এখানে আমি কিছুটা আমার চিন্তাভাবনা তুলে ধরলাম। আপনাদের মতামতের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে এ বিষয় নিয়ে আরো লেখার ইচ্ছা আছে।)

  • জেসমিন মলি, বণিক বার্তার সিনিয়র সাংবাদিক। ‘আওয়ার মিডিয়া-আওয়ার রাইটস’ নামক একটি ফেসবুক গ্রুপে বিতর্কের পটভূমিতে লেখা এবং ফেসবুক টাইমলাইন থেকে নেয়া।