শ্রীলংকা ও বাংলাদেশের মধ্যকার মিলগুলোও উপেক্ষার নয়

সংবাদ ভাষ্য :

একসময় নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতি ও পরিণতি বাংলাদেশেও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এ পটভূমিতে বাংলাদেশের মন্ত্রীরা, সংবাদমাধ্যম, এমনকি এডিবি প্রতিনিধিও বাংলাদেশে ও শ্রীলঙ্কার অমিল তুলে ধরেছেন। যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশে ও শ্রীলঙ্কার জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার যথাক্রমে ৪ দশমিক ৫ ও ১ দশমিক ৩ শতাংশ; বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যথাক্রমে প্রায় ৬ মাসের ও ১ দশমিক ৩ মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে সক্ষম; বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার জিডিপি ও ঋণের অনুপাত যথাক্রমে ৪০ ও ১০২ শতাংশ। অর্থাৎ, বাংলাদেশ প্রতিটি সূচকেই এগিয়ে এবং বর্তমানে নিরাপদ অবস্থানে আছে।

কিন্তু শ্রীলংকা ও বাংলাদেশের মধ্যকার মিলগুলোও উপেক্ষার নয়। দুই দেশের শাসনকাঠামোই কেন্দ্রীভূত এবং সরকার একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী; বাণিজ্যিক ঋণ করে অবকাঠামোতে বিনিয়োগকে উন্নয়নের কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছে। শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে চীন ও আমাদের ক্ষেত্রে চীন, ভারত ও রাশিয়া প্রধান ঋণদাতা। অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উভয় দেশেই ব্যয় ও সময়সীমা মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি ও সুবিধা বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশের ঋণ জিডিপির অনুপাত কম হলেও তা বেড়েই চলেছে। ইতিমধ্যে নিট বার্ষিক বিদেশি ঋণের পরিমাণ ২০১৪-১৫ সালে ৪ হাজার ৯১০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা ও পরিশোধের পরিমাণ ৭ হাজার ৮০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১৪ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা হয়েছে। উভয় দেশেরই রপ্তানি পণ্যের তালিকা ক্ষুদ্র এবং প্রবাসী প্রেরিত অর্থের ওপর নির্ভরশীলতা রয়েছে। উভয় দেশেই অপ্রয়োজনীয় ও ভুল প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাড়তি ক্যাপাসিটি ও এলএনজি আমদানির ক্ষেত্রে ভূমিতে প্ল্যান্ট স্থাপনের পরিবর্তে এফএসআরইউর (ভাসমান জাহাজ) উল্লেখ করা যেতে পারে।

বাংলাদেশে ফাঁপিয়ে উন্নয়নের গালগল্প বলার একটা আবহ সৃষ্টি হয়েছে। কেননা, অনুৎপাদনশীল বিনিয়োগের ফলে প্রথমে নির্মাণকাজ চলাকালে অর্থনীতিতে তেজিভাব এলেও পরে ধস নামবে, যখন প্রক্ষেপিত সুবিধা অর্জিত হবে না এবং তা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শ্লথ করে দেবে। আবার এসব বিনিয়োগ ঋণনির্ভর হওয়ায়, অনুৎপাদনশীল প্রকল্পে অতিরিক্ত বিনিয়োগের ফলে ঋণের বোঝা বাড়ছে, মুদ্রাপ্রবাহ সম্প্রসারণের ফলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে, আর্থিক বাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি ও ভঙ্গুর অর্থনীতির উদ্ভব হচ্ছে, যেমনটি আমরা এখন শ্রীলঙ্কায় দেখতে পাচ্ছি।

তবে কি বৃহৎ ভৌত অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ করা যাবে না? তা নয়, তবে ভৌত অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিম্ন ব্যয়ের উচ্চ মানের প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে হবে। মেগা প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে গিয়ে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রকল্প বাদ যাচ্ছে। যেসব প্রকল্পে বিনিয়োগ দেশীয় সম্পদ বৃদ্ধিতে অধিকতর ভূমিকা রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ ঢাকা-আশুলিয়া-গাজীপুরে কমিউটার ট্রেন ও সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম থেকে সন্দ্বীপে যাতায়াতব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্পের উল্লেখ করা যেতে পারে।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চার অধ্যাপক আনসার, ফ্লাইভজার্গ, বুডজিয়ার ও লুনের ২০১৬ সালের একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। তাঁদের নিবন্ধের নাম ‘ভৌত অবকাঠামোতে বিনিয়োগ কি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ায় না ভঙ্গুরতা আনে? চীন থেকে প্রাপ্ত সাবুদ।’ চীনের ৯৫টি যোগাযোগ খাতের প্রকল্প বিশ্লেষণ করে তাঁরা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে অপ্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামোতে অতিরিক্ত বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি না বাড়িয়ে অর্থনীতিতে ভঙ্গুরতা আনে। তাঁরা দেখিয়েছেন যে ভৌত অবকাঠামো প্রকল্প অনুমোদনের জন্য এর খরচ কম এবং রাজস্ব ও সুবিধা বাড়িয়ে দেখানো হয়। প্রকল্পের পরিবেশ ও সামাজিক বিরূপ প্রভাব কমিয়ে ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সুবিধা বাড়িয়ে দেখানো হয়। ফলে সবচেয়ে অনুপযুক্ত প্রকল্প অনুমোদন লাভ করে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য তাঁরা তিনটি পরামর্শ দিয়েছেন; (১) অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিম্ন ব্যয়ের উচ্চ মানের প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে হবে; (২) প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি ও সুবিধা ঘাটতির কথা মাথায় রেখে সীমিত সম্পদ অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে হবে; (৩) প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বৃদ্ধি, সুবিধা হ্রাসের মতো ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে কেবল সেসব প্রকল্প, যেগুলোর ধনাত্মক নিট বর্তমান মূল্য রয়েছে সেগুলোতে বিনিয়োগ করতে হবে। এই লেখকদের উপসংহার ও পরামর্শ মেনে চললে বাংলাদেশ উপকৃত হবে। শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতাও আমাদের এ শিক্ষা দেয়।

Print Friendly, PDF & Email