নৈতিক অবক্ষয় ও বিকারগ্রস্ততা চরমে, মহামারি রূপে ধর্ষণ

ইমরান সামি : দেশে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে ধর্ষণ। ধর্ষকের লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাদ যাচ্ছে না কন্যাশিশু ও বৃদ্ধ নারীরাও। এমনকি রেহাই পাচ্ছে না বাক বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধীরাও। শুধু তাই নয়, ধর্ষণ শেষে নির্মম নির্যাতন, এমনকি চলন্ত বাস থেকে ফেলে দিয়ে কিংবা আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটছে। মানুষ নামধারীরা এক বিভত্স রূপ নিয়ে হাজির হচ্ছে আমাদের কন্যাশিশু, কিশোরী ও নারীদের সামনে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি মাসের প্রথম আটদিনে ৪১টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। মূলত অপসংস্কৃতি, আকাশ সংস্কৃতির বেসামাল প্রভাব, অশ্লীলতা, ঘুষ, দুর্নীতিসহ নানা কারণে দেশে দিনে দিনে সামাজিক অবক্ষয় আর অস্থিরতা চরম আকার ধারণ করেছে। অশ্লীলতার আগ্রাসনের পাশাপাশি মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ে ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে চরম নৈতিক অবক্ষয়, আকাশ সংস্কৃতির বিরূপ প্রভাব, মাদকের বিস্তার, বিচারহীনতা, বিচার প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা।

কেন এত ধর্ষণ: মনোবিদরা বলছেন, যারা ধর্ষক তারা মনোবিকারগ্রস্ত। নারীর ওপরে ক্ষমতা দেখানো, তাকে দখল করার মনোবৃত্তি এবং অবদমিত কাম চরিতার্থ করতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। সেইসঙ্গে তারা এটাও বলছেন যে, ধর্ষণ করলে অপরাধীর কোনো শাস্তি হবে না। তাই এ ধরনের ঘটনা কমানো যাচ্ছে না। দিন দিন বাড়ছে, সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়ছে ধর্ষণ। সংবাদপত্রের পাতায় প্রতিদিন ধর্ষণের খবর ছাপা হচ্ছে। সভ্যতা যত এগুচ্ছে দিন দিন ধর্ষণের মাত্রা যেন আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, অফিস, রাস্তা-ঘাট, বাস— কোথাও নারী নিরাপদ নয়। যেখানেই সুযোগ মিলছে সেখানেই বিকারগ্রস্ত পুরুষদের দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছে নারী। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে কিশোর বয়সের মেয়েরা সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এরপরেই রয়েছে শিশুরা। অর্থাত্ অল্পবয়সী মেয়েরা যাদের প্রতিরোধের শক্তি-সাহস নেই তারাই ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বেশি। প্রতিদিন কত মেয়ে যে ধর্ষিত হয় তার কোনো হিসাব নেই। যারা সামনে এসে বিচার চায় আর যারা হত্যার শিকার হন তাদের খবরই আমরা শুধু জানতে পারি। অনেকে অপমানের জ্বালা ও যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকে। মানুষে মানুষে সম্পর্ক, নারী পুরুষের সম্পর্ক মমতা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার ওপরে টিকে রয়েছে। সেই শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর সম্মানটাই যেন নারীর ওপর থেকে চলে গেছে এক শ্রেণির পুরুষের। নারী হয়ে উঠেছে ভোগের বস্তু।

ধর্ষণের যন্ত্রণার তীব্রতা যে কতখানি, তা আমরা কিছুটা বুঝতে পারি যখন দেখি ছোট্ট মেয়ের ধর্ষণের বিচার না পেয়ে বাবা আর মেয়ে মিলে একসঙ্গে আত্মহনন করেছিল রেললাইনে মাথা পেতে। তাদের কাছে এই শব্দের যন্ত্রণা মৃত্যুর থেকেও অনেক ভারি। সমাজবিদরা জানাচ্ছেন, ধর্ষকদের বিচার না হওয়ার কারণে সমাজে ধর্ষণের মাত্রা কমছে না। সঠিক বিচার সমাজের অপরাধ কমিয়ে আনতে সহায়ক।

ধর্ষণের মাত্রা কমছে না: আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিট জানাচ্ছে, ধর্ষণের মাত্রা কমছে না। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে ২০১৮ সালে দেশে মোট ধর্ষণের সংখ্যা ৭৩২টি। আর এ বছর প্রথম চার মাসে মোট ধর্ষণের সংখ্যা ৩৫৪টি। তাদের হিসাবে দেখা যাচ্ছে ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েরা সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। গতবছর এই সংখ্যা ছিল ১১৬ জন। এরপরেই রয়েছে ৭ থেকে ১২ বছরের মেয়েরা। ২০১৮ সালে ১০৪ মেয়েশিশু ধর্ষিত হয়েছে। আর এবছর এই চার মাসেই ১৩ থেকে ১৮ বছরের ৬৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে, আর ৭-১২ বছরের মধ্যে এ সংখ্যা ৫২ জন। আর এক বছরের কম থেকে ছয় বছরের শিশু ধর্ষণের সংখ্যা খুব মারাত্মক। গতবছর যা ছিল ৫১ জন। এবছর এই চার মাসেই এই সংখ্যা ৩৮ জনে দাঁড়িয়েছে।

