প্রস্তাবিত বাজেট ২০২২-২৩

শিক্ষা ও খাবারে ব্যয় কমিয়ে আনা ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না

বাজেট

এম আবদুল্লাহ ।।

বিশ্ব জুড়ে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব দেশীয় বাজারে কমিয়ে আনতে প্রস্তাবিত বাজেটে কার্যকর পদক্ষেপ নেই। বরং বাড়তি মূল্যের সঙ্গে করের বোঝা বেড়ে যাওয়ায় পণ্য ক্রয়ে সামর্থ্যহীন হয়ে পড়বে সাধারণ মানুষ। বিশেষত নিম্ন আয়ের মানুষের করভার বেড়ে যাওয়ায় তারা দুর্ভোগে পড়বে। প্রয়োজনীয় অনেক খরচ কমিয়ে আনতে হবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষা ও খাবারের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় কমিয়ে আনা ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না। শিক্ষায় ব্যয় কমালে সুষ্ঠু জাতি গঠন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। তাতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হবে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক কারণে পণ্যমূল্য বাড়ছে। আবার ভ্যাট-ট্যাক্সের কারণেও ক্রেতাকে পণ্য বা সেবার বিনিময়ে বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে। অথচ তার আয় কিন্তু বাড়েনি। ফলে উচ্চবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্তদের অসুবিধা না হলেও নিম্নবিত্তরা ধরাশায়ী হচ্ছেন। তাদের আয় বাড়ানোর কার্যকর কোনো প্রস্তাব বাজেটে নেই। সাধারণত, এ ধরনের পরিস্থিতিতে ক্রেতার ব্যয়ক্ষমতা বা ক্রয় সামর্থ্য বাড়ানোর চেষ্টা থাকতে হয়। ক্রয়ক্ষমতা বাড়ালে ক্রেতা পণ্য কিনবেই। তাতে অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। কর্মসংস্থান ও আয় বাড়ানোর সেই কার্যকর পদক্ষেপ বাজেটে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি। বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা কিংবা ক্রেতার হাতে নগদ অর্থের সংস্থান করাই এই মুহূর্তে যৌক্তিক হতো। বাজেট প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী চাহিদার লাগাম টেনে ধরার কথা বলেছেন। উচ্চবিত্তের না হয় বিলাসী পণ্যে লাগাম টানা যায়, কিন্তু সাধারণের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে চাহিদার লাগাম কি টানা যায়?

পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ করের বোঝা নিয়ে বাড়তি ব্যয় মেটানো নিম্নবিত্তের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হানের মতে, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তরা সংকটে আছে। তাদের জন্য তেমন কোনো স্বস্তির জায়গা বাজেটে নেই। মূল্যস্ফীতি সহনীয় করার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, যেমন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর শুল্ক কমানো, ভ্যাট কমানো, যাতে দেশীয় বাজারে এসব পণ্যের দাম কমে, সেটা নেই।

মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে এবার করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর জন্য সব মহলের দাবি ছিল। এটিকে ৫ লাখ টাকায় উন্নীত করার সুপারিশ করেছেন অনেকেই। কিন্তু তা না করে বরং করভার বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের মতে, উচ্চবিত্তের কর ফাঁকি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে নিচের তলার মানুষদের কাগজে-কলমে করের আওতায় রাখা হাস্যকর। তিনি বলেন, আয়করের হার নির্ধারণ করতে প্রথম কত টাকা পর্যন্ত করের হার শূন্য ধরা হবে, আর সর্বনিম্ন কত আয় হলে আয়করের আওতায় আসবে—এ দুটি বিষয়কে পৃথক করা দরকার।

