শিরোনাম :

  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪

অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবিনারে তথ্য

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জেলে ৪ হাজার মানুষ

নিউজ ডেস্ক :

মিডিয়া এবং সাংবাদিকদের কণ্ঠ রোধ এবং তাদেরকে ভীতি প্রদর্শনের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সোমবার (২৬ জুলাই) সংগঠনটির মহাসচিব অ্যাগনেস কাল্লামার্ড এক ওয়েবিনারে বলেছেন, এই আইন সাংবাদিকদের সমালোচনামূলক রিপোর্ট এবং প্রবন্ধ লেখা থেকে বিরত রাখছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী, ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, দুর্নীতিপরায়ণ, সমস্যাবহুল নীতিকে লালন ও দায়মুক্তি দেয়ার কারণে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নষ্ট হচ্ছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ সরকারের কাছে এই আইনটি বাতিল বা সংশোধন করতে জোর দাবি জানাচ্ছে। তিন বছর আগেও বাংলাদেশ স্বেচ্ছায় ইলেকট্রনিক এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে সর্ব পর্যায়ে গঠনমূলক করতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে উল্লেখ করে অ্যাগনেস বলেন, ২০১৮ সালে গৃহীত বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি বাতিল বা প্রয়োজনীয় সংশোধন দাবি করি। আইনটির কিছু ধারা অস্পষ্ট। এতে বৈধভাবে মত প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। বাংলাদেশের গতিশীল নাগরিক সমাজের মত প্রকাশকে দমিয়ে রাখতে বা সঙ্কুচিত করতে এই আইনটি হলো গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র।

মত প্রকাশের বিষয়টি বাংলাদেশের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। অর্থনীতি থেকে চিন্তা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, মানবাধিকার সংগঠন, সাহিত্য- এসব ক্ষেত্র সৃষ্টি করে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার। মানবাধিকার বিষয়ক নেতৃত্ব সৃষ্টি করে। ‘কাটিংএজ’ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সৃষ্টি করে। আরও অনেক কিছু করে। সেই জায়গাটি রক্ষায় আমরা সমবেত হয়েছি।

তিনি আরও বলেন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল হতাশার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে ব্যক্তিবিশেষকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করতে ব্যবহার করা হচ্ছে এই আইন। এসব নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। মিথ্যা এবং আক্রমণাত্মক স্বীকারোক্তি আদায় করতে গিয়ে জোরপূর্বক গুম করা হচ্ছে। নির্যাতন ও অন্যান্য অশোভন আচরণ করা হচ্ছে। এমনকি নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োজনীয় সব আদর্শ মানতেও ব্যর্থ হয়েছে। এতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য প্রতিকার পাওয়ার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।

২০১৮ সালে এই আইন করার পর এর আওতায় পড়েছেন কমপক্ষে ২০০০ মানুষ। এ মাস পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জেলে রয়েছেন ৪০৩৩ জন মানুষ। মিথ্যা ও অপরাধমূলক তথ্য প্রকাশের জন্য তাদের অনেককে জেলে রাখা হয়েছে। অ্যাগনেস বলেন, অভিযোগ সত্য হলেও এমন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য এই আইনটির মানোত্তীর্ণ হতে পারে না। এর অধীনে লেখক মোশতাক আহমেদের মতো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল। তিনি বিচার ছাড়াই জেলে মারা গেছেন। এই আইনটি বাংলাদেশে ভিন্নমতাবলম্বীদের কণ্ঠরোধ করতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে লেখক, সাংবাদিক, ফটোসাংবাদিক, কার্টুনিস্ট, সংগীতজ্ঞ, রাজনীতিক, অধিকারকর্মী, শিক্ষার্থী, ব্লগার। এমনকি কৃষকও আছেন- যারা পড়তে বা লিখতে পারেন না। তারা যাতে লিখতে বা পড়তে না পারেন সে ব্যবস্থা করা হয়েছে।

‘বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা- ভিন্নমতের স্থান নেই’- শীর্ষক ওয়েবিনারটি সঞ্চালনা করেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাউথ এশিয়া ক্যাম্পেইনার সাদ হাম্মাদি। এতে আরও অংশ নেন- জাতিসংঘের মত প্রকাশের স্বাধীনতা-বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি আইরিন খান, সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও অ্যামনেস্টির এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক ইয়ামিনি মিশ্রা।

ওয়েবিনারে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবীর কিশোরের রেকর্ডেড বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। কিশোর বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনিই প্রথম কার্টুনিস্ট যাকে রাজনৈতিক কার্টুন আঁকার কারণে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। ফলে তার চোখ ও কান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং গুরুতর সার্জারি করতে হয়েছে।

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, বাংলাদেশে যারা অবস্থান করছেন তাদের মত প্রকাশের কোনো স্বাধীনতাই নেই। এখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ কোনো মাধ্যমেই ভিন্নমত প্রকাশ করা যায় না। বিদেশে গিয়ে হয়তো বাংলাদেশিরা ভিন্ন মত প্রকাশ করতে পারেন। শুধু তাই নয়, দেশে গত কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের কোনো স্বাধীনতা নেই। রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য এখানে পুলিশের অনুমতির প্রয়োজন হয়। কিশোরের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিশোরের ওপর ডিএসএ প্রয়োগের চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে তাকে গ্রেপ্তার দেখানোর আগে একটি বাহিনী গুম করে রেখেছিল। ডিএসএ ব্যবহারের আগেই তার ওপর অবিচার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের যে নির্দেশনা আছে তা অনুসরণ করা হয়নি। বাংলাদেশে মানবাধিকারের ধারণাটি শুধু কাগজে-কলমে উপস্থিত, বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব নেই।

আইরিন খান বলেন, ডিএসএ একটি কলোনিয়াল আইন। শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর অনেক অনুন্নত দেশে এ ধরনের আইন রয়েছে। এ আইনের কারণে মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে যে আন্তর্জাতিক আইনগুলো রয়েছে তা এই আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশ সরকারের উচিত অবিলম্বে এই আইন বাতিল করা। সহিংসতা ও মানহানি প্রতিরোধে সরকার ডিএসএ’র প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, সরকার যে ধরনের সহিংসতার কথা তুলে ধরছে তা খুব গুরুতর নয়। মানহানির বিচারের জন্য দেশে পৃথক আইন রয়েছে। সরকার যাদের হুমকি মনে করে তারা আদৌ হুমকির কারণ নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নীরিহ মানুষ এই আইনের শিকার হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে সরকার যেভাবে দেশ পরিচালনা করতে চায় সেভাবে দেশ চালাতে আইন সহায়তা করছে।

এর আগে সোমবার ভোরে এক ব্রিফিংয়ে অ্যামনেস্টি বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এর অপপ্রয়োগসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে।