ফেব্রুয়ারিতে নিগ্রহের শিকার ২৩ সাংবাদিক, ১ জনের রহস্যজনক মৃত্যু

ProthomAlo_19-02-2019 (8)ডেস্ক রিপোর্টঃ  ফেব্রুয়ারিতে হামলা, মামলা, গ্রেফতার, হুলিয়াসহ নিগ্রহের শিকার হয়েছেন ২৩ জন সাংবাদিক। তন্মদেধ্যে হামলার শিকার হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন ১৪জন। চলতি ২০১৯ সালের দ্বিতীয় মাসে রেকর্ডসংখ্যক ৫ সাংবাদিককে গ্রেফতার করে জেলে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এই ৫ জনের দুই জনকে আবার ভ্রাম্যমান আদালত এক মাসের জেল দিয়েছে। একজন রিমান্ডও খেটেছেন। আরও ৪ জন হুলিয়া নিয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। এছাড়া গ্রেফতারি এড়াতে প্রথম আলো সম্পাদকসহ ৩জন আদালতে আত্মসমর্পন করে জামিন নিয়েছেন এ মাসে। রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে এক সাংবাদিকের। দেশের প্রধান প্রধান দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টের ভিত্তিতে এ চিত্র তুলে এনেছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে’র মিডিয়া মনিটরিং সেল।

বিএফইউজে’র দফতর সম্পাদক সাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে হামলা, মামলা ও হুমকির শিকার হয়েছিলেন ১২ জন সাংবাদিক। সন্ত্রাসী হামলায় আহত হয়েছেন ১০জন। ডিজিটল আইনে গ্রেফতার হয়ে জেল খেটেছেন ২জন। গায়েবী মামলায় কারাভোগ করেছেন ১জন। দু’জন জামিনে মুক্তি পেলেও একজন এখনও জেলে রয়েছেন। দুর্ঘটনার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন দুই সাংবাদিক। অর্থাৎ দুই মাসে হামলা, মামলা, গ্রেফতারসহ নিপীড়নের শিকার হয়েছেন সারাদেশের ৩৫ সংবাদকর্মী। কারানির্যাতিত হয়েছেন ৮ জন। এখনও জেলে আছেন ৬ জন সাংবাদিক। পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ৪ জন।
ক্রমবর্ধমান সাংবাদিক নির্যাতন, গ্রেফতার, হয়রানির ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে’র সভাপতি রুহুল আমিন গাজী ও মহাসচিব এম আবদুল্লাহ এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজে’র সভাপতি কাদের গনি চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ শহিদুল ইসলাম। নেতৃবৃন্দ প্রত্যেকটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

বিস্তারিত : ফেব্রুয়ারি-২০১৯
ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে রাজশাহীর বাঘায় রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে স্থানীয় এক সাংবাদিকের। দৈনিক যায় যায় দিন ও দৈনিক আমাদের রাজশাহীর উপজেলা প্রতিনিধি সেলিম আহমেদ ভান্ডারী বিষক্রিয়ায় মৃত্যুবরন করলে স্থানীয় এক হোমিও ডাক্তারকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২ ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় প্রকাশিত খবর এবং পরিবারের অভিযোগ থেকে জানা যায়, হোমিও ডাক্তার মাসিদুল করিম ডেকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে কোমল পানীয়র সঙ্গে ইথোনিকেল দ্রব্য পান করিয়ে দিলে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন সেলিম ভান্ডারী। তার সঙ্গে আরও একজন একই বিষক্রিয়ায় মৃত্যুবরন করে।
৩ ফেব্রুয়ারি বরগুনার বামনায় হামলার শিকার হন মানবজমিনের জেলা প্রতিনিধি মিজানুর রহমান টিপু। জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি হেমায়েত উদ্দিন মোল্লা এ হামলা চালনা। ২০১৪ সালের এক হত্যা মামলার তদন্তে হেমায়েতের নাম আসার খবর প্রকাশের জেরে এ হামলা হয় বলে মানবজমিনসহ অন্যান্য পত্রিকার খবরে জানা যায়। টিপু রক্তাক্ত হলে তাকে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়।
আগের দিন ২ ফেব্রুয়ারি বরগুনায় এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশের হাতে নিগৃহীত হন ডিবিসি টেলিভিশনের জেলা প্রতিনিধি মালেক মিঠু। ডিবির উপ-পরিদর্শক রিপন মিয়া মিঠুকে শারিরীকভাবে লাঞ্ছিত করেন। পরে পুলিশ কর্মকর্তা রিপন মিয়াকে ক্লোজ করা হয়েছে বলে খবরে জানা যায়।
এদিকে ১৬ ফেব্রুয়ারি বরগুনার তালতলিতে সন্ত্রাসীরা হাতুড়িপেটা করে স্থানীয় সাংবাদিক মোস্তফা কামালের হাত পা গুড়িয়ে দিয়েছে। ঘটনার দিন রাত ৮টায় উপজেলার বড় আমখোলা গ্রামের নাজির বাড়ি জামে মসজিদের কাছে এ হামলার ঘটনা ঘটে। মোস্তফা কামাল বরিশালের দৈনিক কীর্তনখোলার উপজেলা প্রতিনিধি। ওঁতপেতে থাকা সন্ত্রাসীরা রাস্তার দুই পাশের গাছের সঙ্গে রশি বেধে সাংবাদিক মোস্তফা কামালের মোটর সাইকেলের গতিরোধ করে হামলা চালায়। পূর্ব শত্রুতার জেরে এ নৃশংস হামলা হয়ে থাকতে বলে খবরে জানানো হয়েছে। মূমুর্ষ অবস্থায় তাকে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

ফেব্রুয়ারি মাসে সবচেয়ে বড় সাংবাদিক নিপীড়নের ঘটনা ঘটে ১৮ তারিখে। একদিনে অন্ততঃ ১১ জন সাংবাদিক হামলার শিকার ও নিগৃহীত হয়েছেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেটের এমসি কলেজে পৃথক ঘটনায় কর্তব্যরত সাংবাদিকরা আক্রান্ত হন। দু’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষের সময় সাংবাদিকদের ওপর হামলা হয়। সিলেটে আহত ৪ ফটো সাংবাদিক হচ্ছেন সমকালের ইউসূফ আলী, ভোরের কাগজের অসমিত অভি, দৈনিক জাগরণের মিঠু দাস ও সিলেটের অনলাইন টেলিভিশন সিলটিভির কাওসার আহমদ। এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির নেতাদের হামলার শিকার হয়েছেন জবি প্রেস ক্লাবের সভাপতিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ৭ সাংবাদিক। ঘটনার দিন বিকেলে ছাত্রলীগের তরিকুল-রাসেল গ্রুপের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে নতুন কমিটি পদ প্রত্যাশিতরা। এসময় তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে রামদা দিয়ে আঘাত করা হয় দৈনিক সংবাদের সাংবাদিক রাকিবুল ইসলামের মাথায়। তাকে বাঁচাতে গিয়ে মাথায় আঘাতের শিকার হন দৈনিক সমকালের লতিফুল ইসলাম, বিডি২৪রিপোর্ট ডটকমের সানাউল্লাহ ফাহাদসহ ৭ জন সাংবাদিক।

