’ছয় মাস আমরা জানতেও পারিনি তিনি বেঁচে আছেন কি না’

129933_pmনিজস্ব প্রতিবেদকঃমুক্তিযুদ্ধে বঙ্ শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অবদানের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বঙ্গমাতার পরামর্শ জাতির পিতাকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করেছে। জাতির পিতার জন্য প্রেরণা, শক্তি এবং সাহসের এক উৎস ছিলেন বঙ্গমাতা। স্বামীর সব সিদ্ধান্তে মনস্তাত্ত্বিক সহযোগিতা ছাড়াও বঙ্গমাতার পরামর্শ অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হয়েছে। গতকাল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৮৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা ইন্দিরা এমপি।

বিশেষ অতিথি হিসেবে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রেবেকা মোমেন এবং জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান অধ্যাপক মমতাজ বেগম অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে বঙ্গমাতার জীবন ও কর্মের ওপর একটি ভিডিও প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মা ও জাতির পিতার সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ১৯৩০ সালের ৮ই আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার এক সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের কালরাত্রিতে বঙ্গবন্ধু এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তিনিও নির্মমভাবে নিহত হন। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গমাতা সম্পর্কে বলেন, তার সম্পর্কে মানুষ খুব সামান্যই জানে। তিনি অত্যন্ত সাদাসিধে ও প্রচার বিমুখ ছিলেন। তাই বঙ্গমাতার অবদান লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে গেছে। তিনি বলেন, বেগম মুজিব খুব অল্প বয়সে মা-বাবাকে হারান। আমার দাদা-দাদির কাছে বেড়ে ওঠার সময় অল্প বয়সেই তার মধ্যে সাহস, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা গড়ে উঠেছিল। বঙ্গমাতাকে প্রধানমন্ত্রী- স্বামী-সংসার অন্তঃপ্রাণ বাঙালি নারী এবং শোষিত-নিপীড়িত জনসাধারণকে মুক্তির চেতনায় জাগিয়ে তোলার সংগ্রামে স্বামীর পাশে থাকা সহযোদ্ধা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জেলখানায় দেখা করতে গেলে আব্বা তার মাধ্যমেই দলীয় নেতাকর্মীদের খোঁজখবর পেতেন। আব্বার দিক-নির্দেশনা আম্মা নেতাকর্মীদের পৌঁছে দিতেন। আব্বা কারাবন্দি থাকলে সংসারের পাশাপাশি সংগঠন চালানোর অর্থও আমার মা যোগাড় করতেন। বাবার কোনো কাজেই মা প্রতিবন্ধক নন বরং সহায়ক ছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার মা চাইলে স্বামীকে সংসারের চার দেয়ালে আবদ্ধ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি কখনও ব্যক্তিগত-পারিবারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তাকাননি। বঙ্গবন্ধুর কারাজীবনের স্মৃতিচারণ করে এ সময় আক্ষেপের সুরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাবাকে কখনও টানা দুই বছরও আমাদের মাঝে পাইনি। তার মা এবং বঙ্গবন্ধু মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে একে অপরের পরিপূরক ছিলেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, জীবনের একটি বড় সময়ই কারাগারে কাটিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তার অবর্তমানে একদিকে যেমন সংসারের দায়িত্ব পালন, অন্যদিকে মামলা পরিচালনার ব্যবস্থা করা, দলকে সংগঠিত করা, আন্দোলন পরিচালনাসহ প্রতিটি কাজে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ ভাষার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন শুরুর পর দেশ মাতৃকার প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে জাতির পিতার সহযোদ্ধা বেগম মুজিবের রাজনৈতিক দূরদর্শিতারও কিছু উপাখ্যান তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। বেগম মুজিবের একটি সিদ্ধান্ত বাঙালিকে মুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী ’৬৯-র গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট স্মরণ করে বলেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যায় পাক সামরিক সরকার। ছয় মাস পর্যন্ত তার কোন হদিস ছিল না, আমরা জানতেও পারিনি তিনি বেঁচে আছেন কি না। এরপরে কোর্টেই বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখার সুযোগ হয়। তখন পাকিস্তান সরকার আম্মাকে ভয় দেখায়, বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি না নিলে তিনি বিধবা হবেন। আম্মা সোজা বলে দিলেন, কোন প্যারোলে মুক্তি হবে না। নিঃশর্ত মুক্তি না দিলে কোনো মুক্তি হবে না। তিনি বলেন, আমি মায়ের সিদ্ধান্তের কথা কোর্টে যখন বঙ্গবন্ধুকে জানালাম তখন অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকেও দেখেছি তারা বলেছেন, তুমি কেমন মেয়ে? বাবার মুক্তি চাও না? আম্মাকে বলেছে, ভাবি আপনি কিন্তু বিধবা হবেন। আমার মা তখন কঠিন স্বরেই বলেছেন, প্যারোলে মুক্তি নিলে মামলার আর ৩৩ জন আসামির কী হবে? বঙ্গবন্ধু