এদিকে, ৩৮ ধরনের সেবায় রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর ফলে ভোগান্তি বাড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। করের টাকা বকেয়া থাকলে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ বিভিন্ন পরিষেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলেও ভোগান্তি বাড়বে। করোনা-পরবর্তী সময়ে নিম্ন আয়ের মানুষের আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার দাবি থাকলেও সেটি পূরণ হয়নি। করমুক্ত আয়সীমা না বাড়ালেও অন্যান্য খাতে সুবিধা না দিয়ে বরং আরো সংকুচিত করা হয়েছে। বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। শুধু নিত্যপণ্যই নয়, জীবনযাত্রার ব্যয়ও অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। ফলে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় সাধারণ মানুষের জন্য বাজেটে কতটুকু সুবিধা থাকছে, সেটি নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। ইতিমধ্যে বাজেট প্রতিক্রিয়ায় সব পক্ষ থেকেই বলা হচ্ছে সাধারণ মানুষ, মধ্যবিত্তরা এবার সবচেয়ে চাপে পড়তে যাচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণে দেখা যায়, মধ্যবিত্তের নিরাপদ আয়ের উৎস হিসেবে পরিচিত সঞ্চয়পত্রের সুদের হার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। তবে এবার ৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনতে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শুল্ক-কর বাড়ানোর ফলে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ফ্রিজের মতো দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, যা মধ্যবিত্তের খরচ বাড়াতে বাধ্য করবে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই মুহূর্তে মধ্যবিত্তের প্রধান সমস্যা হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি। তাদের একটু স্বস্তি দিতে বাজেটে কিছু নেই, বরং তাদের অতিরিক্ত চাপের মধ্যে ফেলা হয়েছে। রিটার্ন জমার বাধ্যবাধকতা আরোপ করায় তাদের জীবনযাপন আরো কঠিন হবে। কিছু অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যে বাড়তি শুল্ক-কর আরোপ করার ফলে তাদের খরচ বাড়বে।

এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে ক্রেডিট কার্ড গ্রহণের ক্ষেত্রে রিটার্নের কপি দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতদিন শুধু কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) দিয়েই ব্যাংকিং খাতের এই সেবা গ্রহণ করা যো, কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে এটি বাধ্যতামূলক করায় ভোগান্তি বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কেননা, বহু মধ্যবিত্ত রয়েছেন, যারা শুধু টিআইএন গ্রহণ করে এ ধরনের সেবা নিতে পারতেন। এখন তাদের রিটার্ন জমা দিতে হবে। তাছাড়া ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ৫ লাখ টাকার বেশি ঋণের আবেদন করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানতে চাইবেন ঋণ আবেদনকারী আয়কর রিটার্ন দিয়েছেন কি না। রিটার্ন জমার রসিদ বা প্রাপ্তি স্বীকারপত্র জমা না দিলে ব্যাংকগুলো ঋণ দেবে না। এ ধরনের ঋণ দিলে ব্যাংকগুলোকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে এবারের বাজেটে। তাই স্বাভাবিকভাবে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো রিটার্নের রসিদ ছাড়া আর ঋণ দিতে পারছে না। এজন্য মধ্যবিত্তের ঋণ পাওয়ার জায়গা আরো সংকুচিত হতে যাচ্ছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তির কর ছাড়ের সুবিধাও কমানো হয়েছে। বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, একজন করদাতা মোট আয়ের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ দেখাতে পারতেন। এর মাধ্যমে শর্ত সাপেক্ষে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কর রেয়াত সুবিধা নেওয়া যেত। নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী, বার্ষিক আয়ের ২০ শতাংশের বেশি বিনিয়োগে এ সুবিধা পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ, ব্যক্তি করের বোঝা আরো বাড়তে যাচ্ছে।

এবারের বাজেটে মোবাইল ফোন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এতে করে মোবাইল ফোনের দাম বেড়ে যাবে। তাছাড়া ল্যাপটপ আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের ফলে এই খাতেও বাড়তি খরচ গুনতে হবে। বর্তমানে আমদানি করা ল্যাপটপ দিয়েই সিংহভাগ চাহিদা মেটানো হয়। করোনা মহামারি শুরুর পর ভাচু‌র্য়াল পদ্ধতিতে অফিসের কাজ করা থেকে শুরু করে স্কুলের লেখা-পড়ায়ও মোবাইল ফোন, ল্যাপটপের ব্যবহার বহুগুণে বেড়েছে। এগুলো এখন আর শুধু বিলাসপণ্য নয়, নিত্যপণ্যের মতোই এগুলোর ব্যবহার হচ্ছে। নতুন করে কর আরোপের ফলে সাধারণ মানুষের ব্যয়ের চাপ আরো বেড়ে যাবে।

Print Friendly, PDF & Email