রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন অগ্রদৃষ্টিসম্পন্ন বিশ্বনেতা

রিজভী আহমেদঃ সুনির্দিষ্ট নীতি প্রণয়ন ও প্রয়োগের মাধ্যমে সাফল্য অর্জনের ওপর রাষ্ট্রের কর্ণধার রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ওঠেন। রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান তখনই রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হবেন যখন তার দক্ষতা, সুচিন্তা ও অভিজ্ঞতা সূত্রে প্রণীত নীতি সর্বসাধারণ্যে গ্রহণযোগ্য হয়ে সৃষ্টি করে সামষ্টিক হিত সাধন। এ প্রসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেছেন- A great President must be an educator, bridging the gap between his people’s future and its experience, তাই রাষ্ট্রনীতির ফলপ্রসূ অর্জন শুধু কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, অর্থনীতি ও শিক্ষার বিকাশেই নিহিত থাকে না, রাষ্ট্র সার্থক হয় তার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির অর্থবহ প্রয়োগে।

ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি এক অনাবশ্যক বিলাস ছাড়া কিছু নয় বলে অনেক পণ্ডিত অভিমত ব্যক্ত করেন। তবে এই অভিমত যুক্তিসঙ্গত নয়। বৃহৎ রাষ্ট্র দিয়ে পরিবেষ্টিত হওয়ার পরও জনসংখ্যা ও ভূখণ্ডগত দিক থেকে অপেক্ষাকৃত বেশ কিছু ক্ষুদ্র দেশ নিজেদের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আধিপত্যের থাবা থেকে নিরাপদ রাখতে শুধু সামরিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ায় যথেষ্ট নয়, এর জন্য প্রয়োজন স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দক্ষতার সাথে পরিচালনা করা। সুসংগঠিত জনগণের রাষ্ট্রের পরিসীমা যাই হোক না কেন তাকে সহজে করায়ত্ত করা যায় না। আর এটি নির্ভর করে সেই রাষ্ট্রের কর্ণধারদের ভিশন ও দেশপ্রেমের গভীরতার ওপর।

বিগত কয়েক শতাব্দীর পররাষ্ট্রনীতির বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় নানা তত্ত্বীয় রূপ আমরা লক্ষ করেছি। সপ্তদশ শতকের ফরাসি রাষ্ট্রনায়ক ও বিশপ কার্ডিনাল রিশলু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আধুনিক ধারার সূচনা করেন। জাতীয় স্বার্থের অগ্রাধিকারের নিরিখে জাতি-রাষ্ট্রের ধারণাই হচ্ছে রিশলুর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি। এরপর অস্ট্রো-হাঙ্গেরির ম্যাটার্নিক ও জার্মানির বিসমার্ক ইউরোপীয় কূটনীতির পুনর্গঠনে এক বিস্ময়কর মাত্রা যুক্ত করেন। বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর আন্তঃসম্পর্কের মিথস্ক্রিয়ার পটভূমিকায় অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর ‘ব্যালান্স অব পাওয়ার’ ও বিংশ শতাব্দীর ‘স্ফেয়ার অব ইনফ্লুয়েন্স’ এ দু’টি শব্দসমষ্টির মাধ্যমে তৎকালীন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের স্বরূপ উপলব্ধি করা যায়। ঐতিহাসিক কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত নানা সময়ে বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর স্থানান্তর ঘটেছে। শত বছর আগের শক্তিশালী রাষ্ট্র শত বছর পরে ক্ষয়িষ্ণু হয়েছে এবং সে সময়ের কিছু দুর্বল রাষ্ট্র বর্তমানে শক্তিশালী হয়ে পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বর্তমান অবস্থানে ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর অবস্থান ছিল বিশ্বের চতুর্দশতমÑ যা বুলগেরিয়ার নিচে এবং নৌবাহিনীর অবস্থান ছিল ইতালির নিচে।

