করোনায় মৃত্যুভয়, ধর্মভীরুতা বৃদ্ধি ও নিজেকে সমর্পণ

নিউজ ডেস্ক |

বাংলাদেশে মার্চ মাসে প্রথম কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হওয়ার পর পরিস্থিতি যেমনটা ছিল তা থেকে অনেকটাই বদলে গেছে। তখন হয়ত খবরে শোনা যেত কোন এলাকার নাম যেখানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পরেছে।

কিন্তু করোনাভাইরাস এখন আর দুরের কোন এলাকার খবর নয়। মনে হচ্ছে করোনাভাইরাস এখন যেন প্রতিটি মানুষের খুব কাছে চলে এসেছে।

প্রতিদিনই আত্মীয়, বন্ধু, সহকর্মী, প্রতিবেশীদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার অথবা মারা যাওয়ার অনেক বেশি খবর কানে আসছে। শুরুর দিকের উদ্বেগও যেন ভিন্নরূপ নিয়েছে। বিভিন্ন বিষয় অবলম্বন করে অনেকেই তা মোকাবেলা করার চেষ্টা করছেন।

শঙ্কা কাটাতে যা করছেন অনেকে

ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা সুমাইয়া বিনতে মাসুদ কয়েকদিনের ব্যবধানে জেনেছেন তার ফুপার পরিবারের সবাই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তির একদিনের মাথায় ফুপাকে শ্বাসপ্রশ্বাসে যন্ত্রের সাহায্য দিতে হচ্ছে।

তিনি বলছেন, ইদানীং চারপাশে এত আক্রান্ত আর মৃত্যুর খবর কানে আসছে যে তার মধ্যে এক ধরনের মৃত্যু ভয় কাজ করতে শুরু করেছে।

তার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলছেন, “আমার ফুপার কথাটাই বলি, সে ছিল একদম সুস্থ মানুষ। জ্বর হওয়ার পর অক্সিজেন কমে গেলে হাসপাতালে নেয়া হয়। এর একদিনের মাথায় তাকে ভেন্টিলেটরে দিতে হয়েছে। এই জায়গাটা আমাকে খুব হিট করেছে। আজকে আমি কাজ করছি, ভালো আছি। হয়ত দুই দিন পর থাকবো না।”

“মৃত্যু খুবই সত্যি এই অনুভূতিটা আরও শক্তিশালী হয়েছে। এখন দিনের মধ্যে অনেকবার মৃত্যুর চিন্তা করছি। আগে যেটা করতাম না।”

সুমাইয়া বিনতে মাসুদ খবর দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। তার যদি মৃত্যু হয় তাহলে কোন কাজগুলো করতে হবে সেটি স্বামীকে বলে রেখেছেন।

ঢাকার মুগদা পাড়ার বাসিন্দা উম্মে আফতাব তন্বী হঠাৎ করে আগের থেকে অনেক বেশ ধর্মভীরু হয়ে উঠেছেন। কয়েকদিন আগে তিনি জেনেছেন তার স্বামীর এক বন্ধু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তার কলোনিতে প্রচুর সংক্রমণ ধরা পরেছে।

করোনাভাইরাসের ছবি
করোনাভাইরাস এখন আর শুধু টেলিভিশনের খবর নয়।

তিনি বলছেন, “আগে যদিও দুই এক ওয়াক্ত বাদ যেত এখন একদমই না। নামাজ পরছি, কোরআন তেলাওয়াত করছি। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাই। বলি আল্লাহ তুমি আমরা তোমার বান্দা যারা, সেই যেই ধর্মেরই হোক, আমাদের আর একবার শুদ্ধ হওয়ার সুযোগ দাও। আমাদের ক্ষমা করে এবারকার মতো রেহাই করো।”

