শিরোনাম :

  • শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪

চলুক ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’

চলমান করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক উপায় হিসেবে সামাজিক বা শারীরিক দূরত্বকে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে শারীরিক দূরত্বকে নিশ্চিত করার জন্য ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-কে বেছে নেওয়া হয়েছে। এই উপায়টির মূল কথা হচ্ছে, কর্মস্থানে না গিয়ে বাড়িতে অবস্থান করে নির্ধারিত কাজ করে তা ইলেক্ট্রনিক উপায়ে অফিসকে বুঝিয়ে দেওয়া। আগে কাজ হতো অফিসে বসে। আর, এখন কাজ হবে বা হচ্ছে বাড়িতে। ফলে, অনেকের কাছে ‘অফিস’ ও ‘বাড়ি’-এর মধ্যকার পার্থক্য দৃশ্যমান হচ্ছে। কেউ কেউ হয়তবা বাড়িতে কাজ করাকে চ্যালেঞ্জ মনে করছে। বাড়িতে অফিসের পরিবেশ তৈরিতে হিমশিম খাচ্ছে। হয়তোবা, বহু মানুষ এই ব্যবস্থার সাথে তাল মিলাতে না পেরে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। বস্তুত, ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বা ‘বাড়িতে বসে কাজ’ করা নতুন কোনো বিষয় নয়। কর্পোরেট বা ব্যাংকিং সেক্টরে এটি সাম্প্রতিক ঘটনা হলেও অর্থনৈতিক বহু ক্ষেত্রে এই ধারণাটি খুবই পুরনো। এ সম্পর্কে কিছু উদাহরণ তুলে ধরছি।

কৃষকেরা বাড়িতে অবস্থান করেই কাজ করে। বাড়ির সাথে তাঁদের কৃষি জমির দূরত্ব পায়ে হাঁটা পথের। বাড়িতেই শস্য দানা থেকে তাঁরা বীজ তৈরি করে। বাজার থেকে সার ও কীটনাশক ঔষুধ কিনে বাড়িতেই রাখে। প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি, যেমন লাঙ্গল বা ট্রাক্টর, কোদাল, নিড়ানি, ইত্যাদি  বাড়িতেই থাকে। কৃষি উপকরণগুলি বাড়ি হতে কৃষি জমিতে নিয়ে যায় আবার বাড়িতে ফেরত নিয়ে আসে। ফসলি জমির আগাছা কেটে বাড়িতে নিয়ে এসে গৃহপালিত গরু ও ছাগলকে খেতে দেয়। ফসল তুলে তা বাড়িতে নিয়ে আসে। ফসল মাড়াইয়ের কাজ জমিতে বা বাড়ির উঠানে করা হয়। শস্য বাড়ির উঠানে শুকানো হয়। বাড়িতেই তা সংরক্ষিত করে বাজারে বিক্রয়ের জন্য প্রস্তুত করা হয়। যুগের পর যুগ ধরেই কৃষকেরা বাড়িতে কাজ করে আসছে। তাঁদের বাড়ি ও কর্মস্থানের মধ্যকার পার্থক্য তৈরি করার প্রয়োজন পড়ে না। অবশ্য, শিল্পায়িত কৃষিকাজের ক্ষেত্রে ভিন্ন কথা।
শিক্ষকতা পেশায় বাড়িতে অবস্থান করে পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা, ক্লাশে পাঠদানের বিষয়ের উপর প্রস্তুতি নেওয়া এবং প্রাইভেটে ব্যাচ পড়ানো খুবই পুরনো বিষয়। বহু শিক্ষকের গৃহে পৃথক পড়ার ঘর আছে, যেটি তাঁদের কাজ করার জায়গা। বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের গবেষণা কাজে নিয়োজিত রাখতে হয়। তাঁদের গবেষণা সংশ্লিষ্ট চিন্তা-ভাবনাগুলিকে তত্ত্বাবধান করতে হয়। গবেষণার থিসিস বা সিদ্ধান্তকে সংগঠিত করতে প্রয়োজন পড়ে শিক্ষক-শিক্ষার্র্থীদের মধ্যে দীর্ঘ সময়ের আলোচনা, যুক্তিতর্ক ও বোঝাপড়া। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি নির্দিষ্ট অফিস ঘণ্টার মধ্যে সীমিত রাখা সম্ভব হয় না। তাই শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের বাড়িতে এসে তাঁদের গবেষণা সম্পর্কে পরামর্শ নেয়। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য শিক্ষা-সংস্কৃতি।

