আইটিডি ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে চবির সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে ১৭ গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন
টাকার খোঁজে দেশে-বিদেশে ধর্ণা সরকারের, ঋণের বড় ফাঁদে ঘুরপাক
এম আবদুল্লাহ ♦
আগে থেকেই খরচ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিল সরকার। কারণ, ব্যয়ের খাত কেবল বড়ই হচ্ছে, অথচ আয়ে আছে বড় ঘাটতি। ব্যয়ের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ নেই সরকারের কাছে। বরং টাকার মহাসংকটে ছিল সরকার।
করোনাকাল শুরুর আগেই সরকার পরিচালনার খরচ বেড়েছে ব্যাপকভাবে । বাড়ানো হয়েছে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা। বাজেট ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেওয়ায় সুদ পরিশোধ ব্যয়সীমা ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। বিশাল বাজেট-বড় ঘাটতি-ব্যয়বহুল ঋণ-সুদ পরিশোধ-আবার বড় বাজেট-আবার ঘাটতি-আরও সুদ পরিশোধ—এভাবেই ঋণের বড় ফাঁদে ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশ।
এমনই পটভূমিতে করোনাভাইরাসের প্রভাবে সরকারের আয় কমে গেছে। সারা দেশ কার্যত বিচ্ছিন্ন থাকায় ভ্যাট, আয়কর ও শুল্ক আদায় স্থবির। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্য বলছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে এ বছর রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। আগামী বছরও কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় মিলবে না। অন্যদিকে সরকারের ব্যয় দিন দিন বাড়ছে। করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য এরই মধ্যে এক লাখ কোটি টাকার বেশি প্রণোদনা ঘোষণা করেছে সরকার। একদিকে রাজস্ব আদায়ের হার কম, অন্যদিকে প্রণোদনার টাকার জোগান দেওয়া নিয়ে প্রচণ্ড চাপে পড়েছে সরকার। চলমান আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে উন্নয়ন সহযোগীদের দ্বারস্থ হয়েছে সরকার। নিম্ন আয়ের মানুষ ও শ্রমজীবীদের সহায়তা করতে সরকার উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের পাশাপাশি বাজেটে সহায়তা দেওয়ার অনুরোধ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। কোন কোন উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়াও মিলেছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, সামাজিক সুরক্ষার আওতায় স্বল্প আয়ের মানুষদের সহায়তা দেওয়ার জন্য বহুজাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ৭৫ কোটি ডলার চেয়েছে সরকার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ছয় হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। এই টাকা চাওয়া হয়েছে বাজেট সহায়তার অংশ হিসেবে। বাজেট সহায়তার বাইরে কভিড-১৯ মোকাবেলায় স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনার জন্য বহুজাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংক থেকে আরো ১০ কোটি ডলার চাওয়া হয়েছে। যে টাকা এরই মধ্যে ছাড় করতে শুরু করেছে বিশ্বব্যাংক। আরেক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ৫০ কোটি ডলার চাওয়া হয়েছে বাজেট সহায়তার জন্য। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ চার হাজার ২৫০ কোটি টাকা। বাজেট সহায়তার বাইরে স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনার জন্য ১৩ কোটি ডলার দিচ্ছে এডিবি। বাজেট সহায়তার অর্থ হলো—সরকার এই টাকা চাইলে যেকোনো খাতে খরচ করতে পারে বিনা প্রশ্নে। এবং এই টাকা দ্রুত পাওয়া যায়।
ইআরডির বিশ্বব্যাংক শাখার প্রধান ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব শাহাবুদ্দিন পাটওয়ারী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাংকের কাছে বাজেট সহায়তা ও স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনার জন্য মোট ৮৫ কোটি ডলার চাওয়া হয়েছে । যার মধ্যে স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনার প্রকল্পটি অনুমোদন হয়েছে। বাজেট সহায়তার টাকাও পাওয়া যাবে।
ইআরডি জানাচ্ছে , বাজেট সহায়তার জন্য বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধুপ্রতিম দেশ জাপানের কাছে ১০০ কোটি ডলার চেয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ আট হাজার ৫০০ কোটি টাকা। জাপানের কাছে বাজেট সহায়তার জন্য ১০০ কোটি ডলার চেয়েছে সরকার। তারা ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। অন্যদিকে চীনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত নতুন ব্যাংক এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংকের কাছে চাওয়া হয়েছে বাজেট সহায়তা ও স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনার জন্য মোট ৪৫ কোটি ডলার। এর মধ্যে বাজেট সহায়তার জন্য চাওয়া হয়েছে ২৫ কোটি ডলার। বাকি ২০ কোটি ডলার খরচ হবে কভিড-১৯ মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতে। বিনিময় ভারসাম্য বা ব্যালান্স অব পেমেন্ট ঠিক রাখতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে চাওয়া হয়েছে ৭৫ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ছয় হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া আইডিবি থেকে চাওয়া হয়েছে ১০ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৮৫০ কোটি টাকা। আইডিবির আরেক সহযোগী সংস্থা আইটিএফসির কাছে চাওয়া হয়েছে পাঁচ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৪২৫ কোটি টাকা।
কভিড-১৯ মোকাবেলায় স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কিনতে বাংলাদেশকে এক কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ)। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৮৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া বাজেট সহায়তার জন্য সংস্থাটি আরো চার কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। রাজস্ব আদায়ের হার কম হওয়ায় এখন উন্নয়ন সহযোগীদের টাকায় শ্রমজীবী ও ছোট পুঁজির উদ্যোক্তাদের সহায়তা দেওয়া হবে।
সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার হার বেশি হয়ে যাওয়ায় নতুন করে আর ব্যাংক খাতের ওপর চাপ দিতে চায় না সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার ব্যাংক থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। কিন্তু অর্থবছরের সাত মাস না যেতেই লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে ফেলেছে সরকার। তাই করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সরকার নতুন করে আর ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে আগ্রহী নয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে চায় না সরকার।
কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা ছাপালে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিতে পারে, সে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে আপাতত সরে এসেছে সরকার। অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন, চলমান দুর্যোগ মোকাবেলায় এই মুহৃর্তে তাদের সামনে দুটি উপায় আছে। একটি হলো সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অব্যয়িত টাকা নিয়ে আসা। আরেকটি হলো, উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে সহজ শর্তে ঋণ নেওয়া। এই দুটি পথেই হাঁটছে সরকার। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে এক লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। প্রকল্প আছে এক হাজার ৭০০টি। অনেক মন্ত্রণালয় আছে; যারা তাদের বরাদ্দের পুরো টাকা খরচ করতে পারবে না।
এডিপিতে থোক বাবদ এক হাজার ৬৩০ কোটি টাকা আছে। সরকার চাইলে এই টাকা করোনাভাইরাস মোকাবেলায় খরচ করতে পারে বলে মত দিয়েছেন অনেকে । থোক বরাদ্দের বাইরেও প্রকল্পে অব্যবহৃত টাকাও আনা যাবে।
এটা অনেকেরই জানা যে, কর-জিডিপির অনুপাতের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে সর্বনিম্ন অবস্থানে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত বছর জুনে বাজেট বক্তৃতায় নিজেই বলেছেন, ‘দেশে ৪ কোটি নাগরিক মধ্যম আয়ের অন্তর্ভুক্ত থাকলেও আয়কর দেয় মাত্র ২১-২২ লাখ।’ আয় বাড়াতে নতুন ভ্যাট আইন চালু করা হলেও ব্যবসায়ীদের চাপে তা অনেকটা প্রায় আগের আইনের মতোই রয়ে গেছে। এ থেকে রাজস্ব আদায়ে বড় কোনো পরিবর্তন আসবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন না। আবার উৎসে কেটে নেওয়া হয় বলে চাকরিজীবীদের কাছ থেকেই আয়কর বেশি পায় সরকার। যাঁরা ফাঁকি দেন, তাঁরা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন। সব মিলিয়ে সরকারের আয় বাড়ানোর পথ এখনো অনেকটাই সীমিত হয়ে আছে।
সরকারের বিপুল অর্থ খরচের চাহিদা আছে। কিন্তু সরকার এখন আয় করার কঠিন পথে না গিয়ে সহজ পথে হাঁটার চেষ্টা করছে। রাজস্ব আদায়ের পরিধি বাড়ানোর দিকেই সরকারের নজর । আবার স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে টাকা নিতে আইন পাশ করেছে। আমরা উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হতে চাই। কিন্তু এত কম রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত দিয়ে তা সম্ভব নয়। তাই অর্থ সংগ্রহের সহজ পথে না গিয়ে রাজস্ব খাত সংস্কারের কঠিন পথেই যেতে হবে সরকারকে।
এদিকে আয়ের তুলনায় ব্যয় যত বাড়ছে, সরকারও তত বেশি ঋণের ফাঁদে পড়ছে। যেমন গেল অর্থ বছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকারের অর্থায়নের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ৯০ কোটি টাকা। তার আগের অর্থবছরেও তা ছিল সাড়ে ৮৭ হাজার কোটি টাকা। সরকারের নেওয়া মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ এখন জিডিপির ১৭ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
গত ১১ বছরে সরকার সবচেয়ে বেশি বাড়িয়েছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা। এতে দুর্নীতি না কমলেও ব্যয় বেড়েছে বিপুল। মোট বাজেটের ২৮ শতাংশই খরচ হয় বেতন, ভাতা ও পেনশন খাতে। আরেকটি বড় খাত হচ্ছে সুদ পরিশোধ, প্রায় সাড়ে ১৮ শতাংশ। সরকার প্রতিবছর ঋণ করে ঘাটতি মেটাচ্ছে। আর এ ঋণের বড় অংশই আসছে ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও সঞ্চয়পত্রের মতো অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। সঞ্চয়ের নিরাপদ বিকল্পের অভাব ও জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে সরকার সঞ্চয়পত্রের সুদের হারও কমাতে পারছে না। এতে সুদ পরিশোধ ব্যয়সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিশাল বাজেট-বড় ঘাটতি-ব্যয়বহুল ঋণ-সুদ পরিশোধ-আবার বড় বাজেট-আবার ঘাটতি-আরও সুদ পরিশোধ—এভাবেই ঋণের এই ফাঁদে পড়ে আছে বাংলাদেশ।
স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ—এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে এখন প্রায় সোয়া ২ লাখ কোটি টাকা আছে। বছর খানেক ধরে সরকারের নজর সেদিকে । এই অর্থের ৭৫ শতাংশ নিয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করতে একটি নতুন আইনের অনুমোদন করেছে মন্ত্রিপরিষদ।
স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার সিদ্ধান্তটি অর্থনীতির জন্য কি ধরনের প্রভাব ফেলবে সেটাও বড় প্রশ্ন । কেউ কেউ বলছেন, এসব প্রতিষ্ঠান তো সরকারেরই। এই উদ্যোগ কার্যকর হলে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা পাওয়া যাবে, যা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) সমান। সরকার এখন বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, টাকার দরকার আছে। নিতে পারে। আবার অন্য বিশ্লেষণও আছে। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো ফতুর হয়ে গেলে তারা ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কাও প্রবল।