• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

অনিয়ম-জালিয়াতির নজিরবিহীন চিত্র ২৩৪ পৌরসভায়

1নিউজ ডেস্কঃ ভোটকেন্দ্র দখল, অবৈধভাবে ব্যালট পেপারে সিল মারা, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, হামলা, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে সারা দেশে শেষ হয়েছে দলীয় প্রতীকে পৌরসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। এখন চলছে ভোট গণনার কাজ।

ভোটে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ এনে এরই মধ্যে ১৯ জেলায় ৩৩ জন মেয়র পদপ্রার্থী  নির্বাচন থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন।
দেশের ৩২৩টি পৌরসভার মধ্যে ভোট হয়েছে ২৩৪টি পৌরসভায়। ২৩৪টি মেয়র পদ ছাড়াও দুই হাজার ১৯৩টি সাধারণ কাউন্সিলর ও ৭৩১টি সংরক্ষিত পদে প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।

এর মধ্যে সংঘর্ষ, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, কেন্দ্র দখলসহ বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার কারণে ১২টি জেলার ৩১টি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করেছেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারা।

বিভিন্ন জেলা থেকে পাঠানো খবর :
নীলফামারী : নীলফামারীর সৈয়দপুর পৌরসভায় চারটি ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট বক্স ছিনতাইয়ের সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মেয়র পদপ্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

পুলিশ জানায়, দুপুর দেড়টার দিকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর সমর্থকরা কেন্দ্র দখলের চেষ্টা করে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ৪৫টি ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এ সময় দুজন গুলিবিদ্ধ হন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ ঘটনায় ফ্রি অমিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আমিনুল হক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কয়াগোলাহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মুসলিম হাইস্কুল কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানান জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা।

জয়পুরহাট : ভোটগ্রহণ চলাকালে জয়পুরহাটের সরকারি কলেজ, সরকারি মহিলা কলেজ ও তালিমুল ইসলাম একাডেমি কেন্দ্রে কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।

এ ঘটনায় চারটি কেন্দ্রে সাময়িকভাবে ভোটগ্রহণ বন্ধ রাখা হলেও ঘণ্টাখানেক পর পুনরায় কেন্দ্রগুলোতে ভোটগ্রহণ শুরু হয় বলে জানান জয়পুরহাট সরকারি মহিলা কলেজ কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মাকসুদুল করিম।

এ ছাড়া জয়পুরহাট পৌরসভার কাশিয়াবাড়ী কেন্দ্রে দুই কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আজ বুধবার দুপুর ২টা থেকে আড়াইটার মধ্যে এ ঘটনা ঘটে।

কুমিল্লা : কুমিল্লায় সকাল সাড়ে ৮টায় কুমিল্লার চান্দিনার বেলাশ্বর ভোটকেন্দ্রে তিন কাউন্সিলর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে সাতজন আহত হয়েছে। এ সময় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৫টি ফাঁকা গুলি ছোড়ে। সংঘর্ষে আহত বিল্লাল শেখকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ সংঘর্ষের ঘটনায় ভোটগ্রহণ বন্ধ হয়নি।

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের পাচরা প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থীর কর্মীরা কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রতিপক্ষের এজেন্টদের বের করে দেওয়ার চেষ্টা করে। পরে আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ ও স্বতন্ত্র মেয়র পদপ্রার্থীর সমর্থকরা বাইরে উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা চালায়।
এদিকে লাকসাম পৌরসভার লাকসাম রেলওয়ে হাইস্কুল ও দামোইচা কেন্দ্র এলাকা থেকে দেশীয় অস্ত্রসহ আটজনকে আটক করেছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। এর মধ্যে লাকসামের উত্তরদা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম রাব্বানীও রয়েছেন। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

এর আগে সকালে ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের অভিযোগে বরুড়ার শিলমুড়ী ইউনিয়নের লতিফপুর ভোটকেন্দ্র স্থগিত করা হয়। রাত ৪টার দিকে এ কেন্দ্রের এক হাজার ২০০ ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে সিল মারার অভিযোগ করেন কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা হারুনুর রশিদ।

