কোনো বিবেচনাতেই শিল্পখাতে আগাম কর যৌক্তিক নয়

বৈশ্বিক দুর্যোগ করোনাভাইরাসজনিত চলমান সংকটের প্রভাব দেশের অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত। বাদ নেই শিল্প খাতও। করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখিতাজনিত স্থবিরতায় এ খাতের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন ও ব্যবসা কয়েক মাস ধরে প্রায় বন্ধই বলা চলে। ফলে এরই মধ্যে আর্থিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এ অবস্থায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রতিষ্ঠানেরই টিকে থাকা মুশকিল।

করোনা মহামারীর প্রকোপ কত দিনে শেষ হবে, তা অজানা। সেই বিবেচনায় সামনে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য যে আরো অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ প্রতীক্ষা করছে, সেটি আঁচ করা কঠিন নয়। সার্বিক এই সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতিতে সংগত কারণে কাঁচামাল ও উপকরণ আমদানিতে আগাম কর (এটি) সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের দাবি ছিল শিল্প উদ্যোক্তাদের। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, প্রস্তাবিত বাজেটে দাবিটি অনেকটাই উপেক্ষিত হয়েছে। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের ঘোষিত বাজেটে আগাম কর ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ এবং এটি দুই কর মেয়াদের পরিবর্তে চার কর মেয়াদে সমন্বয় করার সুযোগ দেয়া হয়েছে মাত্র। আর বিশেষ কোনো কিছু করা হয়নি। এতে আপাতভাবে করভার কিছুটা লাঘব হলেও তা করোনা বিপর্যয়কালীন আর্থিক চাপ কমাতে খুব একটি সহায়ক হবে না বলে ভাষ্য শিল্প মহলের। কাজেই অর্থনীতিতে গতিময়তা সৃষ্টি ও শিল্প খাতে প্রাণসঞ্চারের স্বার্থে বিষয়টি সরকারের পুনর্বিবেচনা করা জরুরি।

বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের অন্যতম বড় উৎস হলো শিল্প খাত। এ খাতে বিপুলসংখ্যক কর্মী নিয়োজিত। কিন্তু কভিডসৃষ্ট চলমান বৈশ্বিক আর্থিক মন্দায় আন্তর্জাতিক বাজারমুখী বাংলাদেশী পণ্যের চাহিদায় ভাটা পড়েছে। আবার মানুষের আয়-রোজগার সংকুচিত হওয়ায় অভ্যন্তরীণ বাজারেও শিল্পপণ্যের বিক্রয় সন্তোষজনক নয়। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় কমে এসেছে। এতে একদিকে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীদের মজুরি প্রদানে যেমন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি প্রতিষ্ঠানগুলোয় নগদ অর্থের সংকট তৈরি হয়েছে। নগদ অর্থের জোগান বাড়াতে প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকের প্রতি বেশি ঝুঁকছে। তদুপরি আগে থেকে নেয়া বিরাট অংকের ব্যাংকঋণের বোঝাও তাদের ঘাড়ে রয়েছে। এ অবস্থায় আগাম কর তাদের জন্য বাড়তি খড়্গ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এটা তাদের আর্থিক চাপ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে বৈকি।

এখন অর্থসংকটে যদি কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে বেকারত্ব তো বাড়বেই; উপরন্তু ব্যাংকের খেলাপি ঋণের আরো অবনমন ঘটছে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। সুতরাং সংকটের সময়ে সরকারের আপাতত প্রতিষ্ঠানগুলো টিকিয়ে রাখার নীতি নেয়াই সমীচীন। নইলে অর্থনীতিতে বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব এড়ানো কঠিন হবে।

সরকার একদিকে প্রণোদনা দিয়ে শিল্প খাত বাঁচিয়ে রাখার কথা বলছে, অন্যদিকে শিল্পবিরোধী পদক্ষেপ নিচ্ছে। আগাম কর, যার একটি নমুনা মাত্র। কর বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের কোথাও শিল্প কাঁচামাল আমদানির ওপর আগাম কর নেই। অথচ বাংলাদেশে সেটি প্রবর্তন করা হয়েছে। এটি ব্যবসা-বাণিজ্যের পথে বড় ধরনের প্রতিবন্ধক। এদিক থেকে এটি একেবারেই প্রত্যাহার হওয়া জরুরি। তেমনটি না হলেও অন্তত আগামী অর্থবছরের জন্য তা প্রত্যাহার করা যেতে পারে কিংবা করহার ১-২ শতাংশের মধ্যে রাখা যেতে পারে।

এদিকে আমদানি পর্যায়ে পরিশোধ করা আগাম কর (এটি) ঠিকমতো ফেরত পাচ্ছেন না শিল্প মালিকরা। ভ্যাট আইনে ছয় মাসের মধ্যে রিফান্ড দেয়ার বিধান থাকলেও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবতা ভিন্ন। নির্ধারিত সময় পার হলেও এখনো পরিশোধিত আগাম কর ফেরত পাননি অনেক উদ্যোক্তা। কারণ ভ্যাট কমিশনারেটগুলো সরকারি চেকবই পায়নি। এতে বিপুল অংকের টাকা সরকারের কাছে আটকে থাকার কারণে উদ্যোক্তাদের একদিকে ব্যাংকঋণের সুদ বাড়ছে, অন্যদিকে তীব্রতর হচ্ছে মূলধন সংকট, বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়ও।

সরকার বরাবরই দেশে একটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি, ব্যবসা সহজ করার কথা বলছে অথচ শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে আগাম কর ব্যবসা-বাণিজ্য নিরুৎসাহিত করছে, পদ্ধতিগত জটিলতায় শিল্পোদ্যোক্তারা পড়ছেন ভোগান্তিতে। শিল্প খাতে নতুন বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণে এটি বাধা সৃষ্টি করছে। সেদিক থেকে একার্থে এটি ব্যবসা সহজ করার বিদ্যমান সরকারি নীতিরও পরিপন্থী।

সবচেয়ে বড় কথা, যদি ফেরতই দেয়া হবে, তাহলে সেটি আগাম নেয়ার কেন প্রয়োজন? মাঝখানে হয়রানির শিকার হচ্ছেন উদ্যোক্তারা। কর সমন্বয়ে সৃষ্টি হচ্ছে কারিগরি সমস্যা, বাড়ছে জটিলতা। বলতে গেলে ব্যবসা সহজীকরণ, সরকারের আর্থিক লাভ এবং শিল্প খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানো, কোনো বিবেচনাতেই আগাম কর যৌক্তিক নয়। তার ওপর এই অনিশ্চিত সময়ে এটি উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের জন্য বাড়তি আর্থিক ভার হিসেবে হাজির হয়েছে। তাই যথাসম্ভব দ্রুত এটি প্রত্যাহারই এখন সময়ের দাবি।

Print Friendly, PDF & Email