• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

‘জাতীয় আয়ের অর্থ পাঁচ শতাংশ মানুষের হাতে, ৯৫ ভাগই বঞ্চনার শিকার’

নিউজ ডেস্কঃ লিবিয়া থেকে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে অন্তত ৩৭ বাংলাদেশির মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন জাগে যে বাংলাদেশে যখন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের অনেক তরুণরা বিদেশে, বিশেষ করে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কেনো?

এ বিষয়ে ইংরেজী দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার কথা বলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এবং দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঙ্গে। সময়োপযোগী ও তাতপর্যপূর্ণ এ সাক্ষাৎকারটি দেশ নিউজের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, “উন্নয়ন তো হচ্ছে। জিডিপি যে প্রবৃদ্ধির কথা সরকার বলে সেটি তো হচ্ছে। কিন্তু, এই প্রবৃদ্ধি থেকে যে টাকা আসছে তা ‘ওয়েল ডিস্ট্রিবিউটেড’ না। অর্থাৎ, যে জাতীয় আয় যোগ হচ্ছে সেটি মাত্র শতকরা পাঁচ ভাগের হাতে আসছে। ফলে, সেই পাঁচভাগ মানুষ প্রত্যেক বছর আরও বড়লোক হচ্ছেন। বাকি ৯৫ শতাংশ তাদের কাছে আসছে না। আগে বিশ্বব্যাংক বলতো ‘চুইয়ে পড়া অর্থনীতি,’ ওটা এখন তারা বলে না। কেননা, ওটা হয় না। উপরের টাকা নিচের দিকে চুইয়ে পড়ে না। এ জন্যে পদক্ষেপ না নিলে সম্পদের বণ্টন ঠিক মতো হয় না।”

“নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড হলো সম্পদের সুষম বণ্টনের দেশ। সবচেয়ে অসম বণ্টনের দেশ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আমরা এখন ইউরোপের মডেল অনুসরণ করছি না। আমরা অনুসরণ করছি আমেরিকার মডেল। যে কারণে দেশের জনগণ যারা আর্থিকভাবে নিচের ধাপে রয়েছেন তাদের এমন অবস্থা হয়েছে। এখন স্বাভাবিকভাবেই গরিব আরও গরিব হচ্ছে। সে দেশের বাইরে চলে যাবে- এমন ভাবনা গ্রহণ করছে।”

তাহলে কি তরুণরা এই উন্নয়নের প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না?- “এটা আস্থার প্রশ্ন তো নয়। আস্থা নিশ্চয় আছে। কিন্তু, পাঁচভাগ লোকের হাতে টাকাটা চলে যাচ্ছে। ব্যাপারটা আস্থা বা অনাস্থার নয়।”

তাহলে সমস্যাটা কোথায়?- “সমস্যা হলো বণ্টনের। দেশে উচ্চমাত্রায় প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু, এর সুষম বণ্টন হচ্ছে না। সমস্যাটা এখানে।”

এখানে কি একটি আস্থার সংকট তৈরি হয় না?- “এটি আস্থা-অনাস্থার ব্যাপার নয়। অর্থনীতিবিদরা বলেন যে বণ্টনটা ঠিক মতো হচ্ছে না। আপনি রাজনৈতিক কথা বলছেন। আমি রাজনীতির লোক না। আমি বলবো যে সম্পদের যথাযথ বণ্টন হচ্ছে না। এর জন্যে পলিসি বদলানো দরকার।”

পলিসির জন্যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন নয় কী?- “তাতো বটেই। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এটা কেমনে হবে?”

তাহলে বিষয়টি ঘুরে-ফিরে রাজনীতিতেই চলে আসছে কি?- “রাজনীতিতে চলে আসছে সবকিছুই। তবে ওটাকে রাজনীতি বলবো না। আমাদের দিক থেকে বলবো পলিসি বা নীতিনির্ধারণ। বলবো, বণ্টনের পলিসি নেওয়া উচিত। সেটা তো আমি-আপনি নিতে পারি না। সেটা নিবে সরকার। সরকার মানে তো রাজনৈতিক সরকার। সব দেশেই তাই। তবে এটাকে ‘রাজনীতি’ বলা যাবে না। এটাকে ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা’ বলা যেতে পারে যা সরকারকে নিতে হবে।”

