শিরোনাম :

  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪

দায় দেনায় জর্জরিত আটকে পড়া প্রবাসীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক |

মহামারীর কারণে দেশে আটকে পড়া প্রবাসী বাংলাদেশীরা কর্মস্থলে ফিরতে পারছেন না সাত মাস ধরে। ফলে আয়-উপার্জনও বন্ধ পুরোপুরি। অনেকেরই সঞ্চিত অর্থটুকুও শেষ হয়ে গিয়েছে বহু আগে। ফলে পরিবারের ভরণপোষণ চালাতে হচ্ছে ধারদেনা করে। এ ঋণের পরিমাণও ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এ অবস্থায় কর্মস্থলে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো গতি নেই তাদের। যদিও ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রেও ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট বা আকামার মেয়াদ ও উড়োজাহাজের টিকিট ক্রয়সহ আরো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নানা সংকটের মোকাবেলা করতে হচ্ছে তাদের।

ভুক্তভোগী প্রবাসীরা জানান, বেশ কয়েক মাস দেশে থাকায় তাদের সঞ্চিত অর্থ শেষ। অনেকে উড়োজাহাজের টিকিট ক্রয়ের সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছেন। এর বাইরে অনেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা স্বজনদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে পরিবার পরিচালনা করছেন। ফলে এ মুহূর্তে আটকে পড়া এসব প্রবাসীর কর্মস্থলে ফিরে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায়ও নেই।

মার্চে দেশে করোনার প্রকোপ শুরুর আগে সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরেন বহু প্রবাসী কর্মী। এরপর মে-জুনের মাঝামাঝি সৌদি আরবে মহামারীর প্রকোপ বাড়ায় ফিরে আসেন আরো অনেকে। সেখানকার সুপারশপ, রেস্টুরেন্ট ও কলকারখানা বন্ধ হয়ে পড়ার কারণেও ফিরতে বাধ্য হন অনেকে। ছুটি শেষে তাদের কর্মস্থলে ফেরার কথা থাকলেও উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় যেতে পারেননি তারা। দীর্ঘদিন দেশে থাকায় আয়-উপার্জন বন্ধ হলেও পরিবারের ভরণপোষণ চালিয়ে যেতে হয়েছে। ফলে পরিস্থিতি মোকাবেলায় ঋণের জন্য স্বজন বা বিভিন্ন সংস্থার দ্বারস্থ হতে হয়েছে তাদের অনেককেই।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে (১ এপ্রিল থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর) সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন ৩৩ হাজার ২১৬ জন বাংলাদেশী, যাদের বেশির ভাগই শ্রমজীবী। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই করোনার কারণে কর্মস্থল ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন। গত ছয় মাসে তাদের মধ্যে কতজন দেশে ঋণের বেড়াজালে আটকেছেন, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য না থাকলেও অভিবাসন নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, এ সংখ্যা ২০ হাজারের কম নয়।

ফেনীর বাসিন্দা আকবর (ছদ্মনাম) সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরেন গত ২১ ফেব্রুয়ারি। করোনা মহামারীর আগে দুই মাসের ছুটি নিয়ে দেশে ফেরেন তিনি। কিন্তু করোনার প্রকোপ বেড়ে গেলে আর সৌদি আরব ফিরতে পারেননি। দীর্ঘ সাত মাস দেশে থাকায় পরিবারের ভরণপোষণে নিজের সঞ্চিত অর্থ শেষ হয়ে যাওয়ায় এরই মধ্যে স্বজনদের কাছ থেকে প্রচুর ঋণ করে ফেলেছেন এ প্রবাসী। সৌদি আরবে যে কোম্পানিতে তিনি কাজ করছিলেন, এ মুহূর্তে কোনো কর্মীর প্রয়োজন নেই বলে জানিয়ে দিয়েছে সে কোম্পানিও। ফলে পরিবারের ভরণপোষণ চালানোর পাশাপাশি স্বজনদের কাছ থেকে নেয়া ধারের টাকা কীভাবে পরিশোধ করবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি।

সম্প্রতি কর্মস্থলে ফিরতে উড়োজাহাজের টিকিটের জন্য সোনারগাঁও হোটেলের সামনে অনুষ্ঠিত প্রবাসীদের বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেন এক সৌদি আরব প্রবাসী। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে জামালপুরের ওই বাসিন্দা জানান, এপ্রিলে করোনা মহামারীর কারণে দেশে ফিরে আসেন তিনি। দেশে ফেরার পর নিজের সঞ্চিত সামান্য অর্থ ও ধার নিয়ে মুরগির খামার শুরু করেন। কিন্তু করোনাকালে ব্যবসার উপযোগী পরিবেশ না থাকায় এর কোনো সুফল পাননি তিনি। ফলে খামারে যে ঋণের টাকা রয়েছে তা পরিশোধ করতে পুনরায় কর্মস্থলে ফিরে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। সেখানেই কথা হয় তার সঙ্গে।

সব মিলিয়ে দেশে আটকে পড়া প্রবাসী কর্মীদের গত সাত মাসের লড়াইয়ের গল্পটি আসলে দুর্দশারই। করোনার পুরো সময়টি অনিশ্চয়তা, দুশ্চিন্তা আর বেকারত্বের মধ্য দিয়ে কাটিয়েছেন তারা।

এ বিষয়ে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ (রামরু) ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ড. তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, প্রবাসী কর্মীদের জন্য আদতে আমাদের দেশে দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা নেই। যে কারণে করোনাকালে দেশে আটকে পড়া কর্মীদের এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। বিদেশের বাজারে যেমন এসব কর্মীর অধিকার সুরক্ষিত হয়নি, তেমনি আমাদের দেশেও এসব শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষিত হওয়ার ব্যবস্থা নেই। দেশের ভেতরে এসব শ্রমিকের আগেও কোনো কর্মসংস্থান ছিল না, এখনো নেই। যে কারণে তারা আগের জায়গায় ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।

তিনি বলেন, শ্রমিকদের দীর্ঘমেয়াদি এসব সমস্যা সমাধানের জন্য ঋণ নেয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এ ঋণ পাওয়ার যে জটিলতা, সেখানে প্রবাসী এসব কর্মী ঋণ পাবেন না। তাছাড়া ঋণ পেলেও সে টাকা নিয়ে তারা কী করবেন, তা নিয়ে তাদের পরিকল্পনাও নেই। কারণ তারা তো উদ্যোক্তা নয়। তাদের দেশে যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। শ্রমিকদের এসব সমস্যা সমাধানে দ্বিপক্ষীয় কিংবা বহুপক্ষীয় পদক্ষেপ জরুরি। যদি তা না হয় তাহলে এ মানুষগুলো হবে কভিডের জলাঞ্জলি।