মামলার ‘দুর্বল’ সাক্ষীদের ক্ষতির আশঙ্কা !

বাবুল-মিতু

নিজস্ব প্রতিবেদক ।।

নিজের মামলাটি অকার্যকর হলেও মেয়ে মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যাকাণ্ডে জামাতা বাবুল আক্তারকে আসামি করে পিবিআইর দেওয়া অভিযোগপত্রে সন্তোষ জানিয়েছেন মোশাররফ হোসেন। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) মঙ্গলবার আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডে বাবুলের করা প্রথম মামলাতেই অভিযোগপত্র দেয়। এতে বাবুলসহ সাতজনকে আসামি করা হয়েছে, যাদের সবাই মোশাররফের করা পরের মামলাটিতেও আসামি ছিলেন।

তবে মামলার সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তিত মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ। সাবেক এসপি বাবুলের ‘সহযোগীরা’ এই মামলার ‘দুর্বল’ সাক্ষীদের ক্ষতিসাধন করতে পারে বলে তার আশঙ্কা। ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় মিতুকে প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

হত্যাকাণ্ডের পর নগরীর পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে একটি মামলা করেছিলেন সেসময় পুলিশ সুপার পদে থাকা বাবুল। এরপর ওই বছরই নানা নাটকীয়তার পর পুলিশের চাকরি ছাড়েন তিনি। মিতু হত্যা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে খোদ বাবুলের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়ে গত বছরের ১২ মে ওই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পিবিআই। এরপর ঢাকা থেকে গিয়ে সেদিনই নতুন হত্যা মামলা করেন মিতুর বাবা মোশাররফ। তবে আইনি জটিলতায় পড়ে ২৫ জানুয়ারি মোশাররফের করা সেই মামলায়ও আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পিবিআই। এরপর মঙ্গলবার বাবুলের মামলায়ই তাকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেওয়া হল।

আদালতে জমা দেওয়া  অভিযোগপত্রে বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। ‘পরকীয়ার ঘটনা জেনে যাওয়ায়’ নিজের ‘সোর্সদের দিয়ে’ টাকার বিনিময়ে বাবুল স্ত্রী মিতুকে খুন করান বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

অভিযোগপত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে মিতুর বাবা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ বলেন, “আমার মেয়েকে খুন করার ছয় বছরের বেশি সময় পর আজকে যে অভিযোগপত্র দেওয়া হল, এজন্য সবার কাছে কৃতজ্ঞ।”

শঙ্কার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আসলে বাবুল আক্তার কত নৃশংস, তা তার ইতিহাস দেখলে জানতে পারবেন। তার লোকজন আছে। তারা সবাই সক্রিয়। দেশে-বিদেশে অনেকেই আছে। ইতিমধ্যে তার পক্ষে ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণাও তারা চালাচ্ছে। তাই আমরা হুমকি অনুভব করছি। আমাদের পরিবারের যে কারও ক্ষতিসাধন তারা করতে পারে।

“এ মামলার সাক্ষীদের মধ্যে কেউ কেউ দুর্বল অবস্থানে আছেন। তাদেরও ভীতি প্রদর্শন করতে পারে, যাতে তারা আদালতে সাক্ষী দিতে না যায় বা যথাযথ সাক্ষ্য না দেয়। তাই এখন পর্যন্ত পিবিআই’র সুপারভাইজরি অফিসাররা যেভাবে কাজ করেছেন। বিচার কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত তারা যেন এরকম সক্রিয় থাকেন, এটা আমার আবেদন।”

পিবিআইর তদন্তে পরকীয়ার বিষয়টি উঠে আসায় সন্তোষ জানিয়ে মোশাররফ বলেন, “প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) থেকে শুরু করে শেষ আইও পর্যন্ত সবাইকে আমরা বিষয়গুলো বলেছি।  “বাবুল মিশনে যাওয়ার সময় তার যে মোবাইল ফোনটি বাসায় রেখে যায়, সেটাতেই গায়ত্রী অমর সিং নামের ওই মহিলা এসএমএস পাঠাতে থাকে। মোবাইলটি বাসায় থাকায় মিতু সেগুলো পায়। ওই নারী মিতুর নম্বরে ফোন করেও অনেক আপত্তিকর কথা বলেছিল।”