সাভার : ধামরাই পৌর নির্বাচনে মহিলা ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা সিল মেরেছেন বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি দলীয় মেয়র পদপ্রার্থীর এজেন্ট ও নারী ভোটাররা।
সকাল ১০টা পর্যন্ত ধামরাইয়ে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে রেকর্ড সংখ্যক ভোটার ভোট দেন। তারপরই অনিয়ম হয় বলে অভিযোগ করেন নারী ভোটাররা। তাঁরা জানান, ভোট দিতে না পেরে তাঁরা বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন।

বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী দেওয়ান নাজিমউদ্দিন মঞ্জুর অভিযোগ করেন, সকাল সোয়া ১০টার দিকে ধামরাই সরকারি ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্র থেকে তাঁর ছেলে শ্যামলকে বের করে দেয় আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী কবির মোল্লার এজেন্টরা। পরে তারা মহিলা ভোটকেন্দ্রে ঢুকে নির্বিচারে ব্যালটে সিল মেরেছে।

ঝিনাইদহ : ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌরসভার দুধসরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে বহিরাগতরা অনুপ্রবেশ করে তিনটি ব্যালট বই ছিনিয়ে নেয়। এ সময় তারা নিজেদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে সিল মারা শুরু করে। পরে ব্যালট বই তিনটি উদ্ধার করা হয় বলে জানান সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তা দেব প্রসাদ পাল।

রিটার্নিং কর্মকর্তা আরো জানান, এ ঘটনায় ১০৪টি ব্যালট পেপার বাতিল করা হয়েছে। আজ সকাল ৯টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় কেন্দ্রে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

এদিকে শৈলকুপার ললিত মোহন ভূইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের বাইরে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে দুজন আহত হয়েছে। সকাল ১১টার দিকে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

ভোটকেন্দ্রের বাইরে কাউন্সিলর প্রার্থী খান সবুর ও নাজিম উদ্দিনের সমর্থকদের মধ্যে ভোটারদের আসা নিয়ে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হয়। এ সময় ইটের আঘাতে মাঠপাড়া গ্রামের বকুল জোয়াদ্দারসহ দুজন আহত হন।

লক্ষ্মীপুর : লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ পৌরসভায় পাঁচটি ভোটকেন্দ্রে দুই কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। রামগঞ্জ স্টেশন মডেল, মধ্য আঙ্গারপাড়া ও কলচমা, বাঁশঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে এসব ঘটনা ঘটে।

এতে কাউন্সিলর পদপ্রার্থী মো. আবুল হোসেন, এনায়েত উল্লাহ, সফিকুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন লিটনসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। এ সময় ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের চেষ্টা ও শতাধিক ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ গিয়ে ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

দুপুরে রায়পুর পৌরসভার মার্চেন্ট একাডেমি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে জালভোট দেওয়ার অভিযোগে আলমগীর হোসেন নামে একজনকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

পুলিশ জানায়, সাড়ে ১১টার দিকে রামগঞ্জ পৌরসভার আউগানখিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে কাউন্সিলর প্রার্থী শাহজাহানের সমর্থকরা কেন্দ্র দখল ও ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের চেষ্টা করলে অপর কাউন্সিলর প্রার্থী আবুল হোসেনের লোকজন বাধা দেয়। এতে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় এক ঘণ্টা ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকে।

মানিকগঞ্জ : মানিকগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে স্বতন্ত্র মেয়র পদপ্রার্থী গাজী কামরুল ইসলাম সেলিম অভিযোগ করেছে, পশ্চিম দাশড়া এলাকার শহীদ তিতুমীর একাডেমি কেন্দ্রে ভোট শুরু করা হয়েছে সকাল সাড়ে ৭টায়। যুবলীগ নেতা আবু বক্কর সিদ্দিক তুষারের নেতৃত্বে ৩০০-৪০০ স্কুলছাত্র তখন স্লিপ নিয়ে নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়েছে।

