ভাইরাসের লিঙ্গ-বৈষম্য !

করোনায় পুরুষরা কেন বেশি মারা যাচ্ছে

নিউজ ডেস্ক |

সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা রোববার পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ১৪৯০০০ হাজারের মত।

এই পরিসংখ্যানের একটি প্রবণতা এখন বিশেষজ্ঞদের ভাবিয়ে তুলেছে তা হলো আনুপাতিক হারে পুরুষ মারা গেছে নারীর তুলনায় অনেক বেশি।

আক্রান্ত প্রতিটা দেশ থেকেই যে পরিসংখ্যাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখো যাচ্ছে সবজায়গাতেই আক্রান্ত নারীদের তুলনায় পুরুষের মৃত্যু হচ্ছে অনেক বেশি।

যেমন ওয়ার্ল্ডোমিটার ৫০-৫০ বলে যে ওয়েবসাইট ঘণ্টায় ঘন্টায় সারা বিশ্বের কোভিড-১৯ রোগের পরিসংখ্যান দিচ্ছে, তাদের দেওয়া হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এক নিউইয়র্ক সিটিতেই ১৪ এপ্রিল অবধি যে প্রায় ৬৬০০ জন মারা গেছে তার ৬২ শতাংশই পুরুষ।এমনকী যাদের দেহে হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগের কোনো লক্ষণ ছিলনা তাদের ক্ষেত্রেও প্রতি একশজন মৃতের ৭২ জনই ছিল পুরুষ।

চীনে যত নারী মারা গেছে তার প্রায় দ্বিগুন মারা গেছে পুরুষ। ইটালিতে মোট মৃতের ৭০ শতাংশ পুরুষ। এমনকী দক্ষিণ কোরিয়ার মত দেশে যেখানে নারীরা বেশি সংক্রমিত হয়েছে (৬১ শতাংশ) সেখানেও মৃত্যূ বেশি হয়েছে পুরুষের, প্রায় ৫৪ শতাংশ।

চীনের একটি গবেষণাগার। করোনাভাইরাস নিয়ে বিশ্বের অনেক দেশে জোরদার গবেষণা শুরু হয়েছে
চীনের একটি গবেষণাগার। করোনাভাইরাস নিয়ে বিশ্বের অনেক দেশে জোরদার গবেষণা শুরু হয়েছে

কেন পুরুষরা বেশি মারা যাচ্ছে

এই প্রবণতা কেন – তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা ধন্দের মধ্যে পড়েছেন।

“সত্যি কথা বলতে গেলে বলতে হবে যে ঠিক কেন কোভিড-১৯ নারীর তুলনায় পুরুষদের ওপর বেশি চড়াও হচ্ছে, তা আমরা বলতে পারবো না। শুধু এটা বলতে পারি যে বেশি বয়স্ক হওয়ার সাথে সাথে পুরুষ হওয়ার কারনেও ঝুঁকি বাড়ে,“ বলছেন সাবরা ক্লেইন, যুক্তরাষ্ট্রে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের, পাবলিক হেল্থ স্কুলের অধ্যাপক।

শুধু করোনাভাইরাসই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে আরো যেসব মহামারি দেখা দিয়েছে (সার্স, মার্স), তখনও দেখা গেছে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে পুরুষরাই বেশি।

কেন করোনাভাইরাস এই লিঙ্গ-বৈষম্য করছে তার কিছু ব্যাখ্যা অবশ্য গবেষক এবং চিকিৎসকরা দিচ্ছেন, তবে সেগুলো এখনও সাধারণ ধারণাপ্রসূত, গবেষণালব্ধ নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট অ্যাঙ্গেলা রাসমুসেন বলেন, সারা বিশ্বের জনগণনার পরিসংখ্যানও বলে যে এমনিতেই পুরুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তুলনামুলকভাবে বেশী।

যেসব দেশে করেনাভাইরাস সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করেছে, সেগুলোর অনেকগুলাতেই (ইটালি, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া) পুরুষের চেয়ে নারীর আয়ু বেশি।

পুরুষের লাইফস্টাইল তাদের বেশি ঝুঁকিতে ফেলছে
পুরুষের লাইফস্টাইল তাদের বেশি ঝুঁকিতে ফেলছে

অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মত হলো, পুরুষের লাইফস্টাইল (জীবণযাপনের পদ্ধতি) এর পেছনে কাজ করছে।