দুই শ’ বছরের বেশি সময় ধরে অ্যাংলো-ফ্রাঙ্কো পরাশক্তি অমিত বিক্রমে সারা দুনিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তারে প্রতিযোগিতা করেছে। পাশাপাশি ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও প্রুশিয়া এবং ওই শতাব্দীর শেষার্ধে ঐক্যবদ্ধ জামার্নি ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরির সাম্রাজ্যের অভিঘাত সমগ্র ইউরোপের রাজনীতিকে আলোড়িত করে- যার ঢেউয়ের ধাক্কা এসে লাগে বিংশ শতাব্দীতেও। জার্মান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরির সাম্রাজ্যবাদী আকাক্সক্ষা তীব্র হতে থাকে, এরা বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেই অ্যাংলো-ফ্রাঙ্কোর মতো বৃহৎ শক্তির ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। ইতোমধ্যে রাশিয়ার অভ্যন্তরে নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অভিঘাত থাকলেও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে তার পেশিশক্তি ছিল যথেষ্ট শক্ত। মধ্য এশিয়া গলাধঃকরণ করে তাদের সাম্রাজ্যের সীমানার বাইরের ভূখণ্ডের প্রতি উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে রাশিয়া অক্লান্ত থেকেছে। পরিণামে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে পরাশক্তিভুক্ত দেশগুলোর অত্যুগ্র ‘পলিটিক্যাল ও টেরিটোরিয়াল অ্যামবিশন’-এর ফলে সংঘটিত হলো বিশ্বের ভয়ঙ্করতম সর্বনাশা দু’টি বিশ্বযুদ্ধ।

অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে সংঘটিত রাষ্ট্রবিপ্লব, জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিন্তা, দর্শনে অভূতপূর্ব উন্নতিতে ইউরোপীয় মানসলোকে যে জাগরণ সৃষ্টি হয় তাতে মানবিক মর্যাদা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠন ও সমাবেশ করার স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে মানুষ দীর্ঘ দিনের অচলায়তন ভেঙে নিজের শক্তির প্রতি সচেতন হয়। হাজার হাজার বছরের শৃঙ্খলগুলো খুলতে থাকে, মানুষের বুদ্ধির মুক্তির উদ্বোধন হতে থাকে। নবজাগৃতির এই পথ বেয়েই বিংশ শতাব্দীতে আফ্রো-এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার উপনিবেশগুলোর জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের বোধ শক্তিশালী হতে থাকে এবং শোষণ-বঞ্চনা ও বিদেশী আধিপত্য থেকে বেরিয়ে আসার আকাক্সক্ষা তীব্র হতে থাকে।

যুগে যুগে বিশ্ববিন্যাসে বড় বড় পরাশক্তি ও আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলোর পরিকাঠামোর মধ্যে একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি কোন উপাদানের ওপর রচিত হবে তা নির্ভর করবে সেই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের সংগঠিত জনগণের অনুভূতি, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অন্তর্নিহিত শক্তি, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক চরিত্র ও এর পরিচালকদের বোধ, মনন ও আত্মশক্তির ওপর। অনগ্রসর ক্ষুদ্র, মাঝারি কিংবা বৃহৎ রাষ্ট্রের পরনির্ভরশীলতা সৃষ্টি হয় সেখানে বিদ্যমান কর্তৃত্ববাদী শাসনের অন্তর্নিহিত তাগিদে। একক কর্তৃত্ববাদী শাসনে ক্ষমতাক্ষুধার আতিশয্যে জনগণ উপেক্ষিত হতে থাকে, শাসকগোষ্ঠী ক্রমাগত গণবিচ্ছিন্ন হয়ে জনগণের আস্থা হারিয়ে বিদেশী শক্তির ওপর ভর করে টিকে থাকতে চায়। সেই দেশের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকে। রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক চরিত্র হারালে সার্বভৌমত্ব দুর্বল হবে এবং আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তির সাথে ভারসাম্য আনয়নে ব্যর্থ হবে। জনগণের সার্বভৌমত্ব না থাকলে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বও দুর্বল হয়।

রাষ্ট্রনায়ক শহীদ জিয়াউর রহমান দৈশিক স্বাধীনতা অটুট রাখার গ্যারান্টি খুঁজে পেয়েছিলেন তার প্রণীত স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে। কুশলতা ও দক্ষতার সমন্বয়ে জিয়াউর রহমান তার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি তৈরি করেছিলেন ‘ব্যালান্স অব পাওয়ার’-এর নীতিতে। আঞ্চলিক শক্তির ক্ষমতাকে ব্যালান্স করতে সেই শক্তির সাথে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের শক্তিশালী দেশগুলোকে একই সুতায় বাঁধতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই নীতিরই বর্ধিত প্রকাশ হচ্ছে ‘সার্ক’। ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়’ জিয়াউর রহমান এই কালজয়ী নীতির প্রয়োগেই সেই সময় আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা একটি উচ্চমাত্রায় উন্নীত হয় এবং তিনি দুনিয়াজুড়ে ভূয়সী প্রশংসা লাভ করেন।