এই জাল ভোট দেওয়াকে কেন্দ্র করে সেখানে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও অতিরিক্ত পুলিশ এসে পরিস্থিতি শান্ত করেন। শহীদ তিতুমীর একাডেমি কেন্দ্রে নিচতলায় এক হাজার ৬৫৯ ও দ্বিতীয় তলায় এক হাজার ৮৬০ জন পুরুষ ভোটার রয়েছে।

গাজী কামরুল ইসলাম সেলিম সাংবাদিকদের জানান, ভোট শুরুর আধা ঘণ্টা আগেই অপ্রাপ্তবয়সের ওই ছেলেরা স্লিপ হাতে নিয়ে জাল ভোট দিয়েছে। এ খবর শুনে তিনি কেন্দ্রে এসে আতিউর রহমান, আজাহার ইসলাম, সাইফুল ইসলামসহ বেশকিছু জালভোট প্রদানকারীকে চিহ্নিত করলেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

স্বতন্ত্র মেয়র পদপ্রার্থী আরো অভিযোগ করেন, তাঁদের কেন্দ্রের ভেতর ধরে রাখলে তুষারের লোকজন টেনে বের করে নিয়ে যায়। তুষার ও তার লোকজন নিয়ে কেন্দ্রে বাইরে অবস্থান নেয়।

শহীদ তিতুমীর একাডেমি কেন্দ্রের (নিচতলা) প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক জানান, কেন্দ্রের ভেতর কোনো সমস্যা হয়নি। বাইরে কী হয়েছে তা তিনি জানেন না। তবে, নির্দিষ্ট সময়েই ভোটগ্রহণ শুরু করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

এ ব্যাপারে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাহাদাত হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।

মৌলভীবাজার : কেন্দ্র দখল ও ব্যালট ছিনতায়ের মধ্য দিয়ে মৌলভীবাজার পৌরসভায় ভোটগ্রহণ হয়েছে। বেলা পৌনে ১১টার পর থেকে পৌর এলাকার ১৪টি কেন্দ্রের মধ্যে নয়টি কেন্দ্রে ব্যালট ও সিল ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এতে কিছুক্ষণ ভোট বন্ধ থাকার পর পুনরায় শুরু হয়।

কেন্দ্রগুলো হচ্ছে বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাশিনাথ আলাউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়, টাউন কামিল মাদ্রাসা, হাফিজা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, পৌরসভা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, বড়হাট আবু শাহ দাখিল মাদ্রাসা, শাহ মোস্তফা কলেজ, নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পিটিআই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র।

দুপুর ১টায় বাজার সরকারি আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরকার দলীয় মেয়র পদপ্রার্থীর একদল সমর্থক ইট নিক্ষেপ করে অতর্কিত হামলা চালায়। পরে কেন্দ্র দখল করে তারা সিল মেরে বাক্সে ঢোকায়। এর আগে গুলির শব্দ শোনা যায়। পুলিশ জানিয়েছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তারা একটি ফাঁকা গুলি করেছে।

শহরের বাজার স্কুলকেন্দ্রে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় এসএ টিভির প্রতিনিধি পান্না দত্তের কাছ থেকে ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয় সরকারদলীয় লোকজন। এ সময় কালের কণ্ঠের স্টাফ রিপোর্টার আবদুল হামিদ মাহবুব ও ডেইলি ঢাকা টিবিউনের মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি রজত কান্তি গোস্বামী, সময় টেলিভিশনের শাহ অলিদুর রহমানসহ আরো কয়েকজন সাংবাদিককে লাঞ্ছিত করা হয়।

সাংবাদিকদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করায় মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
জেলার অন্য তিনটি পৌরসভায় কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া মোটামুটি শান্তিপূর্ণভারে ভোটগ্রহণ হয়েছে।

শরীয়তপুর : শরীয়তপুর সদর পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সরকারি গোলাম হায়দারখান মহিলা কলেজ কেন্দ্রে নৌকার সমর্থকরা উন্মুক্ত ভোট দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন প্রতিপক্ষের মেয়র পদপ্রার্থীরা।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উন্মুক্ত ভোটদানের তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হেমায়েত হোসেন লাভলুকে মারধর করে তাঁর ক্যামেরা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয় নৌকা মার্কার সমর্থকরা।

