শিরোনাম :

  • বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০২৫

মে দিবসের শপথ হোক, সর্বাত্মক লড়াইয়ে গণমাধ্যমে চাকরি ও জীবনের নিরাপত্তা ফেরানো

এম আবদুল্লাহ

মে দিবস প্রতিবছরই আসে। এবারও এসেছে। তবে এবারের মে দিবসের রূপ সম্পূর্ণ ভিন্ন। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের আগ্রাসনে বিপর্যস্ত দুনিয়ায় দিবসটির চেহারা বদলে গেছে। মে দিবস মানেই দুনিয়াজুড়ে শ্রমজীবী মানুষের বর্ণাঢ্য র‌্যালি, নিজেদের দুঃখ কষ্টের কথা উচ্চকিত কন্ঠে জানান দেয়া। প্রাণঘাতী করোনা সংক্রমণে গোটা দুনিয়া এখন টালমাটাল। বিশ্বের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ কাজ হারিয়ে অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তাদের ফিরতে হচ্ছে কল-কারাখানায়। মৃত্যু-ঝুঁকি তুচ্ছ করে যেতে হচ্ছে মাঠে-ঘাটে, কর্মস্থলে। এবার ঠিক এমন একটি সময়ে বিশ্ববাসী পালন করতে যাচ্ছে শ্রমিকের অধিকার আদায়ের ঐতিহাসিক দিন ‘মহান মে দিবস’।

বাংলাদেশে এ দিনটিতে রাজধানী থেকে শুরু করে উপজেলা শহর পর্যন্ত লাল পতাকা ও নানা ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে রাজপথ মুখর করে তুলতো শ্রমজীবী মানুষ। বিভিন্ন শ্রমঘন প্রতিষ্ঠান ও শ্রমিক সংগঠনগুলো খেটেখাওয়া মানুষদের জন্য ভালো খাবার দাবারের আয়োজন করতো। হতো আলোচনা সভা ও সেমিনার-সিম্পোজিয়াম। কিন্তু এবার দিবসটি পালিত হচ্ছে লকডাউনে। গৃহবন্দী জীবনে ভুখা-নাঙ্গা শ্রমিকরা নিদারুন কষ্টে দিন কাটালেও তাদের জন্য উৎসর্গিত দিনটিতে নির্বাক থাকতে হচ্ছে। ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ স্লোগানে প্রকম্পিত করতে পারছে না শহর-বন্দর।