বহু চিকিৎসক হাসপাতাল থেকে ফিরে সন্ধ্যার পর স্বগৃহে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকে। বহু চিকিৎসক আছে যাদের বাড়িতে একটি নিজস্ব চেম্বার আছে, যেখানে স্থানীয় রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসে। আবার বাড়ির পাশেই ঔষুধের দোকানে রোগী দেখে। আমার এক বন্ধুর বাবা আছেন, যিনি উপজেলা পর্যায়ের একটি হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ছিলেন। হাসাপাতালের সাথেই লাগোয়া সরকারি আবাসনে তিনি থাকতেন। তাঁকে দেখেছি যে, তিনি বাড়িতেই গরীবদেরকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিতেন। এছাড়াও, যারা মানবাতাবাদী চিকিৎসক তাঁদের কাছে বাড়ি ও অফিস-এর পার্থক্য নেই। যেমন, চিকিৎসক এডরিক বেকারের কথা বাংলাদেশের অনেকেই জানেন। তাঁর বাড়ি ছিল নিউজিল্যান্ডে। দরিদ্রদেরকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার স্বপ্ন পূরণে তিনি বাংলাদেশে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুরে স্বাস্থ্য কেন্দ্র চালু করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ড. বেকার গরবীদের বিনামূল্যে ও নামমাত্র মূল্যে চিকিৎসা দিয়েছেন। তাঁর কাছে গৃহ ও কাজের জায়াগার মধ্যে সুনির্দিষ্ট ফারাক ছিল না।

গ্রামীণ সমাজে বহু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আছে যাদের দোকান ও বাড়ি একই ছাদের নিচে। দোকানের মাল (চাল, আলু, রসুন, তেল) গৃহে থাকে। দোকান ঘরে স্বল্প পরিমাণে রেখে সেগুলি খুচরা বিক্রয় করে। আবার বহু শিক্ষিত যুবক আছে, যাঁরা চাকরি না করে বাড়িতেই মুরগি, গরু, ছাগল বা মাছের খামার করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্থানীয়রা মুরগি ও ডিম বাজারে না গিয়ে প্রতিবেশী খামারি বাড়িতেই গিয়ে কিনতে পারে। ফলে, খামারি পেশার লোকদের কাছেও বাড়ি ও কাজের জায়গা একই।

গৃহকর্ত্রীরা গৃহস্থালীর কাজ গৃহের ভিতরেই করে। বলা বাহুল্য, তাঁদের কাজগুলিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বা আর্থিকভাবে মূল্যায়িত করা হয় না। গৃহস্থালী কাজের আর্থিক মূল্য না থাকলেও তাঁদের কাজগুলি অমূল্য এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের জীবনে এর ইতিবাচক প্রভাব ব্যাপক। করোনা পরিস্থিতি বা অন্য যেকোনো দুর্যোগই আসুক না কেন তাঁদের কাজ একই থাকে এবং একই স্থানে অর্থাৎ বাড়িতে সম্পন্ন করতে হয়। ফলে, গৃহকর্ত্রীদের জন্য বাড়িতে বসে কাজ নতুন কোনো বিষয় নয়। এছাড়াও, বহু নারী আছে যারা গৃহকর্ত্রী আবার বাড়ির ভিতরেই কাপড় সেলাই বা বিউটি পার্লার পরিচালনা করে।

গাড়ির চালক, সুপারভাইজার ও হেল্পারদের কাছে অনেক সময় গাড়িই বাড়ি হয়ে দাঁড়ায়। যারা আন্তঃজেলায় যাতায়াত করেন তারা লক্ষ করেছেন যে, যে চালক, সুপারভাইজার ও হেল্পারদেরকে রাতের ভ্রমণে জেগে থাকতে হয় এবং সকালে তাঁরা, বিশেষ করে হেল্পার, গাড়ির ভিতরেই ঘুমায়, কাউন্টারের টয়লেট ব্যবহার করে, বাইরের হোটেলে খায়। তাঁদের কাজ স্বগৃহের বাইরের করতে হয় বিধায় গাড়িই তাঁদের চলমান বাড়ি। এছাড়া, আবাসিক এলাকার বহুতল বিশিষ্ট ভবনগুলিতে নিরাপত্তাকর্মীরা কাজ করে। যাদের অনেকেই ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোরে একটি ঘরে থাকে। কোনো কোনো ভবনের নিচে তাঁদের ব্যবহারের জন্য টয়লেট ও রান্নাঘর আছে। ফলে, ভবনের নিচেই তাঁর বসবাস ও কাজ করার জায়গা।

নিঃসন্দেহে, অফিসের পরিবেশে যারা এতদিন কাজ করে অভ্যস্থ তারা বাড়িতে কাজ করাকে সমস্যাজনক ও অস্বাভাবিক মনে করছে। কিন্তু উপরের উদাহরণগুলিতে দেখায় যে ওয়ার্ক ফ্রম হোম আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষের কাছে খুবই স্বাভাবিক। এটি যাদের কাছে চ্যালেঞ্জ বা সমস্যাজনক হিসেবে দাঁড়িয়েছে তারা উপরের উদাহরণগুলিকে বিবেচনায় আনতে পারে। এতে করে ঘরে বসে অনলাইনে কাজ করার প্রতি আগ্রহ বাড়বে।