একই পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় কাউন্সিলর পদপ্রার্থী মন্টু তালুকদারের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয় উট পাখির সমর্থকরা।

এ ছাড়া জাজিরা পৌরসভার কবিরাজকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় অর্ধশত ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে কিছু সময়ের জন্য ওই কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ রাখা হয়।

সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জ সদর পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি দলীয় মেয়র পদপ্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী এজেন্টকে লাঞ্ছিত ও তাঁকে বহনকারী গাড়ি ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। ভোকেশনাল কেন্দ্রে দুপুর ১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।

ভুক্তভোগী অ্যাডভোকেট মীর রুহুল আমিন বাবু অভিযোগ করেন, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তিনি জানতে পারেন ভোকেশনাল কেন্দ্রে মেয়র পদের ব্যালট দেওয়া হচ্ছে না। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেই কেন্দ্রে গিয়ে দেখতে পান ভোটারদের কাউন্সিলর ও মহিলা কাউন্সিলর পদের ব্যালট দেওয়া হলেও মেয়র পদে কোনো ব্যালট দেওয়া হচ্ছে না।

ঘটনার প্রতিবাদ করলে সেখানে উপস্থিত কয়েকজন সন্ত্রাসী লাঞ্ছিত করে অভিযোগ করে বিএনপিদলীয় মেয়র পদপ্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট বলেন, এ সময় তাঁর ব্যবহৃত গাড়িটি ভাঙচুর করা হয়।

টাঙ্গাইল : ভুয়াপুর পৌরসভায় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীসহ কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়েছেন। বেলা ১১টার দিকে বিদ্রোহী প্রার্থী তারেকুল ইসলাম চঞ্চল বাহাদীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গেলে অপরপক্ষের সমর্থকরা তাঁর ওপর হামলা চালায়।

এতে চঞ্চলসহ উভয় পক্ষের ১০ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে চঞ্চলসহ পাঁচজনকে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

পটুয়াখালী : আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থীর সমর্থকদের ভোটকেন্দ্র দখল ও তাণ্ডবের কারণে কুয়াকাটা পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটকেন্দ্র ফাঞ্জুপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে।

এখানে ব্যালট বাক্স ভাঙচুর ও ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এ সময় দখলকারীদের হামলায় আহত হন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা শাহিন, মনছুর আহাম্মেদ ও পুলিশ কর্মকর্তা হাবিব। এ সময় উভয় পক্ষের কর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ২৫টি ফাঁকা গুলি করে। সংঘর্ষে উভয় দলের ৩০ জন আহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শী জাতীয় পার্টির মেয়র পদপ্রার্থী আনোয়ার হোসেন জানান, দুজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। সংঘর্ষে তাঁর ছেলে আজিম, মেয়ে নারগিস, ভাইজি ফাতিমা, বড় ভাই হাবিবুর রহমান আহত হয়েছেন।

গাজীপুর : শ্রীপুর পৌরসভা নির্বাচন সকাল থেকে সুষ্ঠুভাবে শুরু হলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ৮-১০টি কেন্দ্রে প্রতিপক্ষের এজেন্টদের বের করে দেওয়াসহ নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে বেলা দেড়টার দিকে ৯ নম্বর ওয়ার্ডের তিনটি কেন্দ্রে জোর করে এজেন্ট বের করে দিয়ে নৌকা ও বোতল মার্কা ব্যালটে সিল মারার ঘটনা ঘটে। এ সময় ওই কেন্দ্রগুলোতে প্রায় এক ঘণ্টা ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকে। একই কেন্দ্র কেওয়া পশ্চিশ খণ্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাইরে থেকে ব্যালট পেপার নিয়ে কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশের সময় একজনকে আটক করেছে পুলিশ। এ নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে কমপক্ষে পাঁচজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পরে পুলিশ আধাঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

