এক বছরে ৩০ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে, জুনের মধ্যে আরও বাড়বে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার :

রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার চলমান যুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতিতে এর ক্ষতিকর প্রভাব আরও বাড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি, গম, সারসহ অন্যান্য পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাবে। তখন দেশের বাজারেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে মূল্যস্ফীতিতে চাপ আরও বাড়বে। যদিও গত বেশ কিছুদিন ধরেই নিম্ন ও মধ্যবিত্তকে সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির ট্রাকের পেছনে দৌড়াতে হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার বেশকিছু পদক্ষেপও নিয়েছে । কিন্তু  টিসিবির তথ্য বলছে, এত পদক্ষেপ নেওয়ার পরও গত এক বছরে অন্তত ৩০ ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবৈধভাবে পণ্যের মজুত গড়ে তোলায় ও সিন্ডিকেটের কারণে পণ্যের দাম বেড়েছে। এ কারণে দেশে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বেড়েছে। আগামী জুনের মধ্যে এ হার বেড়ে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে বলে প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৬০ দশমিক ৫ শতাংশ। বিপরীতে রফতানি আয় বেড়েছে ৪৭ দশমিক ৪ শতাংশ। রফতানির তুলনায় আমদানি দ্রুত বাড়ায় বাণিজ্য ঘাটতিও বেড়ে যাচ্ছে। এ ঘাটতির কারণে বৈদেশিক হিসাবে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করছে। যা মুদ্রার মান ধরে রাখাকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলেছে।

এদিকে  সয়াবিন, পেঁয়াজ  চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় সরকার কর ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সয়াবিন তেলের উৎপাদন, খুচরা ও এমনকি আমদানি পর্যায়ে সরকার মোট ৩০ শতাংশ কর ছাড় দিয়েছে ব্যবসায়ীদের। এছাড়া চিনি আমদানিতেও শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে সরকার। সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে সয়াবিনের দাম কিছুটা কমতে না কমতেই দেশের বাজারে সয়াবিন তেলের দাম আরও বাড়াতে চান আমদানিকারক ও উৎপাদনকারীরা।

বুধবার ( ৬ এপ্রিল) ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে আমদানিকারক ও মিল মালিকদের সঙ্গে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের বৈঠকে মিল মালিকরা সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো অনুরোধ জানান।

বৈঠকে সিটি, মেঘনা, এস আলম, বসুন্ধরা ও টি কে গ্রুপের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। মিল মালিকদের দাবি, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিনের দাম বেড়েছে। সরকার যে সময়ে ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়, তখন প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিনের দাম ছিল এক হাজার ৪০৭ মার্কিন ডলার। তবে বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে এক হাজার ৮৮০ ডলারে দাঁড়িয়েছে। ফলে সরকার ভ্যাট প্রত্যাহার করলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত দামে সয়াবিন তেল বিক্রি করায় তাদের লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধ দীর্ঘ হলে ক্ষতি বাড়বে অর্থনীতিতে। প্রতিবেদনে আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ার আশঙ্কা করা হয়েছে। একইসঙ্গে কোনও কারণে যুদ্ধ ইউরোপের দেশে প্রসারিত হলে বাংলাদেশের রফতানি ও রেমিট্যান্সে বড় ধাক্কা আসতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে।

চলতি সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ত্রৈমাসিক বা বাংলাদেশ ব্যাংক কোয়ার্টারলি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, করোনার কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টা যখন চলমান তখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ায় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার গতি বাধাগ্রস্ত হয়। যুদ্ধের প্রভাব ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কার্যক্রম এগিয়ে নিতে সরকারের রাজস্ব ও আর্থিক নীতির মধ্যে সমন্বয় সাধনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে অ-অর্থনৈতিক বাধাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এর মধ্যে পণ্যের অবৈধ মজুত ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে  পণ্যমূল্য কিছুটা হলেও কমবে। ফলে মূল্যস্ফীতিতে চাপও কমবে।

দেশের সার্বিক অর্থনীতির হালনাগাদ চিত্র ও ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা  প্রতিবেদনটি  প্রতি তিন মাস পরপর প্রকাশ করে  কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী গম, জ্বালানি তেল, গ্যাস, সার, লোহাসহ আকরিক প্রধান পণ্যের প্রধান যোগানদাতা রাশিয়া ও ইউক্রেন। এই দুই দেশের যুদ্ধের কারণে এসব পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। একইসঙ্গে দুই দেশ থেকেই রফতানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে পণ্যের দাম বাড়ছে। বাংলাদেশ চড়া দামে ওইসব পণ্য আমদানি করায় দেশের বাজারেও এগুলোর দাম বাড়ছে। যদি এই যুদ্ধ চলমান থাকে তবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আরও সতর্ক হতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email