মে দিবসের ইতিহাস সবার জানা । ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকেরা শ্রমের উপযুক্ত মূল্য এবং দৈনিক অনধিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। এতে অনেক শ্রমিক হতাহত হন। তাদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে দৈনিক কাজের সময় আট ঘণ্টা নির্ধারণ হয়। এরপর থেকে দিনটি ‘মে দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামে অনুপ্রেরণার উৎস এই দিবসটি মালিক-শ্রমিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠারও দিন। শ্রমিকদের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটারও দিন এটি।
বাংলাদেশে শ্রেণী চরিত্র অনুযায়ী শ্রমিকের পরিচয়েও আছে ভিন্নতা। কলকারখানার শ্রমিক, দিন মজুর, কৃষি খাতের কর্মী ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত শ্রমজীবী মানুষ। বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী অন্য শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে সংবাদকর্মীরাও অন্তভর্’ক্ত। বিশেষ করে ২০০৬ সালে শ্রম আইনের এক সংশোধনীতে সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থায় কর্মরতদের শ্রমিক শ্রেণীর আওতায় এনে নানা বিধান করা হয়েছে।
সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে সাংবাদিক ইউনিয়নই প্রধানতঃ সংবাদমাধ্যমে নিয়োজিত কর্মীদের অধিকার সংরক্ষণ ও আদায়ে সোচ্চার ভ’মিকা পালন করে আসছে যুগ যুগ ধরে। সাংবাদিক ইউনিয়নও শ্রম আইনের আওতায় একটি ট্রেড ইউনিয়ন। গার্মেন্টস শ্রমিক, শিল্প শ্রমিকরা যেমন শ্রম দফতর থেকে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের মাধ্যমে দাবি-দাওয়া নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দরকষাকষি করে, ঠিক একইভাবে রেজিস্ট্রার্ড সাংবাদিক ইউনিয়ন জন্মলগ্ন থেকে সংবাপত্র তথা সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের অধিকার নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছে। সাংবাদিক ইউনিয়ন যে কয়টি দিবস অবশ্য-অবশ্যই পালন করে থাকে তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে মে দিবস। এ দিনে আলোচনা সভা, সেমিনার সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে সংবাদকর্মীদের দুঃখ-দুর্দশার কথা মালিকপক্ষ ও সরকারের নজরে আনার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। এবারই প্রথম সে ধরণের কোন আয়োজন ছাড়াই সাংবাদিক ইউনিয়ন দিনটি অতিবাহিত করছে। যদিও এ সময়টাতে সংবাদকর্মিরা সর্বকালের সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত জীবন অতিবাহিত করছে। সাংবাদিকদের পেশা ও জীবনের নিরাপত্তা এখন ভয়ানকভাবে বিপন্ন।
এমনিতেই বাংলাদেশের গণমাধ্যম খাদের কিনারে চলে গিয়েছিল। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতরার অধিকার হারিয়ে পাঠক-দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতার সংকটে পড়েছে দেশের গণমাধ্যম। সরকার ও প্রভাবশালী মহলের দৃশ্য-অদৃশ্য চাপ, হস্তক্ষেপ, চোখরাঙানিতে অসহায় সংবাদমাধ্যম পাঠক-দর্শকদের আনুকূল্য হারাচ্ছিল বেশ কয়েক বছর ধরেই। তার রেশে আর্থিক সংকট গ্রাস করে চলেছে গোটা সেক্টরকে। ফলশ্রুতিতে গণমাধ্যম কর্মীদের মাসের পর মাস বেতন-ভাতা বকেয়া, চাকরিচ্যুতি, ন্যায্য অধিকার বঞ্চনা নৈমিত্যিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এর মধ্যে গোদের ওপর বিষপোঁড়া হয়ে আসে মহামারি করোনাভাইরাস। গত দুই মাসে করোনাভাইরাসের অভিঘাতে অন্যান্য সেক্টরের মত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানও নাজুক অবস্থায় পতিত হয়।
সংবাদকর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে আগে থেকে চলে আসা সংকট আরও ঘনিভ’ত হয়। সঙ্গে যুক্ত হয় পেশাগত দায়িত্ব পালনে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম প্রয়োজনীয় সুরাক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই সংবাদকর্মীদের কাছ থেকে কাজ আদায়ের অমানবিক পন্থা বেচে নেয়। এরই মধ্যে অন্ততঃ ৪৫ জন সাংবাদিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। দু’জন জীবন দিয়েছেন। শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান বাদ দিলে মাঝারি ও ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলো করোনার অজুহাতে বেতন-ভাতা পরিশোধ বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি দুর্যোগকালীন এ সময়কে মোক্ষম সুযোগ হিসেবে নিয়ে গণহারে সংবাদকর্মীদের চাকরিচ্যুত করে চলেছে। প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন প্রতিষ্ঠান থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে সাংবাদিকের চাকরি যাওয়ার খবর আসছে। মে দিবসের আগের দিন ৩০ এপ্রিলও একাধিক মিডিয়া হাউজ থেকে সংবাদকর্মীদের চাকরিচ্যুতির নোটিশ ধরিয়ে দেওয়ার খবর এসেছে।
একদিকে মহামারির মহাদুর্যোগ, অন্য দিকে পবিত্র রমজান ও ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখেও গণমাধ্যম মালিকরা নিষ্ঠুর আচরণ করছেন। করোনার কারণে সাংবাদিক সংগঠনগুলোর মাঠ পর্যায়ে আন্দোলন-সংগ্রামে সীমাবদ্ধতার সুযোগটিও অনেক অবিবেচক মালিক কাজে লাগাচ্ছেন বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সব মিলিয়ে এক ঘনঘোর অন্ধকারের পথে যাত্রা করেছে সংবাদমাধ্যমে কর্মরত শ্রমজীবী-কর্মজীবী মানুষগুলো। অনেকের ঘরে খাবার নেই। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর সক্ষমতা হারিয়েছেন অধিকাংশ সংবাদকর্মী। অসুস্থতায় চিকিৎসা এবং ওষুধ-পথ্য যোগানোর ন্যুনতম সামর্থ্যও নেই তাদের।
এমনই এক পরিস্থিতিতে মে দিবস উপস্থিত। দিবসটি মূল বার্তা হচ্ছে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই। আর সেই লড়াইটা এখন সবচেয়ে জরুরী হয়ে পড়েছে সংবাদকর্মীদের জীবনে। অনেক সংবাদমাধ্যমের মালিক সাংবাদিকদের রক্ত-ঘাম ঝরানো শ্রমের বিনিময়ে নিজেদের ব্যবসায়িক সা¤্রাজ্য গড়েছেন এবং রক্ষা করছেন। কিন্তু সংবাদকর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের প্রশ্নে সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের লাভ-ক্ষতির হিসাব দেখাচ্ছেন। সরকারের কাছে বিজ্ঞাপনের বিল বকেয়ার অজুহাত সামনে আনছেন।
সংবাদকর্মীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে অনেক আগেই। এখন ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। শোষকদের বিরুদ্ধে আর প্রতিবাদ নয়, প্রতিরোধের সময়। সুদৃঢ় ঐক্য আর সর্বাত্মক সংগ্রামের মাধ্যমে অধিকার ছিনিয়ে আনার সময় এখন। টুয়েন্টি-টুয়েন্টির মে দিবসের শপথ হোক মরণপন লড়াইয়ের মাধ্যমে শোষণ-বঞ্চনা আর নিপীড়নের অবসান, পেশা ও জীবনে নিরাপদ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা।

লেখকঃ মহাসচিব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন- বিএফইউজে