হবিগঞ্জ : হবিগঞ্জ পৌরসভার ১৮টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে তিনটি কেন্দ্রে জাল ভোট প্রদান, ব্যালট পেপার ছিনতাই এবং আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় দুই সাংবাদিক হামলার শিকার হয়েছেন। পুলিশ ফাকা গুলি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

কুড়িগ্রাম : উলিপুর পৌরসভায় ১৮টি কেন্দ্রের মধ্যে দুটিতে ভোট স্থগিত করা হয়েছে। মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসা ভোট কেন্দ্র ও নারকেলবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে স্থগিত করেছেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা।

মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসা কেন্দ্র থেকে ব্যালট পেপারের তিনটি বই ছিনিয়ে নেওয়াসহ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম। নারকেলবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ভোটকেন্দ্র স্থগিত করেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ফয়জার রহমান। এ ভোট কেন্দ্রে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তিনটি গুলি করে পুলিশ। এ সময় পাঁচজন আহত হয়। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম পৌরসভার ২৩টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে কুড়িগ্রাম সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় ও কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে জোর করে ভোট দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

নরসিংদী : নরসিংদী পৌরসভা নির্বাচনে অনেক ভোটার ভোট দিতে পারেননি। সকাল সকাল ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হলেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সমর্থকরা ভোট গ্রহণের কক্ষ দখল করে নেয়। তারপর প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের সহায়তায় ও পুলিশ পাহারায় জাল ভোট দিতে থাকে তারা। ব্রাহ্মন্দী কে কে এম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট না দিয়েই ফিরে যান আনেকে। নরসিংদী পৌরসভার বীরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র দখল করে একইভাবে জাল ভোট দেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কর্মীরা। ভোট দিতে না পারায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এলাকাবাসী। ভোট দিতে আসা ভোটারদের কেন্দ্র থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া নরসিংদী সরকারি মহিলা কলেজ, সাটিরপাড়া কালিকুমার উচ্চ বিদ্যালয়,  বৌয়াকুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাসাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভেলানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নরসিংদী পাইলট স্কুলসহ প্রায় সব কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দেয় নৌকার কর্মীরা। এই কারণে নিজের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন নরসিংদী পৌরসভার নাগরিকরা।

নরসিংদীর বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে মোবাইল ও ধানের শীষের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়। ভেলানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নরসিংদী সরকারি মহিলা কলেজ কেন্দ্র থেকে রানা মিয়া,  মাসুম মিয়া ও জুবায়ের রহমানকে বের করে দেওয়া হয়। সাটিরপাড়া এলাকায় নৌকার সমর্থকরা স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম কাইয়ুমের ছোট ভাই রাসেলের মাথা ফাটিয়ে দেয়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁকে একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারলেও ভোটগ্রহণ কক্ষে ঢুকতে পারেননি সাংবাদিকরা। মাধবদী পৌরসভার মাধবদী মহাবিদ্যালয় কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ কক্ষে ঢুকতে দেননি প্রিসাইডিং কর্মকর্তা অনুজ কুমার সেনকে। তিনি বলেন, ‘ভেতরে ঢুকতে হলে আমার অনুমতি লাগবে। সুতরাং আপনারা প্রবেশ করতে পারবেন না। এদিকে ব্রাহ্মন্দী কে কে এম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাকির হোসেন মজুমদার বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলের সংবাদকর্মী আরিফুর রহমানকে লাঞ্ছিত করেন। জাল ভোট দেওয়ার চিত্র ধারণের সময় ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা তাঁকে ধাক্কা দেন বলে জানান তিনি। বীরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে জাল ভোট দেওয়ার খবর সংগ্রহ করতে গেলে পোলিং কর্মকর্তার হাতে লাঞ্ছিত হন চ্যানেল টুয়েন্টি ফোরের স্টাফ রিপোর্টার সঞ্জিত সাহা, ক্যামেরাপারসন লক্ষ্মণ বর্মণ, কালের কণ্ঠের স্টাফ রিপোর্টার সুমন বর্মণ।

