মেঘনা গোমতি দ্বিতীয় সেতু চালু হলেও মেরামতের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে পুরনো দুটি

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ ১৯৯৫ সালের পর, অর্থাৎ প্রায় দুই যুগ পর নির্ধারিত সময়ের আগেই বাংলাদেশে কোনো প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ হতে যাচ্ছে। ‘কাঁচপুর, মেঘনা ও গোমতী দ্বিতীয় সেতু নির্মাণ এবং বিদ্যমান সেতু পুনর্বাসন’ শিরোনামে প্রকল্পের আওতায় ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়কে কাঁচপুর, মেঘনা ও গোমতী দ্বিতীয় সেতুর নির্মাণ কাজ নির্ধারিত সময়ের এক মাস আগে শেষ হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এই তিনটি সেতু নির্মাণের জন্য যে টাকা বরাদ্দ ছিল, সেই অর্থের চেয়েও কম খরচে নির্মাণ কাজ শেষ করেছে নির্মাণকারী জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে প্রকল্পের পুরো কাজ এখনই শেষ হচ্ছে না।

প্রকল্পটির পরিচালক আবু সালেহ মো. নুরুজ্জামান বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী কাঁচপুর দ্বিতীয় সেতুর মেয়াদ ছিল ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। আর মেঘনা ও গোমতীর মেয়াদ ছিল জুন-জুলাই ২০১৯ সাল পর্যন্ত।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু হলি আর্টিসান ঘটনার কারণে নির্মাণ কাজ ছয় মাস বন্ধ ছিল। এ জন্য তারা (নির্মাতা প্রতিষ্ঠান) অতিরিক্ত ছয় মাস সময় চেয়েছিল। কিন্তু সেই ছয় মাস সময় তো তারা নেয়নি, বরং মূল চুক্তির প্রায় ১ মাস আগে তারা এই প্রকল্পের কাজ শেষ করে দিল।’

প্রকল্প পরিচালকের দেয়া তথ্য মতে, এ বছরের ১৬ মার্চ কাঁচপুর দ্বিতীয় ব্রিজের উদ্বোধন করা হয়েছে। ঈদের আগে আগামী ২৫ মে মেঘনা ও গোমতী দ্বিতীয় সেতুর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রকল্প সূত্র জানায়, সেতু তিনটি যৌথভাবে নির্মাণ করছে জাপানের ওবায়েশি কর্পোরেশন, সিমিজু কর্পোরেশন, জেএফই কর্পোরেশন এবং আইএইচআই ইনফ্রাস্ট্রাকচার সিস্টেম কোম্পানি লিমিটেড।

প্রকল্প পরিচালক মো. নুরুজ্জামান বলেন, উনারা নির্ধারিত সময়ের আগেই নির্মাণ করলেন, এটা তাদের কৃতিত্ব। তিনি বলেন, হলি আর্টিসান ঘটনার কারণে তাদের কাজ ৬ মাস বন্ধ ছিল। এই কাজগুলো শেষ করার জন্য আরও ৬ মাস সময় তাদের ন্যায্য পাওনা ছিল। কিন্তু তারা সেই অতিরিক্ত সময় না নিয়েই নির্ধারিত সময়ের আরও এক মাস আগে কাজটা শেষ করে দিল তারা।

তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে গড়াই ব্রিজ নির্মাণের কাজ (১৯৯০ সালে) নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ করা হয়েছিল। এরপর নির্ধারিত সময়ের আগে পুরাতন মেঘনা ও গোমতী সেতুর কাজ শেষ করা হয়েছিল যথাক্রমে ১৯৯১ ও ১৯৯৫ সালে। সবগুলো কোম্পানিই ছিল জাপানের। বাংলাদেশে নির্ধারিত সময়ের আগে প্রকল্পের কাজ শেষ করার ইতিহাস একমাত্র জাপানিদেরই। আর কারও নেই। ১৯৯৫ সালের পর এই কাজটা তারাই করল।’ পুরনো গোমতি ব্রিজের কাজ যখন নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হয়, সেই প্রকল্পের তিনি সহকারী প্রকৌশলী ছিলেন বলে জানান।

প্রকল্প সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ১ এপ্রিল শুরু হওয়া এই প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর। অর্থাৎ নতুন ব্রিজ তিনটির নির্মাণ কাজ নির্ধারিত সময়ের আগে শেষ হলেও পুরো কাজ শেষ হতে আরও সময় লাগবে। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘নতুন দুটি ব্রিজ ২৫ মে থেকে চালু হয়ে যাবে এবং পুরাতন ব্রিজগুলো মেরামতের কাজ শুরু হবে।’

প্রকল্প পরিচালকের দেয়া তথ্য মতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়কর ৩৭তম কিলোমিটারে গোমতী নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছে গোমতী দ্বিতীয় সেতু। ৪১ মাসের (৩ বছর ৫ মাস) মধ্যে সেতুটি নির্মাণের কাজ শেষ করেছে জাপানি কোম্পানিগুলো। ২০১৬ সালের ৩ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ২০১৯ সালের ২৫ মের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হলো। এতে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা।

