জন ড্যালিনোয়িচের নিবন্ধ

দিল্লির আপত্তি উপেক্ষা করেই ওয়াশিংটনের নয়া ভিসানীতি !

ডেস্ক নিউজ ◾

নয়া দিল্লির আপত্তি সত্ত্বেও বাংলাদেশে বাইডেন প্রশাসনের ভিসানীতি নিয়ে অগ্রসর হওয়াটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখছেন পর্যবেক্ষকরা। অতীতে দেখা গেছে প্রতিবেশী দেশ নিয়ে নয়াদিল্লির নীতিতে ওয়াশিংটনের নমনীয়তা ছিলো। আর সে সুযোগ নিয়েই নয়াদিল্লি বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির ক্ষেত্রে অদৃশ্য ভেটো প্রয়োগ করতো। বাইডেন প্রশাসন একদিকে যেমন নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছে ঠিক সেই সময়ে নয়াদিল্লিকে এই সংকেতও দেয়া হচ্ছে যে- বাংলাদেশে ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র নির্দিষ্ট লক্ষ্যে অগ্রসর হবে। বাংলাদেশে উপর সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত নেয়া দিল্লির অনেকটা “অসম্মতিতে সম্মত ( এগ্রি টু ডিসএগ্রি)।

বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণভাবে আয়োজন করতে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারীদের ওপর সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী একটি নিবন্ধে এ অভিমত উঠে এসেছে। নিবন্ধটি লিখেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ডেপুটি মিশন প্রধান, কূটনীতিক এবং ‘সাউথ এশিয়া পারসপেক্টিভস’র এডিটর এ্যাট লার্জ জন ড্যানিলোয়িচ। সোমবার (২৯ মে) ‘সাউথ এশিয়া পারসপেক্টিভসে এই বিশ্লেষণটি প্রকাশিত হয়।

দেশ নিউজে ডটনেট এর পাঠকদের জন্য বিশ্লেষণটির অনুবাদ তুলে ধরা হলো:

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থার উন্নয়নে গত ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছেন তা নিয়ে যে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, সেটা যার যার আন্দাজ অনুমান বলা যায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে এবং তার সমর্থকরা তাদের কথা-বার্তায় যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপকে পাত্তাই দিচ্ছেনা। খুব সহজে তারা বলে বেড়াচ্ছে যে- যুক্তরাষ্ট্র যে পদক্ষেপ নিয়েছে সেটা শেখ হাসিনার সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতিকে সমর্থন যুগাবে এবং বিরোধী দলের কর্মীরা যদি নির্বাচন চলাকালে কোনো সহিংসতা করে তাহলে এই ভিসানীতি তাদের ওপরও কার্যকর হবে। সরকার সমালোচকরা যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন নীতিকে ব্যাখ্যা করছেন এইভাবে যে, যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী দলগুলোর প্রতি তার সমর্থন থেকে সরে এসেছে এবং বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনার দাবির ব্যাপারেও এটা একধরনের পদক্ষেপ। এদিকে স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এই দুই দিকের কোনো দিকেই না গিয়ে বরং অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার দিকেই মনযোগ দিয়েছে। এই নীতির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীও মুখ বন্ধ করে আছে, তাদের অনেকই দেখা যাক কী হয় এ নীতি অবলম্বন করেছে।
অন্যান্য নীতির মতোই যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এই ভিসা নীতি কতটা সফল হবে তা নির্ভর করবে এটি কার্যকর করার উপর। নতুন এই নীতি কার্যকর করার ক্ষেত্রে প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো- যাদের ওপর ভিসার বিধি নিষেধ আরোপ করা হবে তাদের ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক সহিংসতা এবং ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনাগুলোর তদন্ত এবং মূল্যায়ন করাটা ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র মিশনের কর্মকর্তাদের জন্য কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াবে। সারা দেশে সফর করা, নিরাপত্তা, ভাষার জটিলতা এবং লোকবলের ঘাটতি-এই চ্যালেঞ্জগুলো কাজটিকে আরও জটিল করে তুলবে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের আসলে বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্ট প্রকাশে যেভাবে কাজ করতে হয় ঠিক সেভাবেই ভিসা নীতি বাস্তবায়ন করার জন্য তথ্য, প্রমাণ পেতে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মীদের সহযোগিতা নিতে হবে। একই সময়ে ঢাকাস্থ দূতাবাসে যে চিত্রটা দেখা যাবে সেটা হলো- সব রাজনৈতিক দলই তাদের নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে আর তা নিয়ে দূতাবাসকে সমস্যা পোহাতে হবে। ঢাকার কেরানিগঞ্জে সম্প্রতি যে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তাতে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ উঠে এসেছে। একটি ঘটনাই বলে দেয় কে দোষী তা খুঁজে বের করাটা জটিল তবে অসম্ভব নয়।