নরসিংদী : মাধবদী পৌরসভা নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র দখল, অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিস্ফোরণ ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনায় নির্বাচন বাতিল করা হয়েছে। আজ বিকেলে নির্বাচন কমিশন এক গণবিজ্ঞপ্তিতে এই ঘোষণা দেন।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের টাটাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে দুই কাউন্সিলর পদপ্রার্থী হাজি মোহাম্মদ মাতবর আলী প্রধান ও দেলোয়ার হোসেনের মধ্যে কথাকাটাকাটির জের ধরে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এ সময় পুলিশ দেলোয়ার হোসেনের ভাই কাজি ওয়াসিমকে আটক করে। বেলা ১১টার দিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ফজলুল করিম কিন্ডারগার্টেন স্কুল কেন্দ্র দখল করে প্রকাশ্যে জালভোট দেন। ওই সময় প্রতিপক্ষ বিএনপির সমর্থকরা তাদেরকে বাধা দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। এতে কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়। পরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ব্যালট বাক্স, ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে যায় এবং কেন্দ্রে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাসহ সকল দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে একটি কক্ষে আটকে রেখে জাল ভোট দেন। এই সময় মাধবদী পৌরসভার রিটার্নিং কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম ও সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম ভোটকেন্দ্র বাতিল ঘোষণা করেন। এতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা উত্তেজিত হয়ে তাঁদের লাঞ্ছিত করেন।

বেলা ১২টার দিকে মাধবদী মহাবিদ্যালয় কেন্দ্র দখল করে নেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ওই সময় তাঁরা জাল ভোট দেওয়ার সময় বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। খবর পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। পরে ভোটগ্রহণ স্থগিত করায় তিনটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটনায় দুর্বৃত্তরা।

একইভাবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীরা নূর আলম ভূঁইয়া কিন্ডারগার্টেন, কোতায়ালীর চর স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা, টাটাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উইজডম প্রিপারেটরি স্কুল ও মনোহরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র দখল করে ভোট দেওয়ার অভিযোগে কেন্দ্রগুলোর ভোটগ্রহণ স্থগিত করেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা।

এদের মধ্যে উইজডম প্রিপারেটরি স্কুল কেন্দ্রে ভোট কারচুপির গুজব ছড়িয়ে পড়লে বিএনপির নেতাকর্মীরা ইট-পাটকেল নিক্ষেপসহ তিনটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এ সময় ভোটকেন্দ্রের ছাউনিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। হামলার পর পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ভোটগ্রহণ স্থগিত ও ভোট বাক্স নিয়ে যায়।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী মোশাররফ হোসেন প্রধান মানিক ও বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাজি মো. ইলিয়াছকে সঙ্গে নিয়ে পৌরসভার কেন্দ্র পরিদর্শন করেন পুলিশ সুপার আমেনা বেগম।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) হাসিবুল ইসলাম বলেন, ককটেল হামলায় পুলিশের কমপক্ষে পাঁচ সদস্য আহত হয়েছে। তবে এসব ঘটনায় কাউকে আটক করা হয়নি। এই ঘটনায় থানায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।

জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য পৌরসভার ১২টি কেন্দ্রের মধ্যে ছয়টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন পৌরসভাটির নির্বাচন বাতিল করেছে।

রাঙামাটি : নজিরবিহীন অনিয়ম, জাল ভোট আর বহিরাগতদের ব্যাপক ভোট দেওয়ার মধ্য দিয়ে পার্বত্য রাঙামাটি পৌরসভার নির্বাচন শেষ হয়েছে। সকাল থেকেই শহরের বিভিন্ন কেন্দ্রে ব্যাপকভাবে ভোট জালিয়াতির খবর পাওয়া যায়। শহরের রিজার্ভবাজারের পাঁচটি কেন্দ্রে, কাঁঠালতলীর দুটি কেন্দ্রে, তবলছড়ির চারটি কেন্দ্রে ব্যাপক জাল ভোট দিতে দেখা গেছে। রাঙামাটির বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা সরকার দলের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ব্যাপকভাবে ভোট দিতে দেখা গেছে।

