শিরোনাম :

  • মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০২৫

কেন এমন মানসিক গোলাম হয়ে গেলাম?

?আরিফুল হক?

একটা স্বাধীন দেশ অপর দেশের ডিকটেশনে চলছে । যা চাইছে তাই দিতে হচ্ছে ! নিজেদের ন্যায্য পাওনা মিঁউমিঁউ শব্দে চাওয়ার সাহস পর্যন্ত নেই । কেন এমন হল ? এ কেমন স্বাধীনতা ? যার মাথার উপর ছাদ নেই , পায়ের নিচে মাটি নেই, বর্তমান অন্ধকার , অতীত কুয়াশাচ্ছন্ন , ভবিষ্যত বলে কিছু নেই। এ কেমন নির্জীব-নির্লিপ্তি, এ কেমন অস্তিত্বহীনতা , যা দেশের দেশের সকল মানুষকে নিষ্প্রান ,হীনবীর্য করে ফেলেছে।

দেশটাতো এমন ছিল না । আমাদের পূর্বপুরুষরাইতো , আমাদের স্বাতন্ত্র্য , আমাদের অস্মিতা, আমাদের অহংবোধ , আমাদের আত্মগৌরব, আমাদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য , আগ্রাসী বৃটিশ , শোষক জমিদার মহাজন ও কুচক্রী সাম্প্রদায়িক হিন্দু রাজনীতিবিদদের বিরূদ্ধে , সমরে, সংগ্রামে, আন্দোলনে আত্মোৎসর্গ করতে কার্পণ্য করেনি। কখনও নিসার আলি হয়ে , হাজী শরীয়তুল্লাহ হয়ে , মাসুম শাহ , দুদু মিয়া, সৈয়দ আহমদ বেরলভী হয়ে , কাজী মিয়া জান, হাবিলদার রজব আলি , মুন্সী মেহের উল্লাহ হয়ে, জেল জুলুম, ফাঁসী-গুলীতে বুক পেতে দিতে পিছপা হয়নি । আজ কেন তাঁদের ত্যাগ-তিতিক্ষা, আত্মোৎসর্গ, রক্তদান , অকিঞ্চিৎকর, অপ্রোয়জনীয় , মূল্যহীন হয়ে পড়েছে । কেন মনে হচ্ছে আমরা মুসলমানরা তো মাত্র সেদিন জীবন শুরু করেছি । কে এদের শেখাল যে, ওরা একাত্তরের প্রজন্ম ?

গোটা জাতি যেন আবেগমন্ডিত হয়ে, নেশাগ্রস্তের মত পথ হাঁটছে । সে পথের নিশানা নেই , ইতিহাস নেই , যুক্তির আলো পর্যন্ত যেপথে ঢুকতে পারছেনা। সিজোফ্রেনিয়া রোগীর মত জাতি সেই পথে হাঁটছে ।

নিকট কে জানতে হলে, দূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে হয় । জাতি হিসাবে পরিচয় দিতে হলে, ঐতিহ্যের আয়নায় নিজের মুখ দেখতে হয় । সে আয়না আজ ধুলিমলিন, যার ফলে দূরের অতীত তমসাবৃত, চক্ষু জ্যোতিহীন, আত্মদর্শন সম্ভব হচ্ছেনা ।
ভাবতে অবাক লাগে যে, এ জাতি কেমন করে ভুলে গেল মাত্রকিছুদিন আগের বেদনাময় অতীত । গত শতাব্দীর প্রথম দিকেও তো পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগুরু মুসলমানদের মেষ, ছাগল , হালের বলদের মত উৎপাদক শ্রেণীর জীব বলে গন্য করা হত। তাদের দানাপানির দরকার আছে , শিক্ষাদীক্ষার দরকার আছে, মানুষ হিসাবে বাঁচার অধিকার আছে—সেটুকুও স্বীকার করা হতনা । কলকাতায় বসবাসকারী জমিদার বাবুদের বল্গাহীন শোষণে এদেশের চাষাভূষা, ক্ষেতমজুর , মুসলানদের জীবন অতীষ্ঠ ছিল ।