গত পাঁচ বছরের ধর্ষণের চালচিত্র দেখলে শিউরে উঠতে হয়। ২০১৪ সালে মোট ধর্ষণ ৭০৭টি। এর মধ্যে একক ধর্ষণের সংখ্যা ৩৮৭টি, গণধর্ষণ ২০৮, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা ৬৮, ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা ১৩ আর ধর্ষণ চেষ্টা ৮১টি। ২০১৫ সালে মোট ধর্ষণ ৮৪৬টি। এর মধ্যে একক ধর্ষণের সংখ্যা ৪৮৪টি, গণধর্ষণ ২৪৫, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা ৬০, ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা ২ আর ধর্ষণ চেষ্টা ৯৪টি। ২০১৬ সালে মোট ধর্ষণ ৭২৪টি। এর মধ্যে একক ধর্ষণের সংখ্যা ৪৪৪টি, গণধর্ষণ ১৯৭, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা ৩৭, ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা ৮ আর ধর্ষণ চেষ্টা ৬৫টি। ২০১৭ সালে মোট ধর্ষণ ৮১৮টি। এর মধ্যে একক ধর্ষণের সংখ্যা ৫৯০টি, গণধর্ষণ ২০৬, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা ৪৭, ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা ১১ আর ধর্ষণ চেষ্টা ১০৪টি। ২০১৮ সালে মোট ধর্ষণ ৭৩২টি। এর মধ্যে একক ধর্ষণের সংখ্যা ৫০২টি, গণধর্ষণ ২০৩, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা ৬৩, ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা ৭ আর ধর্ষণ চেষ্টা ১০৩টি। আর ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, মোট ধর্ষণ ৩৫৪টি। এর মধ্যে একক ধর্ষণের সংখ্যা ২৫৬টি, গণধর্ষণ ৯৪, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা ১৮, ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা ৬ আর ধর্ষণ চেষ্টা ৫৫টি।

বিশেষজ্ঞরা যা বলেন: এ প্রসঙ্গে কথাসাহিত্যিক ও মনোবিজ্ঞানী মোহিত কামাল বলেন, আমাদের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের বিবেক। বিবেককে চাপিয়ে যখন প্রবৃত্তি প্রভাব বিস্তার করে তখন ভোগবাদী সত্তা আধিপত্য বিস্তার করে। ধর্ষকরা শুধু নারীলোলুপ নয়। তাই যদি হতো তাহলে তারা শিশুদের ধর্ষণ করত না। প্রথমত তারা অবদমিত কাম চরিতার্থ করতে চায়, দ্বিতীয়ত, নারীর প্রতি প্রভুত্ব বা ক্ষমতা দেখাতে চায়, তৃতীয়ত, নারীকে ভোগের বস্তু মনে করে। নারী যে বোনের মমতা, মায়ের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় মেশানো একজন মানুষ, সেটা এদের মন থেকে সরে গিয়ে শুধু ভোগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, যারা ধর্ষক তারা মানসিকভাবে সুস্থ নন, তারা মনোবিকারগ্রস্ত ব্যক্তি। এরা ধর্ষণ করে অসহায় শিশু, কিশোর বয়সী নারীদের। নয়তো দল বেঁধে ধর্ষণ করে। শক্ত-সমর্থ কোনো নারীকে এরা ধর্ষণ করতে যায় না। অনেকে মাদকাসক্ত থাকে সেজন্য খুব উগ্র আচরণ করে। সেইসঙ্গে এদের অনেকেই শিশু বয়সে ধর্ষণ বা সামাজিকভাবে নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকে। ফলে এরা মনের সেই রাগ ক্ষোভ মেটাতে দুর্বল কিশোরীদের বেছে নেয়।

বিচারহীনতার সংস্কৃতিকেই দোষারোপ: সমাজে ধর্ষণের মাত্রা বৃদ্ধির কারণ হিসাবে দুইজন মনোবিজ্ঞানীই বিচারহীনতার সংস্কৃতির কথা উল্লেখ করেছেন। মোহিত কামাল বলেন, ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এর পাশাপাশি শিশুদের বিকাশের সময়ে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে। একজন সুস্থ মানুষ কখনো ধর্ষক হবে না। তাই এই ভোগবাদী সমাজে বেড়ে উঠতে গিয়ে শিশুদের কাছ থেকে স্মার্ট ফোন দূরে রাখতে হবে। স্মার্ট ফোনের নাগাল পেলেই তাদের জন্য পর্নো সাইটগুলোতে বিচরণের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। শিশু বয়সে এ ধরনের উত্তেজক সাইট দেখলে তাদের মাঝ থেকে নারীর প্রতি মমতা, ভালোবাসা দূর হয়ে তাদের কামের বস্তু হিসেবে মনে করতে শুরু করবে। তাই শিশুদের সুস্থ স্বাভাবিক বিকাশ সবচেয়ে জরুরি।

Print Friendly, PDF & Email