দুপুরে শহরের রিজার্ভবাজারে বিএনপির প্রার্থী সাইফুল ইসলাম চৌধুরী ভুট্টোর গাড়ি ও তাঁর নির্বাচনী কার্যালয় ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। বিকেলে ভোটগ্রহণ শেষে তাঁর ওপর দ্বিতীয় দফা হামলা করা হলে তিনি আহত হন এবং তাঁর গাড়ি ব্যাপক ভাঙচুরের শিকার হয়। তিনি বিকেলে হাসপাতালে ভর্তি হন।
বেলা ১১টার দিকে শহরের আবদুল আলী একাডেমি কেন্দ্রে বাঘাইছড়ি থেকে আসা ছাত্রলীগের চার নেতাকে জাল ভোট দেওয়ার সময় স্বতন্ত্র প্রার্থী রবিউল আলম রবির অভিযোগের ভিত্তিতে আটক করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। তাদের জিজ্ঞাসাবাদেও অভিযোগের সত্যতা পায় তারা। এ সময় তাদের চারজনকে আটক করা হলেও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মুছা মাতব্বর আসার পর তার অনুরোধে সাংবাদিকদের সামনেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান স্বতন্ত্র প্রার্থী রবিউল আলম রবি। তিনি বলেন, প্রশাসন নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব করছে। তিনি সাংবাদিকদের প্রতিক্রিয়া দেখানোর পর তাঁকে গ্রেপ্তারের হুমকি দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশ দিয়ে কেন্দ্র থেকে বের করে দেন।

দুপুরে রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে জাল ভোট দেওয়ার সময় হেলালউদ্দিন নামের এক যুবলীগ কর্মীকে আটক করে ১৫ দিনের কারাদণ্ড দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রুমানা রহমান শম্পা।

বিকেলে শহরের কাঁঠালতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণ বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গোধূলি আমানতবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ওয়াবদ রেস্ট হাউস, রাঙামাটি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ব্যাপক ভোট কারচুপির অভিযোগকে ঘিরে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। এসব কেন্দ্রে ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামী লীগ কর্মীরা জাল ভোট দেওয়া শুরু করলে কোথাও বিএনপি, কোথাও জনসংহতি সমিতি, আবার কোথাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষ চলাকালে গুলির শব্দও শোনা যায়। এ সময় একজন পুলিশ কনস্টেবলসহ কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে কনস্টেবল মো. দিদার, কাউন্সিলর পদপ্রার্থী আবদুল মালেক ও  মো. শাহ আলমের নাম পাওয়া গেছে। শাহ আলমকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী সাইফুল ইসলাম ভুট্টো বলেন, যেভাবে বিভিন্ন উপজেলা থেকে বহিরাগতদের এনে জাল ভোটের উৎসব করেছে আওয়ামী লীগ, তা রাঙামাটিবাসীর জন্য লজ্জার। এভাবে বিজয়ের মধ্যে কোনো অহংকার নেই। তিনি অভিযোগ করেন, তাঁর গাড়ি ও নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে তাঁদের কর্মীদের কেন্দ্রের কাছাকাছি ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি, পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেছেন, ওরা যা করেছে তাকে কোনোভাবে ‘ভোট’ বলে না। প্রশাসনের বিরুদ্ধে নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করেন তিনি।

জনসংহতি সমিতির প্রার্থী ডা. গঙ্গামানিক চাকমা অভিযোগ করেছেন, যেভাবে ভোটকেন্দ্র দখলের উৎসব করেছে ক্ষমতাসীন দল। তিনি বলেন, ‘এভাবে ভোটে জয়ের পর, এটাই শেষ কথা হয়। আমরা ভোটের পরেও ছাড় দেব না।’

