'ক্ষুধা বনাম চক্ষুলজ্জা'

করোনা মধ্যবিত্তকে নামাচ্ছে নিম্নবিত্তের কাতারে

নিউজ ডেস্ক |

ঘরে খাবার নেই, চক্ষুলজ্জায় হাতও পাততে পারছেন না৷ অন্যদিকে ভাড়া পরিশোধের জন্য বাড়ি মালিকের চাপ, জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে মধ্যবিত্তদের৷

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মরতদের অনেকে বেতন পাচ্ছেন না৷ সঞ্চিত অর্থ শেষের পথে, আছেন চাকুরি হারানোর শঙ্কায়৷ সরকারের কোন প্রণোদনার মধ্যেও নেই তারা৷ ফলে চলমান লকডাউনের মধ্যে মহাসংকটে পড়েছেন বাংলাদেশে ‘গৃহবন্দি’ কয়েক কোটি মধ্যবিত্ত৷ অর্থনীতিবিদরা মনে করেন এইসব পরিবারের অনেকেই এখন নিম্নবিত্তের স্তরে নেমে আসছেন৷

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের চার কোটি পরিবার আছে৷ এর মধ্যে নিম্নবিত্ত ২০ ভাগ আর উচ্চবিত্ত ২০ ভাগ৷ মাঝের যে ৬০ ভাগ এরা নিম্ন-মধ্য ও উচ্চ মধ্যবিত্ত৷ এই সংখ্যা আড়াই কোটি পরিবার হবে৷ এর মধ্যে সরকারি চাকুরিজীবী, মাল্টিন্যাশনাল ও বড় কোম্পানিতে কাজ করা কিছু মানুষ বাদে অন্যরা সবাই সংকটে আছেন৷ এদের মধ্যে বড় একটা অংশ চাকুরি ঝুঁকিতে আছেন৷ অনেকেরই বেতন হয়নি, অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে৷ ফলে তারা বেতন তো পাননি, উল্টো চাকুরি ঝুঁকিতে আছেন৷ এই মানুষগুলো সরকারি কোন কর্মসূচির মধ্যেও নেই৷ তবে সরকার এসএমই ঋণ দিয়ে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্তদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে৷ তবে এই সংখ্যাও খুব বেশি না৷ বিপুল জনগোষ্ঠী এখনও সহায়তার বাইরে৷’’ 

অনেকের ঘরে খাবার নেই

আবু জাফর মিরপুরের কাজীপাড়ায় স্যানিটারি সামগ্রী বিক্রি করেন৷ তার দোকানে দুইজন কর্মচারি৷ ২৫ মার্চ দোকান বন্ধের আগে হাতে যে টাকা ছিল তা দিয়ে কর্মচারিদের মার্চ মাসের বেতন দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন৷ সামান্য টাকা রেখেছিল নিজের পরিবারের খরচ মেটাতে৷ যা এরিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে৷ রোজগারের জন্য দোকান খুলতে পারছেন না৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে জাফর বলেন, ‘‘আমি কোনভাবেই কর্মচারিদের এপ্রিল মাসের বেতন দিতে পারব না৷ নিজেই খাওয়ার জন্য এক আত্মীয়ের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করেছি৷ এখনও বাড়ি ভাড়া দিতে পারিনি৷ মালিক চাপ দিচ্ছে৷ চার সদস্যের পরিবার নিয়ে খুবই সংকটে আছি৷ এই অবস্থা আর ১৫ দিন থাকলে আমাকে পথেই নামতে হবে৷’’

আফরোজা আক্তার দর্জির কাজ করেন৷ তার স্বামী একটি দোকানের কর্মচারি৷ তিন মেয়ে নিয়ে কোনোমতে সংসার চলে তাদের৷ করোনায় স্বামী-স্ত্রীর কোনো কাজ না থাকায় তীব্র খাবার সংকটে পড়েছেন এই দম্পতি৷ ডয়চে ভেলেকে আফরোজা বলেন, নিরুপায় হয়ে তিনি স্থানীয় থানার ওসিকে ফোন দিয়েছিলেন৷ ওসি অপারগতা প্রকাশ করেন৷ পরে ওই এলাকার কাউন্সিলর কিছু সাহায্য দেওয়ার আশ্বাস দিলেও চারদিনেও কিছু পাননি৷ পরে একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাদের কিছু সাহায্য দিয়েছে।

তবে মধ্যবিত্তের  অনেকেই চক্ষুলজ্জায় মানুষের কাছে সাহায্য চাইতে পারছেন না৷ নিজেদের পরিস্থিতি বাইরের কাউকে তারা জানাতেও পারছেন না৷

সব ধরনের কোম্পানি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য ১১০ কোটি ডলারের ঋণ দিচ্ছে জার্মান সরকার৷ দুর্যোগকালীন এই পরিস্থিতি সামাল দিতে মোট ৮০ হাজার কোটি ডলারের তহবিল রয়েছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷ কোম্পানিগুলোর আর্থিক স্বচ্ছলতা বজায় রাখতে দেয়া হচ্ছে কর-ছাড়৷ দেরিতে ঋণ পরিশোধে গুণতে হবে না জরিমানা৷ প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটকে দেয়া হবে সাড়ে ১৪ কোটি ইউরো৷

সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে মধ্যবিত্ত

এমন পরিস্থিতিতে কিভাবে চলছেন দেশের কয়েক কোটি মধ্যবিত্ত? পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘মধ্যবিত্তের কিছু সঞ্চয় থাকে৷ গেল এক মাসের লকডাউনে তারা সেই সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে৷ এভাবে আরেকমাস চললে তাদের সেই সঞ্চয়ও শেষ হয়ে যাবে৷ তখন কি পরিস্থিতি দাঁড়াবে? বিপুল সংখ্যক মধ্যবিত্ত এই পরিস্থিতিতে নিম্নবিত্তে পরিণত হবেন৷ সবচেয়ে বড় সংকট হবে যখন সবকিছু স্বাভাবিক হবে তখন তো বিপুল সংখ্যক মানুষ চাকুরি হারাবেন৷ উন্নত দেশে তো বেকার ভাতা দেওয়া হয়৷ এখানে সেই ব্যবস্থা নেই৷ তাহলে এই মধ্যবিত্ত বেকার শ্রেণী কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? সরকারের যে প্রণোদনা সেখানেও কিছু মধ্যবিত্তের কোন অবস্থান নেই৷ আবার আমাদের যে ব্যবস্থা সেখানে সরকার চাইলেও মধ্যবিত্তকে কিছু করতে পারে না৷ আসলেই বাংলাদেশে মধ্যবিত্তরা ভয়াবহ সংকটে আছেন৷’’

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘এই কারণেই আমরা নগদ প্রনদোনার কথা বলেছিলাম৷ আমাদের দেশে ছয় কোটি ১০ লাখ শ্রমিক আছেন৷ এর মধ্যে এক কোটি শ্রমিক দিন এনে দিন খায়৷ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কর্মসংস্থান যারা করেন তাদের সংখ্যা দুই কোটি ২০ লাখ৷ আমরা সরকারকে বলেছি, একটি পরিবারে চারজন আছেন এমন একটি পরিবারকে মাসে আট হাজার টাকা হিসেবে দুই মাসের ১৬ হাজার টাকা দিতে৷ তাতে সরকারের ২৭ হাজার কোটি টাকা লাগবে, যা জিডিপির এক শতাংশ৷ এভাবেই এই ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের সহায়তা করা যেতে পারে৷’’ 

চাকুরি হারানোর শঙ্কায় অনেকে

মোহাম্মদপুরে থাকেন আমিনুল ইসলাম ও ফাতেমা আক্তার দম্পত্তি৷ একটি ‘ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ কোম্পানিতে চাকুরি করেন আমিনুল৷ তার স্ত্রী ফাতেমা একটি বেসরকারি স্কুলে চাকুরি এবং টিউশন করে সংসার চালান৷ কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে তিনি বেতন পাচ্ছেন না৷ আমিনুল অর্ধেক বেতন পেয়েছেন৷ কোনোমতে চলছে সংসার, কিন্তু এখনো বাসাভাড়া মেটাতে পারেননি৷ 

আমিনুল জানান, সামনের মাসে বেতন দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে তার চাকুরিদাতা প্রতিষ্ঠান৷ এমনকি চাকুরি থাকবে কি না তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা৷ চলতি এপ্রিল মাসে বেতন না পেলে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই পরিবারটির৷ তাদের মতো অনেকেই আছেন চাকরি হারানোর এমন আতঙ্কে৷

মধ্যবিত্তদের পাশে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন

মধ্যবিত্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে অনেক বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন৷ বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার জসিম উদ্দিন খান ও প্রেস ইনস্টিটিউটের সহকারি প্রশিক্ষক বারেক কায়সারসহ আরো কয়েকজন মিলে গড়ে তুলেছেন ‘সঙ্গে আছি’ নামে একটি সংগঠন৷ এই সংগঠনের উদ্যোগে শনিবার পর্যন্ত পাঁচ হাজার পরিবারের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে৷ এর মধ্যে দুই হাজার মধ্যবিত্ত পরিবার৷ তারা মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষকে চাল-ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দিচ্ছেন৷ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বারেক কায়সার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সবচেয়ে কষ্টে আছে মধ্যবিত্ত৷ তারা হাত পাততে পারে না, আবার ঘরে খাবার নেই৷’’ ফলে তাদের কাছে যারা ফোন করছেন তাদের বাসায় গিয়ে এগুলো পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে৷ তাদের সংগঠনকে যারা সহায়তা দিচ্ছেন বা যারা তাদের কাছ থেকে সহায়তা নিচ্ছেন তাদের কারো নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না৷

এমন আরেকটি সংগঠন ‘সহমর্মিতা ফাউন্ডেশন’৷ যাদেরকে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে, তাদের ছবি তো দূরের কথা, পরিচয়ও প্রকাশ করা হচ্ছে না৷ সহমর্মিতা ফাউন্ডেশনের পরিচালক পারভেজ হাসান বলেন, ‘‘একজন মধ্যবিত্ত কোন অবস্থাতেও তার খারাপ অবস্থার কথা কাউকে জানতে দিতে রাজি হয় না৷ কারণ তাদের ক্ষুধার ভয়ের থেকে চক্ষুলজ্জার ভয় বেশি থাকে৷ তাদের হেল্পলাইনে কেউ ফোন করলে তাদের গোপনে গিয়ে খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে৷’’ 

  • ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন
Print Friendly, PDF & Email