এর বাইরে যেটা বলা যায় সেটা হলো- স্টেট ডিপার্টমেন্টের আইনজ্ঞ এবং নীতিনির্ধারকরা কেমন ধরনের প্রমাণ চান এবং ভিসা নীতির ব্যাপারে সিদ্ধান্তের প্রক্রিয়াটা কতটুকু কষ্টসাধ্য হবে-সেটাও দেখার বিষয়। যদি বিষয়টাকে আমলাতান্ত্রিক করে ফেলা হয় তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেটা দেখা যাবে সেটা হলো- নীতিনির্ধারকরা ক্ষেত্র বিশেষ এই বিধিনিষেধ আরোপ করবেন। যেমনটা অন্য দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে দেখা যায়। ভিসার বিধিনিষেধ আরোপের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে ভালো করে চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। বিধিনিষেধ আরোপের ক্ষেত্রে যে প্রমাণের কথা বলা হয়েছে তা নিশ্চিত করতে হবে এবং আইন মোতাবেক যে নীতির অধীনে তা বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে সেটা যেন তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। আমলাতান্ত্রিক এই প্রক্রিয়ায় ভিসানীতি বাস্তবায়নে কতটুকু সময় লাগবে এবং এ নীতি বাস্তবায়নে যারা সম্পৃক্ত তারা চাহিদার আলোকে কতটুকু তা করতে পারবেন তা দেখার বিষয়।

এই ভিসানীতির সফলতার আসল পরীক্ষাটা হলো-এটা বৃহৎ পরিসরে রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত এবং অধিকতর ভালো একটি নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করতে পারবে কিনা? এটা বাস্তবায়ন করতে হলে যাদেরকে এই নীতি বাস্তবায়নের দায়িত্বে দেয়া হয়েছে তাদেরকে সরকারের নীতি নির্ধারক এবং বিরোধীদলসমূহের নেয়া সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রভাব তৈরি করতে সক্ষম হতে হবে। যেখানে অধিকাংশ সময় স্থিতাবস্তায় ব্যয় হয় সেখানে শুধু মাত্র যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বাতিলের কারণে তারা তাদের সিদ্ধান্ত বাতিল করবেনা। নিষেধাজ্ঞার হুমকিটাই বাস্তবিক অর্থে এখনো কার্যকর। নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত পরিবারের সদস্যরা যখন দেখবে তাদের বাইরে যাওয়া সীমিত হয়ে যাচ্ছে সেটা প্রভাব তৈরি করবে। বৃটেন, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো সমমনা দেশগুলো যদি একই নীতি অবলম্বন করে তাহলে তা আরও প্রভাব তৈরি করবে। নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলবাহিনী ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায় যখন দেখবে তারা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা দেশের বাইরে যেতে পারছেনা তখন হতাশ হয়ে পড়বে। সরকার এবং বিরোধী দলের শীর্ষ কর্তাদের শক্তিকে যদি দুর্বল করে দেওয়া যায় তাহলে সত্যিকারের পরিবর্তনের যে আশা করা হচ্ছে তা দেখার ক্ষেত্র তৈরি হবে।

চ্যালেঞ্জ থাকার পরও যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি একটি স্বাগত জানানোর মতো বিষয়। এটি নির্বাচনে সুবিধা হিসেবে ব্যবহার করার কোনো হাতিয়ার হবেনা তার ইঙ্গিত। নয়াদিল্লির আপত্তি সত্ত্বেও বাইডেন প্রশাসনের এই নীতি নিয়ে অগ্রসর হওয়াটা তাৎপর্যপূর্ণ। অতীতে দেখা গেছে প্রতিবেশী দেশ নিয়ে নয়াদিল্লির নীতিতে ওয়াশিংটনের নমনীয়তা ছিলো। আর সে সুযোগ নিয়েই নয়াদিল্লি বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির ক্ষেত্রে অদৃশ্য ভেটো প্রয়োগ করতো। বাইডেন প্রশাসন একদিকে যেমন নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছে ঠিক সেই সময়ে তারা নয়া দিল্লিকে এই সংকেতও দিচ্ছে যে- বাংলাদেশে ইস্যুতে কোনো ছাড় দেয়া যাবেনা। বাইডেন প্রশাসন একদিকে যেমন নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছে ঠিক সেই সময়ে নয়াদিল্লিকে এই সংকেতও দেয়া হচ্ছে যে- বাংলাদেশে ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র নির্দিষ্ট লক্ষ্যে অগ্রসর হবে। বাংলাদেশের উপর যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত নয়া দিল্লি অনেকটা “অসম্মতিতে সম্মত” ( এগ্রি টু ডিসএগ্রি)। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সমর্থনে অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক দেশ এবং বহুপাক্ষিক অংশীদারদের অঙ্গীকার প্রদর্শনের।

এবিন/ডিএন

Print Friendly, PDF & Email