সুষম বণ্টনের প্রধান বাধা কী কী?- “কোনো বাধা নেই। আসলে এটা করতে হলে কতোগুলো সিস্টেমের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এগুলো আপনা-আপনি হয় না। সম্পদের বণ্টনের জন্যে পদক্ষেপ নিতে হবে। সেজন্যে সরকারের পলিসি আগে ঠিক করতে হবে যে তারা এটি করবে কী না। পলিসি যদি ঠিক করা হয় তাহলে অর্থনীতিবিদরা বলে দিবেন সেই পলিসি বাস্তবায়ন করতে হলে কী কী করতে হবে। আমাদের দেশে সরকারের পলিসিটাই হচ্ছে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর পলিসি। সম্পদের সুষম বণ্টনের পলিসি আমাদের নাই।”

এ বিষয়ে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “প্রথমত বলা যায়- আমাদের দেশের মানুষদের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা সবসময়ই ছিলো। সাধারণ মানুষের ধারণা- বিদেশে গেলে সহজে কর্মসংস্থান হবে। জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে। পারিবারিক অবস্থার উন্নতি হবে। দ্বিতীয় বিষয় হলো: আমাদের দেশে জাতীয় প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, উন্নয়ন হচ্ছে। আসলে সুষম উন্নয়ন কতোটুকু হচ্ছে তা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে সেই প্রশ্নের যৌক্তিকতার প্রমাণ হচ্ছে এই তরুণদের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধির ঘটনায়।”

“বিশেষ করে এখন শিক্ষিত যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমাবদ্ধ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া খুব একটা হয়নি। ফলে যাদের পেশাগত দক্ষতা তুলনামূলকভাবে বেশি রয়েছে তাদের একটি বিরাট অংশ বিদেশে যাওয়ার জন্যে আগ্রহী। যেহেতু একটা ধারণা রয়েছে যে বিদেশে গেলে কর্মসংস্থান হয়, সেই কারণে বৈধ-অবৈধ পথ বিবেচনা করা হয় না। বাইরে গেলে কর্মসংস্থান হবে, অবস্থার উন্নয়ন হবে- এই বিশ্বাসটি বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে খুব দৃঢ়। তাই মানবপাচারের বিষয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি হাতে নিলেও তা তেমন কাজে আসে না। যাত্রাপথের ঝুঁকিটিকে তারা কোনো গুরুত্ব দেন না। দেশে যেহেতু তারা নিজেদের কর্মসংস্থান করতে পারছেন না তাই তারা বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।”

তাহলে কি বলা যায় দেশে কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে বলেই তরুণরা বিদেশে যাচ্ছেন?- “হ্যাঁ, মূলত কর্মসংস্থান। আর দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে: তারা মনে করেন বিদেশে সহজেই অর্থ রোজগার করা যায়। এটি একটি বদ্ধমূল ধারণা। গড়ে ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে একজন মানুষ বিদেশে যাচ্ছেন, সেই টাকা দেশে বিনিয়োগ করে এখানে যে তারা কোনো সুযোগ করতে পারবেন সেই দিকে তাদের কোনো ভাবনা নেই। কারণ, তারা মনে করেন যে বিদেশে গেলে সহজভাবে অর্থ উপার্জন করা যায়।”

তাহলে কি বলা যায়, দেশে উন্নয়ন হলেও কাজের সুযোগ হচ্ছে না?- “উন্নয়নের সুফল সবাই সমানভাবে পাচ্ছে না। কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে না। যারা বিদেশে যেতে চান- তারা কিন্তু শিক্ষিত ছেলে- তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী যদি কর্মসংস্থান হতো তাহলে হয়তো তারা বিদেশে যাওয়ার কথা চিন্তা করতেন না। যেহেতু তাদের কাজের ব্যবস্থা হয় না তখন এর সঙ্গে অন্যান্য পারিপার্শ্বিক অবস্থা যোগ হয়। এর ফলে জমি বিক্রি করেই হোক বা ঋণ নিয়েই হোক তারা বিদেশে যাচ্ছেন। যে টাকায় তারা বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন সেই টাকায় যে এখানে অর্থবহ কিছু করা সম্ভব- সেই বিষয়টি তারা ভুলে যাচ্ছেন। অথচ, বিদেশে গিয়ে অনেকে অসহায় অবস্থায় পড়ছেন। অনেকে আবার গন্তব্য পর্যন্ত যেতেই পারছেন না।”