গোমতী দ্বিতীয় সেতু প্রকল্প সূত্র জানায়, গোমতী দ্বিতীয় সেতুর দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৪১০ মিটার, প্রস্থ ১৭ দশমিক ৭৫ মিটার। এর মধ্যে যানবাহনের জন্য ১৪ দশমিক ৬০ মিটার, ফুটপাত ১ দশমিক ৫০ মিটার, ইন্সপেকশন প্যাসেজ দশমিক ৬০ মিটার, মিডিয়ান বেরিয়ার দশমিক ৬৫ মিটার এবং রেলিং দশমিক ২০ মিটার। লেন সংখ্যা ৪টি।

ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়কের ২৫তম কিলোমিটারে মেঘনা নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছে মেঘনা দ্বিতীয় সেতু। সেতুটি নির্মাণে সময় লেগেছে ৪১ মাস। ২০১৬ সালের ৩ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ২০১৯ সালের ২৫ মের মধ্যে শেষ হলো সেতুটি নির্মাণের কাজ। সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।

মেঘনা দ্বিতীয় সেতুটির দৈর্ঘ্য ৯৩০ মিটার, প্রস্থ ১৭ দশমিক ৭৫ মিটার। এর মধ্যে যানবাহনের জন্য ১৪ দশমিক ৬০ মিটার, ফুটপাত ১ দশমিক ৫০ মিটার, ইন্সপেকশন প্যাসেজ দশমিক ৬০ মিটার, মিডিয়ান বেরিয়ার দশমিক ৬৫ মিটার এবং রেলিং দশমিক ২০ মিটার। এতে লেন সংখ্যা ৪টি।

অর্থ সাশ্রয়
সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এই প্রকল্পে মোট বরাদ্দ ছিল ৮ হাজার ৪৮৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।

এর মধ্যে মেঘনা দ্বিতীয় সেতুর জন্য বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার মধ্যে এই সেতু নির্মাণ কাজ শেষ করেছে জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো। অর্থাৎ বাংলাদেশের সাশ্রয় হয়েছে এই সেতু থেকে ৫০০ কোটি টাকা।

গোমতী সেতুর জন্য বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৪১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৯৫০ কোটি টাকার মধ্যে এই সেতুর কাজ শেষ করেছে জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো। এই সেতু থেকে সাশ্রয় হয়েছে ৪৬০ কোটি টাকা।

আর কাঁচপুর সেতুর জন্য বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। তবে এই প্রকল্প কত টাকার মধ্যে শেষ করতে পেরেছে প্রতিষ্ঠানগুলা, তা জানা যায়নি।

প্রকল্প পরিচালক মো. নুরুজ্জামান জানান, এই প্রকল্প (নতুন ব্রিজ নির্মাণ+পুরাতন ব্রিজ সংস্কার) থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।

তবে এসব টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যাবে কি-না প্রকল্প শেষ না হওয়া পর্যন্ত তা বলা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে নুরুজ্জামান বলেন, ‘এই কাজের দুটো অংশ। এক, নতুন ব্রিজ নির্মাণ আর পুরাতন ব্রিজগুলো সংস্কার করা। নতুন ব্রিজ চালু হলে তখন পুরাতন ব্রিজগুলো ফাঁকা হয়ে যাবে, তখন সংস্কার শুরু হবে। সুতরাং টাকা ফেরত যাওয়ার কথা এই মুহূর্তে আসে না। সেটা হবে সব সম্পন্ন করার পরে।’

জাপানিদের কাজের প্রশংসা করে মো. নুরুজ্জামান বলেন, ‘জাপানিরা কাজ নেয়ার পর তারা অসম্ভব সিনসিয়ার। তারা খুব পরিকল্পনা করে কাজ করে। অনেক আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নেয়। তারা কাজে কখনই বিলম্ব করে না। যেটুকু বিলম্ব হয় সেটা হয়তো অন্য কোনো কারণে, তবে সেটা কাভার করার জন্য তারা জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করে।’

তবে জাপানিদের কাজের মূল্য স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বলেও জানান তিনি। নুরুজ্জামান বলেন, ‘ভালো জিনিস পেতে হলে একটু বেশি টাকা তো দিতেই হবে। ওরা কৃপণ মানে কী, ওরা হাড়-কিপটা। সাইটে গেলে আমাদেরকে নিজেদের ৬০ টাকায় ওদের ওখানে ভাত খেতে হয়। গাড়ির চালকরা ৩০ টাকা দিয়ে ভাত খান। এখানে ওদের কোনোরকম খাতির-যত্ন নাই। আর মিটিংয়ে শুধুমাত্র এক কাপ চা খাওয়ায়। ওদের সঙ্গে মিশলে প্রথম প্রথম মনে হবে ওরা বোধহয় অভদ্র। কিন্তু পরে বুঝবেন, এটা বোধহয় ওদের জাতিগত কৃতিত্ব।’

এই প্রকল্পে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেছে ওসিজিএল, জেবিআইসি, কেইআই, এনইসি জাপান ও এসএমইসি অট্রেলিয়ার জয়েন্ট ভেনচার এবং সহযোগিতায় ছিল বিসিএল, ডেভকন ও এসিই বাংলাদেশ।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও জনপথ অধিদফতর। বাংলাদেশ সরকার ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এতে অর্থায়ন করেছে।

Print Friendly, PDF & Email