কেন দেওয়া হয়, ফলাফলইবা কী?

৯ হাজার ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা

যুক্তরাষ্ট্র কেন নিষেধাজ্ঞা দেয়, ফলাফল কী?

মোহাম্মদ আবুল হোসেন ।।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে লঙ্ঘন করে এমন দেশগুলোর বিরুদ্ধে সাধারণত নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তবে তার পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। এতে যুক্ত হয়েছে মানবাধিকার, গণতন্ত্রসহ বিভিন্ন ইস্যু। ১৯৯০-এর দশক থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বে যত দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে তার তিন ভাগের দুই ভাগই আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৯৮ সালের পর তারা কমপক্ষে ২০টি দেশের বিরুদ্ধে দিয়েছে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা।

১৮০৭ সালে এমবার্গো অ্যাক্ট ব্যর্থ হওয়ার পর বিদেশি দেশগুলোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপে যুক্তরাষ্ট্র খুব সামান্যই আগ্রহ দেখায়। তবে বিংশ শতাব্দীতে এসে তা আবার শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতির পুরোটাই হলো অর্থনৈতিক নীতি বিষয়ক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের আগ্রহ পুনরুজ্জীবিত হয়। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য লীগ অব নেশন্সের মেথড হিসেবে এমন নিষেধাজ্ঞাকে অনুমোদন দেন প্রেসিডেন্ট উডরো উইলসন। লীগ অব নেশন্স ছিল বিশ্বে প্রথম আন্তঃসরকারের সংগঠন। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বে শান্তি রক্ষা করা। প্যারিস পিস কনফারেন্সে ১৯২০ সালের ১০ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করা হয় লীগ অব নেশন্স। এ সময়েই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইতি ঘটে। ১৯৪৬ সালের ২০ এপ্রিল মূল সংগঠন কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেয়। তখন এর অনেক দেশ নবগঠিত জাতিসংঘে যুক্ত হয়। এই লীগ অব নেশন্সে যুক্তরাষ্ট্রকে আনতে ব্যর্থ হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট উইলসন। ১৯৩৫ সালে ইতালির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় লীগ। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা দেয়া লীগের সঙ্গে তখন যোগ দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে অথবা বহুপক্ষীয়ভাবে নিষেধাজ্ঞা দেবে কিনা তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়। শীতল যুদ্ধের সময়ে কিউবা, চীন ও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে একতরফাভাবে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর এবং শীতল যুদ্ধের অবসান হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগতভাবে বহুপক্ষীয় নিষেধাজ্ঞা দেয়া বৃদ্ধি করে। জিম্বাবুয়ে, যুগোস্লাভিয়া এবং ইরাকের মতো কিছু রাষ্ট্রে বিরুদ্ধে ১৯৯০-এর দশকে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এ সময় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান যেমন জাতিসংঘ ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তারা নিষেধাজ্ঞা দেয়। যোগাযোগ বিষয়ক শিক্ষাবিদ স্টুয়ার্ট ডেভিস এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইমানুয়েল নেসের ২০০০-এর দশকের গবেষণা এবং ২০১০-এর দশকে ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়া গবেষণায় বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র বহুপক্ষীয় নিষেধাজ্ঞার পক্ষে অনেক কমই অবস্থান নিয়েছে। বিশেষ করে তার ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগী যেমন রাশিয়া অথবা চীনের মতো দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ক্ষেত্রে।

করোনা মহামারির সময়ে মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলে এবং মার্কিন কংগ্রেসের কিছু সদস্য যুক্তরাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় তাদের নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করতে, যাতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া দেশগুলোর মানুষের জন্য পরিস্থিতি সহায়ক হয়। নিষেধাজ্ঞা স্থগিত রাখতে যেসব কংগ্রেস সদস্য অবস্থান নিয়েছিলেন তার মধ্যে ছিলেন বার্নি স্যান্ডার্স, আলেকজান্দ্রিয়া ওক্যাসিও-কর্টেজ এবং ইলহান ওমর। অন্য যেকোনো দেশ বা জাতির চেয়ে ঘন ঘন নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং তারা তা আরোপ করে বৃহত্তর পরিসরে। আমেরিকান স্টাডিজের শিক্ষাবিদ মানু কারুকার মতে, ১৯৯০-এর দশকের পর বিশ্বে যত নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে তার তিন ভাগের মধ্যে দুই ভাগই দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সব মিলে যেসব দেশ এই নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছে সেখানকার মানুষের মোট জিডিপি বিশ্বের ৫ ভাগের মধ্যে মাত্র একভাগের কিছু বেশি। এই গ্রুপের জিডিপি’র শতকরা আশি ভাগই আসে চীন থেকে।