করোনাভাইরাসকে মেনে নেয়া

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরিন বলছেন, অনেকেই করোনাভাইরাসের সাথেই বসবাস করতে হবে এই বিষয়টি মেনে নিয়েছেন, কারণ চারপাশে করোনাভাইরাসের বৃত্ত যেন ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসছে।

এখন আর করোনাভাইরাস শুধু টেলিভিশনের খবর নয়, শুধু পরিসংখ্যান নয়, দুরের কোন দেশ, অঞ্চল, রাস্তা বা এলাকার বিষয় নয়। এই ভাইরাস এখন নানাভাবে সবার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অংশ।

সবাই জেনে গেছে করোনাভাইরাসের কাছে শক্তিশালী ও উন্নয়নশীল দেশ, ধনী বা দরিদ্রের কোন পার্থক্য নেই। এর কোন কার্যকর চিকিৎসা নেই, টিকাও আবিষ্কার হয়নি।

জোবাইদা নাসরিনের ভাষায়, “আগে করোনাভাইরাস দুরের বিষয় ছিল। আমরা বলেছি: ‘তাদের, তারা।’ এখন সব ‘আমরা’ হয়ে গেছে। শুরুতে ছিল ফিয়ার, তারপর ফোভিয়া আর এখন বাস্তবতা।”

তিনি বলছেন, পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে বাংলাদেশে অঢেল অর্থের বিনিময়েও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর প্রাণ রক্ষা সম্ভব হয়নি। মন্ত্রী, সচিব থেকে শুরু করে সমাজের সকল স্তরের মানুষ সবাই সমানভাবে আক্রান্ত।

হাসপতালে রোগী
সমাজের সকল স্তরের মানুষ সবাই সমানভাবে আক্রান্ত।

তার মতে, “বাংলাদেশে যে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, করোনাভাইরাস আমাদের চোখের সামনে সেটা উন্মোচন করেছে। হাসপাতালে জায়গা নেই, রোগী ভর্তি না করে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে, পর্যাপ্ত আইসিইউ নেই, অক্সিজেন নেই, পরীক্ষার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা। মানুষের মধ্যে হাহাকার তৈরি হয়েছে যে যাদের টাকা আছে তারাই বেঁচে থাকতে পারছেন না, সেখানে আমি কিভাবে বেঁচে থাকবো। এরকম পরিস্থিতিতে মানুষ নিজেকে সমর্পণ করে।”

মৃত্যুভয়, ধর্মভীরুতা,পরিত্রাণের উপায়

ক্লিনিকাল সাইকোলজিষ্ট ডা. ইশরাত শারমিন বলছেন, চরম দুর্দিনে মানুষের মধ্যে মৃত্যুভয়, ধর্মভীরুতা বৃদ্ধি পায়। তারা নিয়তির কাছে নিজেকে সমর্পণ করে।

তার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলছেন, “যখন মানুষ অনুভব কর যে আর কোন উপায় নেই, সাহায্যের আর কোন পথ খোলা নেই সে সম্পূর্ণ অসহায় বোধ করে তখন সে সারেন্ডার করে, হাল ছেড়ে দেয়। তখন তারা ভাবে একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই আছেন যিনি আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে।”

তিনি বলছেন, “মানুষ এই অনুভূতির সাথে খাপ খাওয়ানোর উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করে, অবলম্বন খোঁজে। কেউ ধর্মের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে, কেউ হাল ছেড়ে দেয়, কেউ মেনে নেয়। মেনে নিয়ে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, আশঙ্কা থেকে এক ধরনের পরিত্রাণ পায়।”

তিনি বলছেন, করোনাভাইরাসের কাছে যে অসহায়ত্ব মানুষের তৈরি হয়েছে, সাহায্যের সুযোগ যেভাবে সংকুচিত হয়ে গেছে সেজন্য মানুষ বেপরোয়াও হয়ে উঠতে পারে।

সূত্রঃ বিবিসি

ডিএন/বিবিসিবাংলা/বিএইচ

Print Friendly, PDF & Email