৫ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুুরের ভাঙ্গায় দুই সাংবাদিককে দন্ড দিয়ে কারাগারে পাঠায় ভ্রাম্যমান আদালত। কেন্দ্র সচিবের অনুমতি ছাড়া এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশের অভিযোগে দৈনিক ভোরের ডাক ও আলোকিত বাংলাদেশের উপজেলা প্রতিনিধি সাইফুল্লাহ শামীম ও দৈনিক জনতার উপজেলা প্রতিনিধি রবিউল ইসলামকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুকতাদিরুল ইসলাম এক মাসের কারাদন্ড দিয়ে জেলে পাঠান বলে পর দিন দৈনিক প্রথম আলোর খবরে জানানো হয়েছে।
২০ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হন যুগান্তরের সাংবাদিক আবু জাফর। তিনি পত্রিকাটির কেরানীগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি। দোহার থানার মামলায় কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ জাফরের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে। ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার দোহারে ৫ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন স্থানীয় যুবলীগ সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ পলাশ। আবু জাফর ছাড়া মামলার অন্য আসামীরা হচ্ছেন- যুগান্তরের নবাবগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি আজহারুল হক এবং যুগান্তরের সাংবাদিক মোঃ হুমায়ুন কবীর, শামীম খান ও মেহেদী হাসান। যুগান্তর পত্রিকায় নবাবগঞ্জ থানার ওসি মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় যুবলীগ নেতাকে দিয়ে ডিজিটাল আইনে মামলা করিয়ে সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে যুগান্তরের খবরে জানানো হয়েছে। গ্রেফতারের পর পুলিশ জাফরের দশ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত তা নামঞ্জুর করে জেলে পাঠায়।
দুই দিনের ব্যবধানে ২২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক যুগান্তরের আরেক সাংবাদিক গ্রেফতার হন চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায়। ইউএনওর দুর্নীতি- অনিয়ম নিয়ে রিপোর্ট করায় যুগান্তরের লোহাগাড়া প্রতিনিধি মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী- রাত ৮টার পর বাসায় শয়নকক্ষ থেকে গ্রেফতারের সময় ইউএনও আবু আসলাম নিজে উপস্থিত থেকে সাংবাদিক সেলিমকে গুলি করার হুমকি দেন। সেলিমের বেড রুমে ঢুকে ইউএনও অশালীন ভাষায় গালাগাল করে পুলিশকে বলেন, ‘সরকারের বিরুদ্ধে নিউজ! ওকে গ্রেফতার করুন, শালাকে আমি গুলি করে মারবো’। সেলিমের স্ত্রী ঘটনার বর্ণনা দিয়ে অভিযোগ করেন, গ্রেফতারের সময় পুলিশ ছাড়াও অপরিচিত কিছু লোক সেলিমের বাড়ি ঘেরাও করে রাখে। পরে তাকে ২০১৪ সালের একটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জেলে নিক্ষেপ করা হয়। এখনও তিনি কারাগারে রয়েছেন।
ঢাকায় নিজ বাসা থেকে গ্রেফতার হয়েছেন একুশে টেলিভিশনের প্রধান প্রতিবেদক এসএম সেকান্দার মিয়া। যদিও পেশাগত কোন কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে নারিঘটিত অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় তাকে গ্রেফতার করে দুই দিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় নারী নির্যাতন দমন আইনে মামলা হলে র‌্যাব বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করে। অভিযোগকারী ইটিভিরই তাঁর এক নারী সহকর্মী। এ নিয়ে পরষ্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া যায়। ইটিভিতে গ্রুপিং ও অস্থিরতার রেশে সেকান্দর গ্রেফতার হন। একপক্ষ বলছে তিনি মহলবিশেষের রোষে পড়েছেন। অন্যপক্ষের দাবি সেকান্দার তার নারী সহকর্মীকে যৌন হয়রানি করেছেন।
৪ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের পেকুয়ায় উপজেলায় কর্মরত নয়াদিগন্তের প্রতিনিধি ছফওয়ানুল করীমকে কারাগারে পাঠানো হয়। তিনি পেকুয়া প্রেস ক্লাবেরও সভাপতি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে একটি হয়রানিমূলক গায়েবী মামলায় তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিনে ছিলেন। সিনিয়র জুড়িশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির হলে তাঁর জামিন নাকচ করে জেলে পাঠায়।
৬ ফেব্রুয়ারি মানহানি মামলায় কুষ্টিয়ারি সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির হয়ে জামিন নেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও পত্রিকাটির কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি নোমান বাশার।
১৭ ফেব্রুয়ারি খুলনায় কর্মরত মানবজমিনের স্টাফ রিপোর্টার রাশিদুল ইসলাম তার বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়ের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় দায়রা জজ আদালত থেকে জামিন লাভ করেন। এর আগে তিনি পক্ষকাল আত্মগোপনে থেকে হাইকোর্ট থেকে জামিন নেন। ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাতে রিটার্নিং অফিসারের ফলাফল ঘোষণায় অসংগতি নিয়ে রিপোর্ট করে খুলনার দুই সাংবাদিক ডিজিটাল আইনে মামলার আসামী হন। অপর আসামী হেদায়েত হোসেন গ্রেফতার হয়ে রিমান্ড ও কারাভোগের পর জামিন পান।
দৈনিক বর্তমান ও অনলাইন নিউজপোর্টাল ব্রেকিং নিউজবিডি’র চট্টগ্রাম প্রতিনিধি জীবন মূসা হয়রানিমূলক মামলায় আদালত থেকে জামিন নেন ৫ ফেব্রুয়ারি। ফটিকছড়ির দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করায় তার বিরুদ্ধে মিথ্যা চাঁদাবাজি মামলা করা হয় বলে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়।

Print Friendly, PDF & Email