কলকাতায় আরামে বসবাসকারি ময়মনসিংহের জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য্য, গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী , কাশিম বাজারের মহারাজ মনীন্দ্র নন্দী , জোড়াসাঁকোর জমিদার মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীঘাপাতিয়ার রাজা , নাটোরের রাজা , ফরিদপুরের সিকদার ও ঘোষ পরিবারের মত আরও অনেক বাবু জমিদারদের নিষ্ঠুর অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য এদেশের পদদলিত পাঁচু শেক , গেঁদু মুনশী, কালু মোড়ল , হাবু প্রমানিক প্রমূখ মুসলিম সন্তানরা মানুষ হিসাবে বাঁচার মত একটা জমিন সৃষ্টির আশা নিয়েই, মুজাহিদ হয়ে জেহাদ মনে করেই আত্মোৎসর্গ করেছে।

গরু কোরবানী করলে এদেশের মুসলমানদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হত, দাঁড়ি রাখলে খাজনা দিতে হত, আরবী ফারসী নাম রাখা নিষিদ্ধ ছিল , দূর্গাপূজা, কালীপূজায় কর দেয়া মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল ।এদেশের মুসলমানদের অস্তিত্বই স্বীকার করা হতনা ।

১৯০৫ সালের ঘটনাই ধরা যাক । বৃটিশ আমলে প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য ২লাখ ৪৬ হাজার ৭৮৬ বর্গমাইল বেষ্টিত বিশাল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীকে ভাইসরয় লর্ড কার্জন দুই প্রদেশে ভাগ করতে চাইলেন । এই বিভাজনের ফলে পূর্ব বাংলার অবহেলিত মুসলমানরা উপকৃত হবে শুধুমাত্র এই আশঙ্কায় তেলেসমাতি কাণ্ড শুরু করে দেয়া হল । মুসলমানরা শিক্ষিত হবে, চাকরি-বাকরি পাবে, উকিল-মোক্তার হবে, সংসদ সদস্য হয়ে বাবু জমিদারদের সাথে এক আসনে বসবে এটাকি মেনে নেয়া যায় ! শুধু মাত্র পূর্ববাংলার মুসলমানদের উন্নতি ব্যাহত করার জন্য বঙ্গভঙ্গ রহিত আন্দোলন শুরু হয়ে গেল । কেবল হিন্দু বাবুরাই নয়, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী নামে পরিচিতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও মিছিল নিয়ে পথে নামলেন , যা আগে কোনদিন দেখা যায়নি ।
শুধু কি অহিংস আন্দোলন ? বিপিন পাল , অশ্বিনী দত্ত , অরবিন্দ ঘোষ, সূর্যসেন, বাঘা যতিন, প্রীতিলতা প্রমূখের সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা এবং তিলক, বঙ্কিমচন্দ্রের সাম্প্রদায়িক প্ররোচনায় দেশজুড়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু করে দেয়া হল । যার ফলে বৃটিশ রাজশক্তি মুসলমানদের আশাভঙ্গ করে বঙ্গভঙ্গ রোধ করতে বাধ্য হল। আজ বাংলাদেশে সেই সূর্য সেন , প্রীতিলতাদের আরাধনাই চলছে । নিসার আলি শরীয়তুল্লাহরা অপাঙক্তেয় হয়ে গেছে।
এ দেশে কোন বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না । ১৯১২ সালে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকায় আসার পর নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ পূর্ববাংলার মানুষের শিক্ষার জন্য একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবী জানালেন । সঙ্গে সঙ্গে বাঙালী এলিট বাবুরা প্রতিবাদ জানালেন । শ্রীশচন্দ্র ব্যানার্জি , রাসবিহারী ঘোষ , কলকাতা ইউভার্সিটির ভিসি স্যার আশুতোষ মুখার্জির মত বিজ্ঞজনেরা ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ এর কাছে ১৮বার স্মারকলিপি দিয়ে চাপ সৃষ্টি করলেন । ১৯১২ সালের ১৮মার্চ কলকাতা গড়ের মাঠে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে যে জনসভা হয়েছিল তাতে সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করেছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । সেই রবীন্দ্রনাথ আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথার মুকুটে । আর যে নওয়াব সলিমুল্লাহ নিজে নি:স্ব হয়ে জমিদারির বিরাট অংশ বিশ্ববিদ্যালয় কে দান করলেন , যে সৈয়দ নবাব আলি চৌধুরি নিজের জমিদারি বন্ধক রেখে সে যুগে (১৯২১) ৩৫ হাজার টাকা বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে দান করলেন, তাদের কথা হয়ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র -শিক্ষকদেরও জানা নেই।