প্যারোলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। গণ-অভ্যুত্থানে পাকিস্তান সরকার আব্বাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তিনি বলেন, এর আগে, ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা ঘোষণা করে জনমত সৃষ্টির জন্য সারা দেশে জনসভা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু আট বার গ্রেপ্তার হন। তখন কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতার ৬-দফাকে ৮-দফায় রূপান্তরের চেষ্টা বেগম মুজিবের জন্য ভেস্তে যায়। তিনি বলেন, ৬ দফা আন্দোলনের সময় সব থেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা, কারাবন্দিদের মুক্তির জন্য ৭ই জুনের হরতাল সফল করা, সেটাও সফল হয়েছিল বেগম মুজিবের প্রচেষ্টায়। তিনি নিজ বাসা থেকে আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে সেখান থেকে স্যান্ডেল আর বোরখা পরে জনসংযোগে বেরিয়ে পড়তেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় বেগম মুজিব পুলিশ ও গোয়েন্দা চক্ষুর আড়ালে সংগঠনকে শক্তিশালী করেছেন। বিচক্ষণতার সঙ্গে ছাত্রদের তিনি নির্দেশনা দিতেন এবং অর্থ সরবরাহসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতেন। এমনকি নিজের গহনা বিক্রি করেও অর্থ জুগিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এ সময় বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তানের স্পেশাল ব্রাঞ্চের রিপোর্ট নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটি ১৪ খণ্ডের প্রকাশনা প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলেও জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আম্মার যে মনোবল দেখেছি, তা ছিল কল্পনাতীত। স্বামীকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে গেছে। দুই ছেলে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছে। তিন সন্তানসহ তিনি গৃহবন্দি। যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন। কিন্তু আম্মা মনোবল হারাননি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার ‘মা’ নিজের জন্য কখনও কিছু চাননি। অথচ সারাজীবন এই দেশের কল্যাণে, মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। তিনি এ দেশকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। আব্বার সঙ্গে থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখতেন- এদেশের মানুষ ভালো থাকবে, সুখে-শান্তিতে বাস করবে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাবার পাশে থেকে সে স্বপ্ন পূরণে সহায়তা করেছেন। তার মায়ের আত্মত্যাগ বাবাকে এগিয়ে নিয়েছে বলেই বঙ্গবন্ধু জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিতে পেরেছেন। কাজেই এ স্বাধীনতায় তার মায়ের অবদান অবিস্মরণীয়’- বলেন বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, দলের কাজকর্ম, আন্দোলন-সংগ্রামে নিজের সম্পদ দিয়ে সাহায্য করতেন মা। মা-বাবা কখনো আমাদেরকে অভাব বুঝতে দেননি। কৌশলে সেসব অভাব মেটাতেন আর আমাদের ভিন্নভাবে বোঝাতেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আব্বা বারবার কারাগারে যাওয়ার ফলে এমনও দিন গেছে যে বাজার করতে পারেননি। আমাদের বলেননি, আমার টাকা নাই। চাল-ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে আচার দিয়ে বলতেন, চলো আমরা আজ খিচুড়ি খাব। বাবা জেলে, সংসার ও সংগঠনের জন্য টাকার যোগাড় করতে গিয়ে মা বাড়ির ফ্রিজটি পর্যন্ত বিক্রি করে দিচ্ছেন অথচ বললেন, ঠান্ডা পানি খাওয়া ভাল নয়। শরীর খারাপ হতে পারে। কাজেই এর আর দরকার নেই। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার বাবা-মায়ের মধ্যে বোঝাপড়াটা খুব ভালো ছিল। বাবাকে কোনো পরামর্শ দিতে হলে আমিই চলে যেতাম মায়ের মিশন নিয়ে। বাবা ভিড়ের মধ্যেও আমাকে একবার দেখলেই বুঝতে পারতেন ‘জরুরি কোনো ম্যাসেজ আছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গমাতাই বোধ হয় সবচেয়ে আগে জানতেন, এই দেশ একদিন স্বাধীন হবে। স্কুল-কলেজের প্রথাগত শিক্ষা অর্জন করতে না পারলেও বেগম মুজিব স্বশিক্ষিত ছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আম্মার উৎসাহেই জাতির পিতা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ লিখেছিলেন এবং জাতির পিতার ডায়েরিগুলো বঙ্গমাতাই সংরক্ষণ করে রাখেন, যা পরবর্তীতে পুস্তক আকারে প্রকাশ হয়। প্রধানমন্ত্রী এ সময় বঙ্গমাতার অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনযাপনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, তিনি কোনো দিন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে থাকতে চাননি, যদি ছেলেমেয়েদের চোখ ওপরে উঠে যায়। তিনি বলেন, বঙ্গমাতা বিলাসিতাকে কখনও প্রশ্রয় দেননি। ছেলেমেয়েদের সেই আদর্শেই গড়ে তোলেন। আব্বা পাকিস্তান আমলে মন্ত্রী ছিলেন। চা-বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি ছিলেন। কিন্তু আমাদের মধ্যে বিত্ত-বিলাসিতার মোহ কখনও তৈরি হয়নি। আমার মায়ের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email