শিরোনাম :

  • বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪

কবি সাংবাদিক ফররুখ আহমদের জন্মবার্ষিকী আজ

নিজস্ব প্রতিবেদক |

‘মুসলিম রেনেসাঁর কবি’ ফররুখ আহমদের ১০২তম জন্মবার্ষিকী আজ বুধবার। প্রখ্যাত এই বাংলাদেশী কবির কবিতায় বাংলার অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অনুপ্রেরণা প্রকাশ পেয়েছে। বিশ শতকের এই কবি ইসলামী ভাবধারার বাহক হলেও তাঁর কবিতা প্রকরণকৌশল, শব্দচয়ন এবং বাক্প্রতিমার অনন্য বৈশিষ্টে সমুজ্জ্বল। আধুনিকতার সকল লক্ষণ তাঁর কবিতায় পরিব্যাপ্ত। তাঁর কবিতায় রোমান্টিকতা থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের ধারাবাহিকতা পরিস্ফুট।

ফররুখ আহমদের জন্ম ১৯১৮ ঈসায়ী সালের ১০ জুন মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামে। তার বাবা  সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর। মায়ের নাম রওশন আখতার। তিনি খুলনা জিলা স্কুল থেকে ১৯৩৭ সালে ম্যাট্রিক এবং কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ১৯৩৯ সালে আই.এ. পাস করেন। এরপর স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন এবং ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি বামপন্থী রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়েন। তবে চল্লিশের দশকে তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসে পরিবর্তন আসে। তিনি ভারত বিভাগ তথা পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেন।

১৯৪২ সালের নবেম্বর মাসে আপন খালাতো বোন সৈয়দা তৈয়বা খাতুন লিলির সঙ্গে ফররুখ আহমদের বিয়ে হয়। তাঁর নিজের বিয়ে উপলক্ষে ফররুখ ‘উপহার’ নামে একটি কবিতা লেখেন যা ‘সওগাত’ পত্রিকায় অগ্রহায়ণ ১৩৪৯ সংখ্যায় ছাপা হয়।

ফররুখ আহমদের ছেলে-মেয়ে ১১ জন। তাঁরা হলেন- সৈয়দা শামারুখ বানু, সৈয়দা লালারুখ বানু, সৈয়দ আবদুল্লাহিল মাহমুদ, সৈয়দ আবদুল্লাহেল মাসুদ, সৈয়দ মনজুরে এলাহি, সৈয়দা ইয়াসমিন বানু, সৈয়দ মুহম্মদ আখতারুজ্জামান [আহমদ আখতার], সৈয়দ মুহম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান, সৈয়দ মুখলিসুর রহমান, সৈয়দ খলিলুর রহমান ও সৈয়দ মুহম্মদ আবদুহু।


ফররুখ আহমদের কর্মজীবন শুরু হয় কলকাতায়। ১৯৪৩ সালে আই.জি.প্রিজন অফিসে, ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইতে এবং ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরি করেন তিনি। ১৯৪৫ সালে তিনি মাসিক ‘মোহাম্মদী’-র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তবে শেষ পর্যন্ত স্থায়ীভাবে চাকরি করেন ঢাকা বেতারে। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে ফররুখ আহমদ কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে এসে ঢাকা বেতারে যোগ দেন। এখানেই প্রথমে অনিয়মিত হিসেবে এবং পরে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ফররুখ আহমদ রাষ্ট্ররোষের শিকার হয়ে ঢাকায় ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর সন্ধ্যাবেলায় ইন্তিকাল করেন।

সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তাঁর প্রধান পরিচয় ‘কবি’। ফররুখ আহমদ কিছু সনেট রচনাও করেছেন। তাঁর রচনায় ধর্মীয় ভাবধারার প্রভাব দেখা যায়। এছাড়া আরবি ও ফার্সি শব্দের প্রাচুর্য তাঁর লেখার অন্যতম  বৈশিষ্ট্য। তিনি ভাষা আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই কবি ফররুখ আহমদ আশ্বিন ১৩৫৪ (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৪৭) সংখ্যা মাসিক সওগাত-এ ‘পাকিস্তান : রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য’ নিবন্ধে লেখেন: “গণতান্ত্রিক বিচারে যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাকে পর্যন্ত যারা অন্য একটি প্রাদেশিক ভাষায় রূপান্তরিত করতে চান তাদের উদ্দেশ্য অসৎ। পূর্ব পাকিস্তানের সকল অধিবাসীর সাথে আমিও এই প্রকার অসাধু প্রতারকদের বিরুদ্ধে আমার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।”
তার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘সাত সাগরের মাঝি (ডিসেম্বর, ১৯৪৪)’, ‘সিরাজাম মুনীরা (সেপ্টেম্বর, ১৯৫২)’, ‘নৌফেল ও হাতেম (জুন, ১৯৬১)’, ‘মুহূর্তের কবিতা (সেপ্টেম্বর, ১৯৬৩)’, ‘ধোলাই কাব্য (জানুয়ারি, ১৯৬৩)’, ‘হাতেম তায়ী (মে, ১৯৬৬)’, ‘নতুন লেখা (১৯৬৯)’, ‘কাফেলা (আগস্ট, ১৯৮০)’, ‘হাবিদা মরুর কাহিনী (সেপ্টেম্বর, ১৯৮১)’, ‘সিন্দাবাদ (অক্টোবর, ১৯৮৩)’, ‘দিলরুবা (ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৪)’ ইত্যাদি। শিশুতোষ গ্রন্থসমূহ হলো ‘পাখির বাসা (১৯৬৫)’, ‘হরফের ছড়া (১৯৭০)’, ‘চাঁদের আসর (১৯৭০)’, ‘ছড়ার আসর (১৯৭০)’ ও  ‘ফুলের জলসা (ডিসেম্বর, ১৯৮৫)’।


বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৬০ সালে ফররুখ আহমদ ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ লাভ করেন। যশস্বী এই কবি ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট পদক ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’ এবং ১৯৬৬ সালে পান ‘আদমজী পুরস্কার’ ও ‘ইউনেস্কো পুরস্কার’। ১৯৭৭ ও ১৯৮০ সালে তাকে যথাক্রমে মরণোত্তর ‘একুশে পদক’ ও ‘স্বাধীনতা পদক’ দেয়া হয়।