স্বতন্ত্র প্রার্থী রবিউল আলম অভিযোগ করেন, প্রশাসনকে যে বিতর্কিত ভূমিকায় দেখা গেছে তাতেই বোঝা যায় তারা কতটা নিরপেক্ষ ছিলেন। এমন নির্লজ্জ ভূমিকা অতীতে কোনো নির্বাচনেই আমরা দেখিনি। এভাবে জাল ভোট, কারচুপি, মারধর করে যে নোংরা রাজনীতির চর্চা করেছে ক্ষমতাসীনরা, তা দুঃখজনক এবং নজিরবিহীন। তবে রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মুছা মাতব্বর ও মেয়র পদপ্রার্থী আকবর হোসেন চৌধুরী জানিয়েছেন, নিশ্চিত পরাজয় জেনে এবং  নৌকার পক্ষে গণজোয়ার দেখেই তারা নির্বাচন নিয়ে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ করছে। কোনো প্রকার কারচুপি হয়নি বলেও দাবি করেন তাঁরা। মো. মুছা মাতব্বর অভিযোগ করেছেন, প্রশাসন তাঁদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে এবং বিরোধীদের সহযোগিতা করেছে।

বান্দরবান : বিশৃঙ্খলার কারণে সদরের কালেক্টরেট স্কুল কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ সাময়িক বন্ধ ছিল। আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে বিএনপির দুই কর্মীকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিকেল ৩টার পর সদর পৌরসভার ৬, ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে মেয়র প্রার্থীদের সমর্থকরা। যৌথ খামার, হাফেজঘোনা, সরকারি কলেজ এবং কালেক্টরেট স্কুলসহ বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে ব্যাপক জাল ভোট দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ মেয়র পদপ্রার্থীদের। জাল ভোট দেওয়ার পাল্টাপাল্টি অভিযোগে কালেক্টরেট স্কুল ভোটকেন্দ্রে জাতীয় পার্টির (জাপা) মেয়র পদপ্রার্থী মিজানুর রহমান বিপ্লব, বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী মোহাম্মদ জাবেদ রেজার সমর্থকদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী মো. ইসলাম বেবীর নেতাকর্মীদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।

বিশৃঙ্খলার কারণে প্রায় ২০ মিনিট ভোটগ্রহণ বন্ধ ছিল কালেক্টরেট কেন্দ্রে। আতঙ্কে ভোটাররা ভোটকেন্দ্র ছেড়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যান। পরে বিজিবি, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে। পরিস্থিতি শান্ত হলে পুনরায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়। বিশৃঙ্খলা তৈরির অভিযোগে বান্দরবানে বিএনপির দুই কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। অপরদিকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে ছয় নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপির কাউন্সিলর পদপ্রার্থী আইয়ুব খানকে আটক করা হলেও পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।

সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিক উল্লাহ বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। কোথাও কোনো ধরনের অনিয়ম এবং বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটেনি।

জাতীয় পার্টির মেয়র পদপ্রার্থী মিজানুর রহমান বিপ্লব বলেন, নৌকা প্রতীকে সিল মারা প্রায় দুই হাজার ৬০০ ব্যালট পেপার ৪, ৬, ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ভোটকেন্দ্রগুলোতে বাক্সে ফেলানো হয়েছে।

বহিরাগত ভোটাররা কেন্দ্রগুলোতে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে জাল ভোটগুলো প্রয়োগ করেছে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অসহায়ের মতো চেয়েছিল। কেন্দ্রের বুথগুলো থেকে এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। সাধারণ ভোটারদের কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী মোহাম্মদ জাবেদ রেজা বলেন, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। প্রার্থীর বিরুদ্ধে অশালীন স্লোগান, হামলা এবং এজেন্টদের বুথ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রীতির বান্দরবানে এ ধরনের নির্বাচন কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে থাকবে।

তবে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মো. ইসলাম বেবী বলেন, ‘উৎসব মুখর পরিবেশে শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। কোথাও কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। ভোট সুষ্ঠু হয়েছে, আমি জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।’

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মোহাম্মদ চাহেল তস্তরি বলেন, কালেক্টরেট স্কুল এবং সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে কিছুটা বিশৃঙ্খলা হলেও ভোটগ্রহণে কোনো ধরনের সমস্যা হয়নি। শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই ভোটাররা ভোট দিয়েছেন।

Print Friendly, PDF & Email