যুক্তরাষ্ট্র যেসব নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে, তা হলো-
ক) অস্ত্র সম্পর্কিত রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা।
খ) দ্বৈত ব্যবহারের প্রযুক্তি রপ্তানির ওপর নিয়ন্ত্রণ।
গ) আর্থিক সহায়তায় বিধিনিষেধ।
ঘ) আর্থিক বিধিনিষেধ। যেমন- বিশ্বব্যাংক ও অন্য আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের বিরোধিতা করবে যুক্তরাষ্ট্র। কূটনৈতিক দায়মুক্তি বাতিল করা হয়, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে সন্ত্রাসের শিকার পরিবারগুলো নাগরিক ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারে। তালিকাভুক্ত দেশগুলোতে কোম্পানিগুলো এবং ব্যক্তিবিশেষের ট্যাক্স ক্রেডিট প্রত্যাখ্যান করা হয়। ওইসব দেশ থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা স্থগিত করা হয়। তালিকায় থাকাদের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনে মার্কিন নাগরিকদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা থাকে। তালিকাভুক্ত দেশগুলোর কোম্পানিগুলোর মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এক লাখের বেশি ডলারের চুক্তিতে নিষেধাজ্ঞা থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে ভিসায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২১ সাল নাগাদ টার্গেট করা দেশগুলোর কমপক্ষে ৯ হাজার ব্যক্তি, কোম্পানি এবং আর্থিক খাতের অর্থনীতিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বছর জুন পর্যন্ত যেসব দেশ বা অঞ্চল বা কোম্পানি বা ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র তার সংখ্যা প্রায় ২৬। এর মধ্যে ২০২১ সালে বাংলাদেশে র‌্যাব ও র‌্যাবের বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের অভিযোগ, র‌্যাব ও ওইসব কর্মকর্তা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত। এর মধ্যদিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। এর বাইরে আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। তাতে বলা হয়েছে, নির্বাচনে বাধা প্রদান করলে যে কারও বিরুদ্ধে এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেবে যুক্তরাষ্ট্র। এর আওতায় রয়েছে কার্যত প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নিরাপত্তা, সাংবাদিক, মিডিয়া সহ সবাই।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আফগানিস্তান, বলকানস, বেলারুশ, মিয়ানমার, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র, চীন, কিউবা, কঙ্গো, ইথিওপিয়া, হংকং, ইরান, ইরাক, লেবানন, লিবিয়া, মালি, নিকারাগুয়া, উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া,  সোমালিয়া, সুদান, দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া, ইউক্রেন, ভেনিজুয়েলা, ইয়েমেন ও জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে।

২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর বিবিসি’র এক খবরে নিষেধাজ্ঞা কেন দেয়া হয়, সে সম্পর্কে বলা হয়- সাধারণত কোনো দেশ আরেকটি দেশকে বা নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শাস্তি দেয়ার জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এমন দেশ এরকম নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যেসব দেশে ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের যাতায়াত, বিনিয়োগ বা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় রয়েছে। আবার নিষেধাজ্ঞা অনেক সময় এক দেশ আরেক দেশের ওপর প্রতিশোধ হিসেবে আরোপ করে। যেমনটা রাশিয়া ২০১৪ সালে ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে করেছিল। ইউনিভার্সিটি অব স্যালফোর্ডের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মরটিজ পিয়েপার বলেছেন, আপনি একটি দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেন। কারণ আপনি ঐ দেশটির আচরণে পরিবর্তন দেখতে চান। বিষয়টা হলো, ওই দেশের নাগরিক তার নিজ দেশের সরকারের ওপর রাগান্বিত হবে এবং দাবি জানাবে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার ভিত্তিতে সরকার যাতে শোধরায়।

তবে নিষেধাজ্ঞা নিয়েও সমালোচনা আছে। কেউ কেউ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগতভাবে পররাষ্ট্র বিষয়ক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে নিষেধাজ্ঞাকে। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ক হার্বার্ট এফ জনসন প্রফেসর রাবি আবদে লাল মনে করেন, শীতল যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে নিষেধাজ্ঞা। তার মতে- ‘যখন কূটনীতি অপর্যাপ্ত এবং শক্তি প্রয়োগের জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়, তখন কার্যকর নিষেধাজ্ঞা’। বৃটিশ কূটনীতিক জেরেমি গ্রিনস্টোক বলেন, কথা আর সামরিক অ্যাকশনের মধ্যে আর কিছুতেই যখন কাজ হয় না, তখন আপনি একটি সরকারকে চাপে রাখতে জনপ্রিয় মাধ্যম হলো নিষেধাজ্ঞা। আর সিআইএ’র সাবেক উপ-পরিচালক ডেভিড কোহেন লিখেছেন- ‘যখন একটি নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য হয় শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তন তখন সেই নিষেধাজ্ঞা কোনো যুক্তির ধার ধারে না। টার্গেট করা একটি শাসকগোষ্ঠী এই দাবি মেনে নিতে পারে না’।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বেশির ভাগ বোদ্ধা উপসংহারে মনে করেন, নিষেধাজ্ঞা কখনোই কোনো দেশের সরকারকে উৎখাত করে না অথবা এ বিষয়ে সম্মতিও দেয় না সংশ্লিষ্ট সরকারগুলো। (তথ্য সূত্র- ইন্টারনেট)

Print Friendly, PDF & Email