মোশারফের মতোই অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার ছেলে বাবুল ২০১৩ ও ২০১৪ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিতে দেশের বাইরে ছিলেন। তার আগে কক্সবাজারে কর্মরত অবস্থায় বিদেশি এনজিওকর্মী গায়েত্রীর সঙ্গে তার বিয়ে বর্হিভূত সম্পর্ক গড়ে ‍উঠেছিল বলে অভিযোগ। মোশাররফ বলেন, “২০১৪ সালে যখন এসব এসএমএস পেয়ে মিতু আমাকে জানায়, তখন আমি হজে ছিলাম। দেশে ফিরে এ বিষয়গুলো তখনকার পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছিলাম। “তখন এটা ছিল পারিবারিক বিষয়। কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যস্থতায় সালিশ বৈঠকও হয়েছিল। তারা চেষ্টা করেছিলেন।”

মিতু হত্যাকাণ্ডের পর বাবুলকে ঢাকায় নিজ বাড়িতে আশ্রয় দেওয়া এবং তখন বাবুলের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না তোলার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মোশাররফ বলেন, “আমার মেয়ে মারা গিয়েছিল। আমার ছোট দুটো নাতি-নাতনি তখন এতিম হয়ে গিয়েছিল। তখন ওই পরিস্থিতিতে, কে আসামি, কে বাদী, সেগুলো আমরা চিন্তা করতে পারিনি। “তবে বাবুল জড়িত নয়, এমন কথা আমরা কখনও বলিনি। প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছেই আমরা ২৯টি এসএমএস, বাবুলকে দেওয়া গিফটের বইয়ের ফটোকপিসহ ৩২টি তথ্য লিখিত দিয়েছিলাম। এছাড়া আরও অনেক ডকুমেন্ট দিই। পরকীয়া সংক্রান্ত সব ডকুমেন্ট আমরা দিই।”

বাবুলকে ওই বিদেশি নারী আহমেদ রশিদ রচিত ‘তালিবান’ নামে একটি বই উপহার দেন। বইটিতে ওই নারীর এবং শেষের দিকে খালি পাতায় বাবুল আক্তারের হাতে লেখা তাদের ‘প্রথম সাক্ষাতের’ বিষয়সহ কিছু তথ্য লেখা ছিল। সেই বইটি মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করেছে পিবিআই। বাবুলের হাতের লেখা ওই বইয়ের লেখার সঙ্গে মিলেছে বলেও অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছে পিবিআই।

এ প্রসঙ্গে মোশাররফ বলেন, “কক্সবাজারে যে বিদেশি নাগরিকের সাথে বাবুলের পরকীয়া ছিল, সেই নারীর বাসার দারোয়ান এবং গৃহকর্মী এ মামলায় সাক্ষী। তারা আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। তাদের নিরাপত্তা জরুরি। “তাই আমরা চাই সাক্ষ্য যেন সুষ্ঠুভাবে হয়। বিচার যেন সুষ্ঠুভাবে হয়। সাক্ষীরা অনেকেই দুর্বল ও সাধারণ মানুষ। তারা ভয় পেলে যথাযথ সাক্ষ্য দিতে পারবে না।”

মোশাররফ বলেন, “বাবুল আক্তার একজন বড় পুলিশ কর্মকর্তা ছিল। যতই সময় পেয়েছে সে নানা খুঁত বের করার চেষ্টা করছে। সে সময়ের অপেক্ষায় ছিল। তদন্ত ও অনুসন্ধান সঠিকভাবে করায় পিবিআই প্রধানসহ কাউকেই সে রেহাই দেয়নি। তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলার আবেদন করেছে।” তবে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়ার আগে পিবিআইর কর্মকর্তারা তাকে জানাননি বলে জানান মোশাররফ। তিনি বলেন, “সংবাদ মাধ্যম থেকে জেনেছি আজ অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে।”

Print Friendly, PDF & Email