পররাষ্ট্র বিষয়ে জিয়াউর রহমানের নানামাত্রিক অর্জনের সাথে আমরা পরিচিত। যেমন- ১৯৭৮ সালে জাপানকে পরাজিত করে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের নির্বাচিত হওয়া, জোট নিরপেক্ষ ব্যুরোর সদস্য লাভ এবং জেরুসালেম কমিটিতে বাংলাদেশের নির্বাচন, ইসলামী শীর্ষ বৈঠকে বাংলাদেশের তিনজন ব্যুরো সদস্যের নির্বাচনসহ অন্তত বিশটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ। শহীদ জিয়া দেশকে আধিপত্যবাদী বলয় থেকে বের করে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির অবলম্বনের মাধ্যমে দুনিয়ার বেশির ভাগ দেশের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থাপন করেন। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশ, চীন ও মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের সব বাধা অপসারিত হয়। শুরু হয় অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার নতুন দিগন্তের উন্মোচন। কারণ, পররাষ্ট্রনীতির সাফল্যের ওপর নির্ভর করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। লাখ লাখ যুবক বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা দেশের শ্রমবাজারে প্রবেশের মাধ্যমে এবং উল্লিখিত অর্জনগুলোর সাথে যুক্ত হয় সে সময় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ফোরামে নেতৃত্ব গ্রহণ ইত্যাদি নিয়ে ইতঃপূর্বে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কেন জিয়াউর রহমান আন্তর্জাতিক সম্পর্কে এত সাফল্য লাভ করেছিলেন? এ প্রশ্নটির উত্তর খুব সহজ- জাতীয়তাবাদী এই নেতার সাফল্যের চাবিকাঠি ছিল তার তীব্র জাতীয়তাবাদী চেতনা।

আমরা এখন মূল প্রতিপাদ্যে ফিরে আসি। শহীদ জিয়ার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির উপাদানগুলো নিয়ে আলোকপাত করতে চাই। দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়কের প্রধান কর্তব্য জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়া। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বড় সার্থকতা হচ্ছে তার পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে ছিল দেশের মর্যাদা ও জনগণের স্বার্থকে সর্বোচ্চ বিবেচনায় নিয়ে আসা। তার এই নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই স্বাধীনতা-উত্তর সরকারের একমুখী এককেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পুনর্গঠন করতে সক্ষম হয়। যদি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নকালে অন্য রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নিতে হয়, তাহলে বাংলাদেশ একটি স্যাটেলাইট রাষ্ট্র হিসেবেই পরিচিতি লাভ করবে। জাতীয় সার্বভৌমত্ব, সমান মর্যাদা, আঞ্চলিক পরিসরে জাতি-রাষ্ট্রগুলোর একে অপরের ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, বিরোধ ও বিতর্কের শান্তিপূর্ণ সমাধান, সবাই মিলে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার অঙ্গীকারের মাধ্যমে একটি মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কাঠামো নির্মাণ করেছিলেন শহীদ জিয়া।

পররাষ্ট্রনীতিতে উল্লিখিত জাতীয়তাবাদী উপাদানের সংশ্লেষণ ঘটাতে পারে কেবল একজন জাতীয়তাবাদী নেতা। মোদ্দাকথা, বাইরের নিয়ন্ত্রণ উপেক্ষা করে জিয়া স্বাধীনভাবে নিজস্ব পথচলা নিশ্চিত করেন। তার সময়ে পররাষ্ট্রনীতির এই গুণগত পরিবর্তন বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে আন্তঃসম্পর্কের মাত্রা বেড়ে যায় এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান একজন অগ্রদৃষ্টিসম্পন্ন বিশ্বনেতায় অভিষিক্ত হন। বহিঃসম্পর্কের উন্নয়নের এই যে সার্থকতা, সেটির পেছনে ছিল এক দেশপ্রেমিক ব্যক্তির দূরদৃষ্টি। মহান স্বাধীনতার ঘোষক সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের ৩৮তম শাহাদতবার্ষিকীতে আমি তাকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, বিএনপি

Print Friendly, PDF & Email