কর্মহীন তরুণরা কি দেশের এই উন্নয়নের প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না?- “যাদের কথা আমরা আলোচনা করছি তারা উন্নয়নের সুফল কতোটা পাচ্ছে বা সরকার যে উন্নয়নের দাবি করছে- তা কিন্তু তাদের মূল চিন্তা না। তাদের জন্যে নিজের কর্মসংস্থানটাই মূল চিন্তার বিষয়। দেশের প্রবৃদ্ধির সুফল সবাই পাচ্ছেন না। বিশেষ করে তরুণরা।”

“প্রবৃদ্ধিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে হবে। কর্মসংস্থানের দিকে নজর দিতে হবে। দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে। শিক্ষিত তরুণদের জন্যে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে, সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে প্রবৃদ্ধির সুফল সবাই পেতে পারেন। একদিনে তো হবে না, তা ক্রমান্বয়ে করতে হবে।”

“কর্মসংস্থান ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিবেচনায় বিদেশ মানেই যে স্বর্গ- এই ভাবনাটাকে কাটিয়ে উঠার জন্যে প্রচারণা চালাতে হবে।”

অথচ, বিদেশে যারা গিয়েছেন তাদেরকে যদি দেশে ফিরে আসতে বলা হয় তাহলে কিন্তু আসবেন না- “হ্যাঁ, তারা ফিরে আসবেন না। কারণ, ফিরে আসলে প্রথম কথাই হবে- তিনি নিজের মতো করে একটি কর্মসংস্থান করতে পারবেন কী না। পরের কথা হচ্ছে, ‘এতোদিন বিদেশে থাকলেন, কী নিয়ে আসলেন?’, ‘এখানে এসে কী করছেন?’- তাদেরকে নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। এছাড়াও, এখানে তাদেরকে বিভিন্ন অনিয়মের শিকার হতে হবে। অনেকে অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হয়ে বাধ্য হয়ে আবার বিদেশে চলে গেছেন- এমন ঘটনাও রয়েছে।”

এর মানে দাঁড়াচ্ছে দেশে এখনো একটি সুষ্ঠু পরিবেশ সরকার দিতে পারেনি?- “হুম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকারের অপর নাম হয়েছে যে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের অর্থ-সম্পদের বিকাশ। সেই বিবেচনায় একটি গোষ্ঠী কিন্তু সুষ্ঠু পরিবেশ ঠিকই পাচ্ছে। কিন্তু, এই সুফলটা যে টেকসই না- এটি উপলব্ধি করতে আর বেশিদিন লাগবে না বলেই আমার ধারণা। আয়-বৈষম্য থেকে শুরু করে সামাজিক বৈষম্য এবং অধিকার হরণ- এগুলো দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এই উন্নয়নের চিত্রটা ধসে পড়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হবে।”

“দেশে উন্নয়ন যেটা হচ্ছে সেটা কীসের বিনিময়ে হচ্ছে তা দেখতে হবে। এই বড় বড় প্রকল্পগুলোতে যে অর্থায়ন হচ্ছে সেগুলো যে রাষ্ট্রীয় রাজস্ব আয় থেকে হচ্ছে না- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা, আমাদের রাজস্ব আয় পৃথিবীর সর্বনিম্নের তালিকার মধ্যে পড়ে। তাই যারা বাংলাদেশে এসব বড় বড় প্রকল্পগুলোতে অর্থ বিনিয়োগ করছে তারা কী শর্তে বিনিয়োগ করছে- তা জানা প্রয়োজন। কেননা, এর মূল্য আমাদেরকে করের মাধ্যমে শোধ করতে হবে। সেদিন বেশি দূরে নয়। তখন দ্রব্যমূল্য থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার খরচ প্রচণ্ডভাবে বেড়ে যাবে এবং সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে।”

আমরা কি ‘ঋণ করে ঘি খাওয়ার’ কুফল অচিরেই ভোগ করতে যাচ্ছি?- “ঠিক সেটাই। কী শর্তে এই উন্নয়ন হচ্ছে তা আমাদের কাছে মোটেও পরিষ্কার নয়। যেমন, চীন এখানে বিনিয়োগ করছে- তারা তো এখানে দান করতে আসেনি। তারা তো সেই বিনিয়োগ থেকে মুনাফা করবে। চীনের সঙ্গে কী চুক্তি হয়েছে তা সরকার প্রকাশ করেনি। কীসের বিনিময়ে এই বিনিয়োগ হচ্ছে- তা মূল্যায়ন করতে না পারলে এটি একটি অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করবে। এতে একসময় ধস নামবে বলে আমার মনে হয়।”

Print Friendly, PDF & Email