যেমন, নারীর তুলনায় পুরুষের জীবনযাপনে শৃঙ্খলা কম। তারা বেশি ধূমপান করে, বেশি মদ পান করে, আর এ কারণে হৃদরোগ, ক্যান্সোর বা ডায়াবেটিস বা ফুসফুসের প্রদাহে বেশি ভোগে পুরুষ। ফলে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর ঝুঁকিও তাদের বেশি, কারণ যাদেরই শরীরে আগে থেকেই অন্য কোনো কঠিণ রোগ রয়েছে, তারাই কোভিড-১৯ এ মারা যাচ্ছে বেশি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে চীনে ১৫ বছরের বেশি বয়সের পুরুসের ৪৮ শতাংশই ধূমপান করে যেখানে নারীর ধূমপায়ীর সংখ্যা মাত্র দুই শতাংশ।

সেক্স হরমোন নারীকে রক্ষা করছে

এছাড়া, অনেক গবেষক বলছেন, নারী ও পুরুষের মধ্যে শরীরতাত্বিক কিছু ব্যবধানও এর পেছনে কাজ করে থাকতে পারে। হরমোনের পার্থক্যের ভূমিকা থাকতে পারে।

একের পর এক গবেষণায়য় দেখা গেছে নারীর দেহকোষে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত বেশি।

মেডিকের জার্নাল হিউম্যান জেনোমিক্সে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হচ্ছে – দেহকোষে এক্স ক্রোমোজোমের ভেতর প্রচুর সংখ্যায় এমন জ্বিন থাকে তা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। নারীর শরীরে পুরুষের তুলনায় ঐ এক্স ক্রোমোজোমের সংখ্যা দ্বিগুন ফলে সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে নারীর দেহ পুরুষের তুলনায় শক্তিধর।

ডাক্তারের অভিজ্ঞতা

ড. সুনীল রায় গত প্রায় ৪৫ বছর ধরে ব্রিটেনে চিকিৎসা করছেন। এত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, একটা বয়স পর্যন্ত মেয়েদের মধ্যে হৃদরোগের প্রবণতা তিনি খুবই দেখেছেন।

“গত ৫০ বছরে ডাক্তারি করতে গিয়ে আমার মনে পড়েনা যে ৫০-৫৫ বছরের কোনো নারীকে আমি স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে দেখেছি, কিন্তু এরও কম বয়সী বহু পুরুষের স্ট্রোক হচ্ছে।“

তিনি মনে করেন, মেনোপজ হওয়া অবধি সেক্স হরমোনের কারণে নারীদের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা স্বাভাবিকভাবে কম থাকে।

“তাছাড়া লাইফস্টাইলের কথা যদি বলেন, মেয়েরা ধূমপান কম করে, ড্রিঙ্ক কম করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই হৃদরোগ এবং উচ্চরক্তচাপে ভোগার ঝুঁকি তাদের কম।“

একই পর্যবেক্ষণ ডা. হারুণ রশিদেরও যিনি ইংল্যান্ডের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবায় (এনএইচএস) গত ৩২ বছর ধরে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হিসাবে কাজ করছেন।

তিনি বলেন, হৃদরোগ বা ফুসফুসের প্রদাহের সমস্যা নিয়ে পুরুষরাই অপেক্ষাকৃত বেশি আসেন, বিশেষ করে দক্ষিণ-এশীয় এবং আফ্রিকান বংশোদভূত পুরুষদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি।

“ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে নারী-পুরষের মধ্যে আমি কোনো তফাৎ দেখিনা, কিন্তু হৃদরোগ বা উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রে অবশ্যই পুরষরা বেশি ভোগেন।“

ডা. রশিদ মনে করেন, ব্রিটেনে এবং আমেরিকাতে কেন কৃষ্ণাঙ্গ এবং অন্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী করোনাভাইরাসে কেন বেশি মারা যাছে – সে বিষয়টিও লিঙ্গভেদের ঝুঁকির পাশাপাশি বিশেষভাবে ভাবা উচিৎ।

বিশ্বখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ল্যানেসেট এক সম্পাদকীয়তে লিখেছে, “এটা এখনও পরিষ্কার নয় যে লিঙ্গভেদে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে বা কমে, কিন্তু এটা এখন মোটামটি পরিষ্কার যে কোভিড ১৯-এ বেশি মারা যাচ্ছে পুরুষ।

সুতরাং, ল্যানসেট বলছে, লিঙ্গভেদে এই রোগের প্রতিক্রিয়ার তারতম্যের বিষয়টি এর চিকিৎসা এবং ভ্যাকসিন গবেষণায় বিবেচনায় নিতে হবে। “বিষয়টি অগ্রাহ্য করা হলে, ফল ভালো হবেনা।“

সূত্রঃ বিবিসি

Print Friendly, PDF & Email