এদেশের মানুষ এটাও ভুলে গেছে যে, ১৯৪৭ সালের আগে হাড়জিরজিরে মুসলমান অধ্যুষিত এই পূর্ব বাংলায় দেশরক্ষার জন্য সেনাবাহিনী গঠন করার মত লোক ছিলনা। ’৪৭ সালে বৃটিশ আর্মিতে ৪/৫ জন কিংস কমিশন প্রাপ্ত বাঙালী অফিসার , ৫০/৬০ জন জেওসি, শ’দুয়েক বাঙালী সিপাহী নিয়ে ১৯৪৭ সালে দেশটা স্বাধীন হয়েছিল । সেখান থেকে আজ পৃথিবীর মর্যাদাসম্পন্ন আর্টলারি, চৌকস বিমানবাহিনী, নৌ বাহিনী বিদ্যমান। এ কোন তন্ত্রমন্ত্রে বা ‘বন্ধুর’ হাত-পা ধরে গড়ে ওঠেনি!
‘৪৭ এর স্বাধীনতার সময় এদের প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোমার মত , প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পাশ করা কোন বাঙালী আইসিএস অফিসার ছিলনা। মাত্র দু’জন নমিনেটেড আইসিএস ছিলেন যাদের একজন পূর্ববঙ্গের ছিলেন, অপরজন পশ্চিমবঙ্গে থেকে যান । আজ যে বাঙালী মুসলমান ছেলেরা উপজেলা, জেলা থেকে শুরু করে দেশের প্রশাসন চালাচ্ছেন তারা কোন বন্ধু দেশের সাহায্যে গড়ে ওঠেনি ।
দেশে ৮টি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল, একটি বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৩টি ইন্জিনিয়ারিং কলেজ, ৮টি মেডিক্যাল কলেজ, ১টি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ ২টি কৃষি কলেজ, নৌবন্দর , ৭৮টি পাটকল, ৬৩ টি কাপড়ের কল, এছাড়াও অল্প সময়ে স্বতন্ত্র দেশের উপযোগী নানান প্রতিষ্ঠান গড়া সম্ভব হয়েছিল । এ সব কিছুই ছিল ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার অবদান, আমাদের পূর্বপুরুষদের ১৯০ বছরের নিরলস সংগ্রামের ফসল । স্বাধীন মুসলিম জাতিসত্তা আর নিখাদ দেশপ্রেমের ফসল । আজ সংগ্রামও নেই, জাতিসত্তা ও নেই, দেশপ্রেম ও নেই ।
মড়ক লাগলে যেমন গ্রাম বিরান হয়ে যায় , ভূমিকম্পে যেমন দেশ শ্মশান হয়ে যায়, তেমনি এক বৈরী হাওয়া এসে আমাদের সাজানো দেশটাকে তছনছ করে দিয়েছে। মিল কারখানা উজাড় , কলেজ ইউনিভার্সিটি গুলোতে শিক্ষার পরিবেশ নেই, কৃষি উৎপাদন বিপন্ন , চাষীরা উৎপন্ন ফসলের দাম পায়না বলে রাস্তায় উৎপন্ন ফসল ফেলে দিয়ে প্রতিবাদ জানায় । সকল ভোগ্যপন্যের জন্য সিন্ডিকেট করে পরনির্ভরশীলতা বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে । দেশময় চলছে লুটপাট, ডাকাতি আর অর্থ পাচার । দেশ নিয়ে কেউ ভাবছেনা , যার যার আখের গোছাতে ব্যস্ত! দেশে অঘোষিত রাজতন্ত্র চলছে। রাজা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে , প্রজাসাধারণ দাসের মত পদসেবায় রত ।পুরানো শত্রু বন্ধুর বেশে মাথায় বসেছ।
উদার দৃষ্টি দিয়ে যদি বিবেচনা করা যায় তাহলে স্পষ্ট দেখা যাবে যে ১৯ শতকের প্রথম দশকে দাসের মত জীবনযাপন করা একটি জাতি , শত্রু চিনে , লড়াই করে স্বাধীন দেশের মালিক হয়েছিল। এবং অতি দ্রুত অর্থ বিত্তে ,শক্তি সামর্থে, মানসম্মানে পৃথিবীর সকল দেশের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল । আজ কার ইশারায় তারা আবার সেই পুরানো প্রভুর গোলামীর জিঞ্জির গলায় পরে দাস জীবনে ফিরে গেছে । একি আত্মভ্রম নাকি আত্মহনন, কে বলে দেবে ?